ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর সামর্থ্য আছে কেবল চীনের
ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের ভূমিকায় ক্ষুদ্ধ পশ্চিমা নেতারা। বাণিজ্যের মাধ্যমে রাশিয়াকে যুদ্ধের জন্য দরকারি অর্থ দিচ্ছে বেইজিং। এই অবস্থায়, চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদানের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।
চীনের শক্তিকে দোষারোপের ক্ষেত্রে তাঁরা হয়তো কিছুক্ষেত্রে সঠিকই। বর্তমানে বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলোর মধ্যে একমাত্র চীনই রাশিয়াকে সহায়তা অব্যাহত রাখার মতো ঝুঁকি নিচ্ছে। বেইজিংয়ের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মস্কো। পশ্চিমাদের মতে, এই নির্ভরশীলতা বর্তমানে এতটা বেশি যে, বেইজিং চাইলে ভ্লাদিমির পুতিনকে যুদ্ধ বন্ধে রাজি করাতে পারবে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। এর কয়েক মাসের মধ্যেই মস্কো বুঝতে পারে, লড়াই তাঁদের পরিকল্পনামতো এগোচ্ছে না। এরপর যত দিন গড়ায় বেইজিংয়ের ওপর রুশ অর্থনীতির নির্ভরশীলতা ততো বাড়তে থাকে।
অন্যদিকে, ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া ইউরোপীয় দেশগুলোকে চাপ দিতে রাশিয়া গ্যাস রপ্তানি সীমিত করে। রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নও নিষেধাজ্ঞা দেয়। ফলত; ইউরোপে রাশিয়া থেকে গ্যাস রপ্তানি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অথচ যুদ্ধের আগে ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাসের চাহিদা মেটাতো মস্কো।
রাশিয়ান গ্যাসের বিকল্প হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য জায়গা থেকে গ্যাস আমদানি বাড়িয়েছে ইউরোপের প্রধান অর্থনীতিগুলো। একইসঙ্গে বিকল্প জ্বালানির দিকেও ঝুঁকেছে।
রাশিয়ার জ্বালানি থেকে সরে আসার প্রথমদিকে ইউরোপে জ্বালানির দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলেও, এখন তা সহনীয় অবস্থায় নেমে এসেছে। ফলে ইউরোপে বিদ্যুতের দামও ইউক্রেন যুদ্ধ-পূর্ব অবস্থার কাছাকাছি ফিরেছে। গ্যাসের দাম এখনও কিছুটা চড়া থাকলেও, তা আগের চেয়ে কম। চলতি বছরের শেষদিকে ইউরোপের গ্যাসের মজুত প্রায় পূর্ণ হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই অবস্থায়, নিজেদের বিপুল গ্যাস বিক্রি নিয়ে সমস্যায় পড়তে পারে রাশিয়া।
ইউরোপীয় রপ্তানিতে ধস এরমধ্যে রাশিয়ার ওপর প্রভাব ফেলেছে। ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি কোম্পানি গ্যাজপ্রম। এর আগে রাশিয়ার মোট আবগারি শুল্ক ও রাজস্বের প্রায় ১০ শতাংশ দিত এ প্রতিষ্ঠানটি।
তেল রপ্তানি থেকেও রাজস্ব কমেছে মস্কোর। পশ্চিমা দেশগুলোর জ্বালানি তেল ক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায়, অন্য দেশগুলোর কাছে কম দামে তা বিক্রি করতে হচ্ছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় পড়ার ভয়ে মূলধারার ট্যাংকার জাহাজ কোম্পানিগুলো রাশিয়ান তেল বহন করছে না। একারণে বিকল্প বহরের মাধ্যমে চীন ও রাশিয়ার মতো গন্তব্যে জ্বালানি তেল পরিবহনেও অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে।
গ্যাস রপ্তানি নিয়েও ভৌগলিক কারণে সমস্যার মধ্যে আছে রাশিয়া। স্থলপথে এই জ্বালানি রপ্তানির জন্য পাইপলাইন নির্মাণে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়। এশিয়ার চীনই হচ্ছে সম্ভাব্য বৃহৎ ক্রেতা, যার চাহিদা মেটাতে এ ধরনের পাইপলাইন নির্মাণ ব্যয় সঙ্গত। রাশিয়া ইউরোপে যে পরিমাণ গ্যাস রপ্তানি করতো, একই পরিমাণ বা তাঁর চেয়ে বেশি বেইজিংয়ের কাছে বিক্রি করতে পারলেই আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। এজন্য পাইপলাইন নির্মাণও করা হয়েছে। তবে রাশিয়ার গ্যাসের দামে বিপুল মূল্যছাড় চাইছে চীন।
এ ধরনের দর কষাকষির আলোচনায় ক্রেতা চীনই সুবিধেজনক অবস্থানে রয়েছে। কারণ, দেশটি চাইলে বিশ্বের যেকোন স্থান থেকেই গ্যাস কিনতে পারে। অন্যদিকে, বিপুল পরিমাণে রপ্তানির জন্য রাশিয়াকে একমাত্র চীনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এনিয়ে কালক্ষেপণের সুযোগও নেই মস্কোর। কারণ যুদ্ধ অর্থায়নের জন্য জরুরিভাবে তার বিপুল অর্থ দরকার। অন্যদিকে, জ্বালানি চাহিদা না মেটানোর মতো সংকটে নেই চীন।
অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে রাশিয়া। রাশিয়ার পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর ৫৪ শতাংশ (বৈদেশিক) বাণিজ্য হচ্ছে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে। পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়া নিষিদ্ধ হওয়ার পর ইউয়ানে বাণিজ্য করতে হচ্ছে তাঁদের। এখন চীনও যদি একইরকম নিষেধাজ্ঞা দেয়– তাহলে ইউয়ানকে প্রতিস্থাপন করার মতো বিকল্প মুদ্রাই থাকবে না রাশিয়ার কাছে।
যুদ্ধের জন্য অতিদরকারি উপকরণ হলো সেমিকন্ডাক্টর বা মাইক্রোচিপের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। সামরিক ও বেসামরিক উভয়কাজে ব্যবহার উপযোগী– মাইক্রোচিপের মতো এমন পণ্যগুলোকে ডুয়েল ইউজ বা দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য পণ্য বলা হয়। রাশিয়ার দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ৯০ শতাংশ পণ্যের সরবরাহকারী হচ্ছে চীন। ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য রাডার, সেন্সর ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ তৈরিতে এগুলো অপরিহার্য। এক্ষেত্রেও বিকল্প সরবরাহকারী নেই রাশিয়ার।
কেবল ইরান বা উ. কোরিয়াকে সাথে নিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। আলোচিত দুই দেশও রয়েছে পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কবলে। অন্যদিকে, একমাত্র চীনই রাশিয়ার প্রয়োজন-মাফিক যেকোনো পণ্য সরবরাহের সামর্থ্য রাখে।
এই অবস্থায়, রাশিয়াকে নিয়ে চীনের সাথে আলোচনার সুযোগ আছে পশ্চিমাদের সামনে। এই ধরনের সমঝোতা থেকে উভয় পক্ষই বিপুলভাবে লাভবান হতে পারবে।
চীন আভ্যন্তরীণ বেশকিছু অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাঁর শিল্পগুলোর অতি-উতপাদন সক্ষমতা এবং সে তুলনায়, নতুন ক্রেতা খুঁজে পাওয়ার সমস্যা।
বৈদ্যুতিক গাড়ি ও সোলার সেলের মতো বহু চীনা পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল শুল্ক আরোপ করছে। অন্যদিকে, ইউরোপেই কারখানা স্থাপন করে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন করতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ দিচ্ছে ইইউ। এ ধরনের উৎপাদনের জন্য তাঁদের প্রযুক্তিও বিনিময় করতে বলছে।
পশ্চিমা বিশ্ব চীনের ওপর অতি-নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি – বাণিজ্যে ছাড় দেওয়ার শর্ত হিসেবে, রাশিয়ার অবস্থান দুর্বল করে দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে বেইজিংকে।
চীনের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের বাজার ধরে রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার চীনের পরিবেশবান্ধব শিল্পের সক্ষমতা ও প্রযুক্তি জ্ঞান দরকার পশ্চিমাদের।
অর্থনৈতিকভাবেও ইউরোপ কঠিন এক সময় পার করছে। এই অবস্থায়, চীনা পণ্যে শুল্কারোপ ইউরোপের ভোক্তাদের জন্য পণ্যের মূল্যকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাড়াচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। তাই বাণিজ্যযুদ্ধের রাশ টানলে উভয় পক্ষই লাভবান হবে। আপোষ করলে চীনের থেকে অভাবনীয় এক প্রস্তাবও পেয়ে যেতে পারে পশ্চিমারা।
বলতে গেলে সবদিক থেকেই এখন রাশিয়াকে সচল রেখেছে চীন। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর মতো প্রভাব ও শক্তি তার আছে।
লেখক: রেঁনে ফুকো যুক্তরাজ্যের ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।