দীর্ঘস্থায়ী গ্যাস-সংকটে টেক্সটাইল মিলগুলো বিপর্যস্ত
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। তীব্র গ্যাস-সংকটের কারণে এক মাস ধরে এ কারখানায় উৎপাদন নেমে এসেছে ৩০ শতাংশের নিচে।
পরিস্থিতির চাপে মুষড়ে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আজহার খান। বেশিকিছু বলার মতো মানসিক অবস্থায় নয় তাঁর; শুধু বললেন, '"কী করব বুঝতে পারছি না। দোয়া করবেন, যেন শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারি।"
মিথিলা টেক্সটাইল অতি-নিম্ন সক্ষমতা নিয়ে এখনও সচল থাকলেও নারায়ণগঞ্জের আরেকটি টেক্সটাইল কারখানা ইনটিমেট স্পিনিং মিল গ্যাসের সংকটে প্রায় বন্ধ অবস্থা। কারখানাটি দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সংকটের সম্মুখীন হয়ে আসলেও গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।
কারখানাটির চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম টিবিএসকে বলেন, "স্পিনিং সেক্টরে গত প্রায় চার দশক ধরে আমার ব্যবসা। এবারের মত এত তীব্র গ্যাস-সংকট আর দেখিনি।"
শুধু টেক্সটাইল শিল্পই নয়, দেশের গ্যাসনির্ভর অন্যান্য শিল্প, যেমন স্পিনিং, ডাইং ও প্রিন্টিং কারখানা, নিট পোশাক, সিমেন্ট, সিরামিক, লৌহ ও ইস্পাত শিল্পের শত শত কারখানা এই সংকটের কবলে। বিশেষত নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী ও ময়মনসিংহের গ্যাস-নির্ভর শিল্পগুলো সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গ্যাসের সংকটে তাদের উৎপাদন এমনকি ৩০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
দেশে গ্যাস-সরবরাহের মূল দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার। উদ্যোক্তারা বলছেন, পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা এই সমস্যার সমাধান হতে আরো প্রায় দেড় মাস সময় লাগবে বলে তাঁদেরকে জানিয়েছেন।
মেট্রোসিম ইস্পাত ও মেট্রোসিম সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহিদুল্লাহ টিবিএসকে জানান, গ্যাস-সংকটের কারণে তাদের কারখানাগুলো এক শিফট বন্ধ রেখে, কেবল রাতে চালু রাখতে হচ্ছে।
নিট পোশাক খাতের উদ্যোক্তা মোহাম্মদ হাতেমও একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানান।
টেক্সটাইল মিল মালিকদের মতে, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)'র আওতাধীন প্রায় ৭০০ টেক্সটাইল কারখানায় গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদনে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে এসেছে। কারখানাগুলোতে অনুমোদিত গ্যাসের প্রেশার ১০থেকে ১৫ পিএসআই (গ্যাস সরবরাহের চাপ পরিমাপের একক) থাকলেও – গত একমাস ধরে ০ থেকে ২ পিএসআই এর মধ্যে থাকছে।
মাঝেমধ্যে স্বল্প সময়ের জন্য এ সংকট হলেও – এবারের সংকট দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।
সাভারের উলাইলে অবস্থিত মধুমতি টাইলস লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স) কে এম সেলিম বলেন, গ্যাস-সংকটের কারণে গত ১ জুন আমাদের কারখানাটি পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। "কারখানা চালু রাখতে আমাদের ন্যূনতম ৮ থেকে ৯ পিএসআই গ্যাসের চাপ দরকার ছিল, কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রিমালের পর থেকেই তা শূন্য দশমিক ৫ পিসিআইয়ে নেমে আসে।"
প্রায় ৪০০ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে মধুমতি টাইলসে, কারখানা বন্ধ থাকায় প্রতিদিন এখন তাদের দৈনিক অন্তত ৬ লাখ টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। সেলিম জানান, "গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদনে ফেরা সম্ভব হবে না।"
গাজীপুরের আমান গার্মেন্ট এর মালিক মো. জসীম উদ্দিন জানান, গ্যাস-সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করতে পারায়–আট ঘণ্টার উৎপাদন সময়ের মধ্যে অন্তত পাঁচ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকছে না।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "ইউটিলিটি সেবার মূল্য ও বেতন বাবদ ব্যয় অনেকটাই বেড়েছে, এর সাথে উৎপাদিত পণ্যের দাম সমন্বয় করাটা খুবই কঠিন, আমাদের এখন কোণঠাসা অবস্থা।"
দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান– বিএসআরএম এর কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছেন যে, চলমান গ্যাস-সংকটের কারণে রড ও বিলেট উৎপাদনে তাদের লোকসান হবে।
বিএসআরএমের দুটি কারখানায় দৈনিক রড উৎপাদনের সক্ষমতা ৫ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন। চারটি বিলেট কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ৬ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি।
বিএসআরএম গ্রুপের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিএমডি) তপন সেন গুপ্ত টিবিএসকে বলেন, "গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন চালু রাখতে ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে গ্যাসের তুলনায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে প্রায় তিনগুণ। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে ক্ষতির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে।"
ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনায় গ্যাস-সংকটের আরো অবনতি হয়েছে
গত ২৭ মে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। রিমালের কারণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের একটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন থেকেই টেক্সটাইল কারখানাগুলো তীব্র গ্যাস-সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে।
আনুষ্ঠানিক তথ্যমতে, দেশে শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা ও বাসা-বাড়িসহ সবমিলিয়ে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩,৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি)। এরমধ্যে প্রায় ২,৬৩৫ এমএমসিএফডি স্থানীয়ভাবে উত্তোলিত গ্যাস দিয়ে মেটানো হয়। আর প্রায় ১ হাজার এমএমসিএফডি'র ঘাটতি রয়েছে।
তবে সামিট এলএনজির মালিকানাধীন টার্মিনালটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়– জাতীয় গ্রিডে সরবরাহে আরো ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুটের ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে জানান পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা।
তারা বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত টার্মিনালের একটি ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) মেয়ামত করার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে। তাই এটি চালু করতে আরও সময় লাগবে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইন) মো. কামরুজ্জামান খান টিবিএসকে বলেন, "একটি এফএসআরইউ রিপেয়ারের জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।"
খুব শিগগিরই এ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কোনো আশার কথা শোনাতে পারেননি তিনি। তিনি বলেন, "আমাদের এভাবেই অভ্যস্ত হতে হবে। যে পরিমাণ ক্যাপাসিটি আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি (গ্যাস) সংযোগ দেওয়া আছে। সেজন্যই এই ঘাটতি।"
পেট্রোবাংলাকে বিটিএমএ'র চিঠি
বিটিএমএ গত ৪ জুন এ পরিস্থিতির দ্রুত উত্তরণের অনুরোধ জানিয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারকে চিঠি দিয়েছে।
ওই চিঠিতে সংগঠনটি গ্যাস-সংকটে প্রভাবিত শিল্প এলাকাগুলোর নাম উল্লেখ করে জানায়, সেখানে মিলগুলোতে গত এক মাস ধরে গ্যাসের চাপ ০ জিরো থেকে ২ এর মধ্যে। এর ফলে মিলগুলো চালু রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এছাড়া অনেক দামি মেশিনারিজও নষ্ট হচ্ছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, "এভাবে চলতে থাকলে মিলগুলো আর কতদিন চালু রাখা যাবে, তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।"
বিটিএমএ'র সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন টিবিএসকে বলেন, "এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে– শিল্পগুলোর পক্ষে অর্থনৈতিকভাবে এই ঘাটতি মেটানো আর সম্ভব হবে না। এমন অবস্থায়, তারা ব্যাংকের দেনাই বা কীভাবে শোধ করবে?"
গ্যাসের দাম বাড়লেও, নিশ্চিত হয়নি নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ
২০২৩ সালের শুরুতে শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম দ্বিগুণ বাড়ানো হয়। ওই সময়, দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ দেওয়ার লক্ষ্যেই দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু, শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে পাঠানো চিঠিতে বিটিএমএ সভাপতি বলেন, "২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সরকার গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে, কারখানায় নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহ করা হবে। কিন্তু গত এক বছর ধরে বর্ধিত বিল দিয়ে আসলেও, সরবরাহ কখনোই কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি।"
টেক্সটাইল শিল্পের চতুর্মুখী সমস্যা
উদ্যোক্তারা বলছেন, একদিকে গ্যাসের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে গ্যাসের সংকট। আবার বহির্বিশ্বে পোশাকের চাহিদা কমায় টেক্সটাইল শিল্পেও অর্ডার কম, আবার পণ্যের দামও কম। চলমান ডলার সংকট এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পড়তি অবস্থার মধ্যে ব্যাংকগুলোও সময়মত আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খুলছে না।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু পোশাকের দাম কমিয়ে দিচ্ছে ক্রেতারা।"
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, "ব্রেক-ইভেন পয়েন্টে (না লাভ, না লোকসান) প্রতি ইউনিট পোশাকের মূল্য ২ ডলার ৫০ সেন্ট দেওয়ার পর– ওই বায়ারের কান্ট্রি ম্যানেজার সেখান থেকে ০.০৭ ডলার (৭ সেন্ট) কমানোর শর্ত দিয়েছে।"
"আবার ব্যাংকে এলসি খুলতে গেলে, খুলতে পারছি না। কাস্টমসের প্রতি পদে হয়রানি। এটি আমাদের জন্য এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ৮০ শতাংশ পোশাক কারখানা এখন আইসিউতে (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে) আছে। এদের একটি অংশ দীর্ঘমেয়াদে টিকতে পারবে না।"