কারখানা, বন্দর ও ইন্টারনেট চালু হওয়ায় আবারো আশার আলো দেখছেন রপ্তানিকারকরা
কারফিউ শিথিল হওয়ায় বুধবার (২৪ জুলাই) পুরোদমে শুরু হয়েছে কারখানাগুলোর কার্যক্রম, ব্যাংকগুলোও খুলেছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সংযোগ ফেরার ঘটনাও চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমস প্রক্রিয়া আংশিকভাবে চালু করার সহায়ক হয়েছে। এতে পাঁচ দিন পর আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পুরোপুরি সচল হওয়ার আশা তৈরি হয়েছে।
এসব ঘটনা রপ্তানিকারকদের জন্য অনেকটা স্বস্তি দিয়েছে, যারা দেশে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাপ্রবাহের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এ সময়ে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে কাস্টমস ক্লিয়ারিং ও শিপিং লিঙ্ক ব্যাহত হওয়ায়বন্দরেও জমতে থাকে রপ্তানি না হওয়া পণ্যের চালান।
কোটাসংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের কবলে পড়ে বাংলাদেশ, যা নিয়ন্ত্রণে শুক্রবার মধ্যরাতে জারি করা হয় কারফিউ।
শিল্পের অভ্যন্তরীণরা বলছেন, বাকি বিশ্বের সাথে বাণিজ্য ও লেনদেনের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে পেরেছেন তারা, বৈশ্বিক ক্রেতারাও বুঝতে পেরেছেন সরবরাহে সাম্প্রতিক ব্যাঘাতের ঘটনা একটি দৈব দুর্বিপাক– যাতে বাংলাদেশের সরবরাহকারীদের কোনো দায় ছিল না।
কিছুক্ষেত্রে অবশ্য ক্রেতাদের নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহের জন্য এবং অর্ডার বাতিল হওয়া ঠেকাতে রপ্তানিকারকদের বিমানে চালান পাঠাতে হবে, যাকে নতুন চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্য অন্যতম বলেই উল্লেখ করেন তারা।
একয়দিনে কয়েক হাজার রপ্তানি চালান, যার প্রায় ৮০ শতাংশই পোশাক পণ্যের আটকা পড়েছিল দেশের প্রধান বন্দরে। একইভাবে বিপুল সংখ্যক আমদানির কনটেইনারও আটকা পড়ে।
পোশাক পণ্য থেকে শুরু করে টেক্সটাইল, সিরামিক, ইস্পাত ও সিমেন্টের মতো শিল্পকে বিপুল লোকসান গুনতে হয়েছে, দৈনিক যার পরিমাণ ১,৬০০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ।
এমতাবস্থায় সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সাথে এক সভায় ব্যবসায়ী নেতারা কারখানা চালু রাখার জন্য দ্রুত ইন্টারনেট সংযোগ ফিরিয়ে আনা এবং কারফিউ শিথিল করতে অনুরোধ করেন।
এরপর কারফিউ ধীরে ধীরে শিথিল হতেও শুরু করেছে, গতকাল ৭ ঘণ্টা্র জন্য তা হয়েছিল; শিল্পাঞ্চলগুলোর নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়। যা শিল্প ও ব্যবসার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। এর ফলে গত সপ্তাহের ব্যবসায়িক ক্ষতি ও সরবরাহ চক্রের ব্যাঘাত কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে আশাবাদী হয়েছেন রপ্তানিকারকরা।
পোশাক খাতের জন্য বড় স্বস্তি
দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাকপণ্য রপ্তানিকারক ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার টিবিএসকে বলেন, 'আমরা আমদানি-রপ্তানি করতে পারছি, সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে বলে মনে হচ্ছে। এখন যদি ইউটিলিটি (গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট প্রভৃতি) সেবাগুলো স্থিতিশীল থাকে, তাহলে আমরা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারব বলে মনে করি।'
বন্দর কার্যক্রমেও অচলাবস্থা থেকে উন্নতির আভাস মিলছে। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের জেরে টানা পাঁচদিন আমদানি ও রপ্তানির কার্গো হ্যান্ডলিং বন্ধ থাকার পরে– মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ১,৫০০ টিইইউ এবং গতকালকে প্রায় ২ হাজার টিইইউ হ্যান্ডলিং করেছে। কাস্টমস ও বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, দিনে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টিইইউ হ্যান্ডলিংয়ের স্বাভাবিক সময়ের সক্ষমতায় ফিরতে তাঁদের আরও কয়েকদিন লাগবে।
ইপিজেডে বৃহত্তম স্থানীয় বিনিয়োগকারী প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর বলেন, ইন্টারনেট সংযোগ ফেরার পরে– বায়ারদের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানাতে এখন তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে কীভাবে উৎপাদন ও পণ্য সরবরাহের ক্ষতি হয় সে সম্পর্কে তাঁদেরকে জানানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'বায়ারদের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক আছে, আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা কারণে হঠাৎ হওয়া এই ব্যাঘাতকে তারা ছাড় দিতে পারে।' রপ্তানির কার্যাদেশ (অর্ডার) বাতিল কোনো আশঙ্কা নেই জানিয়ে বলেন, "আশা করি, আমরা এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারব।'
তানভীর জানান, গত পাঁচদিনে কারখানা বন্ধ থাকায় প্যাসিফিক জিন্সের উৎপাদনে প্রায় ১ কোটি ডলার (১০ মিলিয়ন) এর ক্ষতি হয়েছে। এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য কোম্পানিকে তার আগের পরিকল্পনাও সংশোধন করতে হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, 'এই ব্যাকলগের কারণে শুধু এসব পণ্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ উৎপাদন পরিকল্পনাও প্রভাবিত হয়েছে। সাপ্লাই চেইনকে স্বাভাবিক করে আগের অবস্থায় আনতে অন্তত আরও দুই মাস সময় লাগবে।'
'তবে আমার আশঙ্কার কারণ হলো, এর মধ্যে কিছু পণ্য হয়তো এয়ার-শিপমেন্ট করতে হবে। চালান পাঠাতে দেরি হওয়ার কারণে কিছু পণ্যের জন্য বায়াররা ডিসকাউন্ট (মূল্যছাড়) চাইতে পারে।'
টিএডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ও অন্যান্য প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বায়াররা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন। 'ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময়টা আমরা ফোনকল ও এসএমএসের মাধ্যমে সব বায়ারের সাথে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করেছি।'
ইন্টারনেট চালু হওয়ার পরে উভয় পক্ষই – যেসব ইমেইল পাঠানো সম্ভব হয়নি সেগুলো আবার পাঠাচ্ছে। আশিকুর রহমান আশা করেন যে, আগামী দুই থেকে তিনদিনের মধ্যেই বায়ারদের সার্বিক উৎপাদন ও রপ্তানি চালানের পরিস্থিতি সম্পর্কে 'আপডেটেড' তথ্যপ্রদান করা সম্ভব হবে।
নিজস্ব বায়িং হাউজের মাধ্যমে টিএডি গ্রুপ প্রতিমাসে প্রায় ৭০ লাখ পিস পোশাকপণ্য রপ্তানি করে। কারখানা বন্ধ থাকায় প্রায় ১৫ লাখ পিসের চালান বিলম্বিত হতে পারে।
তানভীরের সাথে একমত পোষণ করে তুহিন জানান, এসব পণ্য আগামী শীত মৌসুমের শেষ সময়ের জন্য, যেগুলো বিমানে করে পাঠাতে বিপুল ভাড়া গুনতে হবে। তা না করলে, ওই মৌসুমের ব্যবসা পুরোটাই হারাবেন তারা।
বিজিএমইএ'র এই পরিচালক বলেছেন, 'আমরা আশা করছি, আগামী বছরের (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) শীতের মৌসুমের (অর্ডারের) জন্য আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই যোগাযোগ শুরু করতে পারব, কারণ জুলাই-আগস্ট হচ্ছে এ মৌসুমের অর্ডারের সময়।'
নিটওয়্যার রপ্তানিকারক এবং ফতুল্লাহ গার্মেন্টসের প্রধান নির্বাহী ফজলে শামীম এহসান জানান, উৎপাদনে ক্ষতির পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জোটের সম্মুখীনও হতে পারেন রপ্তানিকারকরা। একারণে বায়াররা বিমানে চালান পাঠানোর জন্য চাপ দিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বিকেএমইএ'র সহসভাপতি এহসান আরও জানান, আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের সম্ভাব্য ওভারলোডের কারণে আগামী বছরের শীত মৌসুমের পোশাক পণ্যের নমুনা পাঠাতেও প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছেন রপ্তানিকারকরা। অথচ সময়মতো এসব নমুনা পাঠাতে না পারলে, আগামী শীত মৌসুমের জন্য কার্যাদেশও খুব কম পাওয়া যাবে।
বন্দরে জট কাটাতে লাগবে অন্তত এক সপ্তাহ
ইন্টারনেট সংযোগ আংশিক ফেরার পরে বুধবার সকাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ও শুল্ক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। বন্দরে ডেলিভারি কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে।
তবে ইন্টারনেট পুরোমাত্রায় সচল না থাকার কারণে সিঅ্যান্ডএফ ও শিপিং এজেন্টসহ রপ্তানি সংশ্লিষ্ট অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিসও আংশিক খোলা রাখা হয়, এতে সমস্যায় পড়েন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে কাস্টমস অফিসের মাত্র চারটি কম্পিউটারে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করতে পারছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা।
বন্দর ও কাস্টমসের কর্মকর্তাদের ধারণা, বন্দরে কনটেইনার জট কাটিয়ে উঠতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, বুধবার সকাল থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরের ওয়ান স্টপ সার্ভিস কার্যক্রম চালু হয়। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের শুল্কায়ন শেষে আউটপাস নিয়ে এলেই বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তিনটি টর্মিনালের ইয়ার্ড থেকে প্রতিদিন স্বাভাবিক সময়ে ৩,৫০০ থেকে ৪,৫০০ টিইইউ কনটেইনার ডেলিভারি হয়। শুক্রবার থেকে এই সংখ্যা প্রায় শূণ্যের কোটায় নেমে আসে। এমন পরিস্থিতিতে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ম্যানুয়ালি শুল্কায়ন শুরু করায়– মঙ্গলবার ১,৫০০ আমদানি কনটেইনার বন্দর থেকে ডেলিভারি হয়েছে বলে জানিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রতিদিন ২ হাজার আমদানি পণ্যের বিল অব এন্ট্রি এবং ৫ হাজার রপ্তানি পণ্যের বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল হয়। সিএন্ডএফ এজেন্টরা তাদের নিজেদের অফিস থেকে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারে এসব বিল দখিল করেন।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার ইমাম গাজ্জালি টিবিএসকে বলেন, ব্যবসায়ীরা এখন আমদানি ও রপ্তানির সকল পণ্য খালাস করতে পারছেন। কারো পে অর্ডার ও চালান না থাকলে– আমরা অঙ্গীকারনামা নিয়ে মাল খালাস করতে দিচ্ছি।
তিনি বলেন, বুধবার থেকে পুরোদমে চালু হয়েছে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্কায়ন। যেসব পণ্যের বিল অব এন্ট্রি আগে দাখিল করা হয়েছে, কাস্টমস কর্মকর্তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেগুলোর শুল্কায়ন সম্পন্ন করছেন। সিএন্ডএফ এজেন্টদের অফিসে পুরোপুরি ইন্টারনেট চালু না হওয়ায় – কাস্টমস কয়েকটি কম্পিউটারে অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যার একসেস দিয়েছে। সেখানে সিএন্ডএফ এজেন্টরা বিল অব এন্ট্রি এবং বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল করতে পারছে।