ছড়িয়ে পড়েছে ডাকাতি, ছিনতাই, চুরির খবর, আতঙ্কে ঢাকাবাসী
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর সোমবার (৫ আগস্ট) থেকেই নিজেদের ওপর হামলার আশঙ্কায় পুলিশের গা-ঢাকা দেওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। পরদিন মঙ্গলবার থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ডাকাতি-ছিনতাই এর খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফলে ঢাকা হয়ে ওঠে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার নগরী। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বেশিরভাগ ডাকাতি-ছিনতাইয়ের তথ্যই গুজব।
গত দুই দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক হারে ঢাকার উত্তরা, মিরপুর, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের খবর ছড়িয়ে পরে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ঢাকার সব এলাকায় মানুষ।
আতঙ্কে পাড়া-মহল্লায় মসজিদের মাইকে গভীর রাতে বাসিন্দাদের সতর্ক করা শুরু হয়। বাসিন্দারা দলে দলে সে সময় ডাকাত ধরতে রাস্তায় নেমে আসেন। এসব ঘটনায় কয়েকটি জায়গায় স্থানীয়রা গভীর রাতে সন্দেহভাজন হিসেবে কয়েকজনকে আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলেও দেন। স্থানীয়রা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং 'ডাকাতদের' ধরতে পাহারা দেওয়ার জন্য দল গঠন করেন।
বুধবার (৭ আগস্ট) রাতে ইসিবি চত্বর, উত্তরা ও মিরপুর ১১ এলাকা থেকে স্থানীয়রা আগ্নেয়াস্ত্র ও স্থানীয়ভাবে তৈরি অস্ত্রসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন।
তবে গুলশান, উত্তর বাড্ডা, শাহজাদপুর, নতুন বাজার, বারিধারা, নর্দা ও বসুন্ধরা এলাকায় ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এসব এলাকা আবাসিক এবং কমিউনিটি নিরাপত্তা রক্ষী ও স্থানীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকায় ডাকাতির শিকার হয়নি।
ইসিবি চত্বরে জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব
রাজধানীর ইসিবি চত্বরের কাছাকাছি একটি খালি জমি দখল নিয়ে দুটি ডেভেলপার কোম্পানির মধ্যে বিরোধ ছিল। বুধবার মধ্যরাতে দিকে তারা জমিটি দখল করতে চায়। তখন দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
এতে এলাকাবাসী ডাকাত এসেছে মনে করে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। আবার অন্যদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীও চলে আসে।
'এতে যারা জমি দখলে আসে—প্রায় ১৫০-২০০ জন হবে—তারা বাঁচার জন্য এদিক-সেদিক দৌড়ে পালিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে পড়ে। তবে দুইজন ধরা পড়ে যায়। তাদেরকে গণধোলাই দিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়,' জানান ইসিবি চত্বরের মানিকদি নামাপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. ইমরান।
এরপরে দখল করতে আসা লোকজন যেসব এলাকায় ঢুকে পরে সেসব এলাকায় তাদের ডাকাত ভেবে মসজিদের মাইকে ঘোষনা দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে আশেপাশে সকল এলাকায় এর রেশ ছড়ীয়ে পরে, তিনি যোগ করেন।
আরেক বাসিন্দা মিরাজ হাসান বলেন, 'আমরা শুনেছি ডাকাত এসেছে। সাথে সাথে বাইরে বের হই। গোলাগুলিরও শব্দ শুনেছি। তবে আমরা ডাকাত দেখিনি। পরে সেনাবাহিনী এসে তাদের কয়েকজনকে আটক করে।'
বেশিরভাগ মানুষ শুনেছে ডাকাত এসেছে, তবে দেখেনি
ঢাকায় ডাকাতের ঘটনা ছড়িয়ে পড়া হটস্পটগুলো ঘুরে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পায়নি টিবিএস। এমনকি কোনো নির্দিষ্ট বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, এমন কোনো বাড়িও পাওয়া যায়নি।
আবার একই এলাকার ভিন্ন ভিন্ন লোক ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছে। এমনকি একই এলাকায় কোথায় ডাকাতি হয়েছে, সে প্রশ্নেও পাওয়া গেছে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর।
সবার একটা তথ্যে শুধু একটি মিল ছিল—'আমরা মাইকে ঘোষণা শুনেছি'।
রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন বলেন, 'আমরা শুনেছি কালকে ডাকাত পড়েছিল। তবে ডাকাতের উপস্থিতি নিজের কানে শুনি নাই, দেখিও নাই।'
মিরপুর ১১ নম্বরের বাসিন্দা ক্যাথরিন ইলোরা বলেন, 'রাতে আড়াইটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত মাইকে কয়েকবার ডাকাত আসার কথা ঘোষণা দিয়েছে। তাই আমরা রাতে ঘুমাইনি। আমাদের বিল্ডিংয়ের একজন ব্যালকনি থেকে ৮-১০ জনকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখেছে। তারাই ডাকাত কি না জানি না। তবে আমরা কেউ দেখিনি।'
উত্তরা ১১-র বাসিন্দা অনিক বলেন, 'আমাদের ওখানেও মাইকিং হয়েছে। আমরা সবাই বাইরে বের হয়ে এসেছিলাম। তবে আমরা কোনো ডাকাত দেখিনি। শুনেছি ২০ নম্বর রোডে কয়েকজনকে আটক করেছে, তবে সে সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত নই।'
উত্তরা ১১-র ২০ নম্বর রোডে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে কোনো ডাকাতি হয়নি বা কাউকে আটক করা হয়নি। তবে তারা বলেন, ৯ নম্বর রোডে ডাকাতি হয়েছে।
৯ নম্বর রোডে গিয়েও ডাকাতি হওয়ার কোনো তথ্য জানা যায়নি। সেখানকার বাসিন্দারা বলেন, আজিমপুর কাঁচাবাজারে কিছু ডাকাতি হয়েছে। তাদের কথামতো কাঁচাবাজারেও গিয়েও ডাকাতির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
মিরপুরেও স্থানীয়দের ভিন্ন ভিন্ন তথ্যে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ডাকাত আসার বা কোনো নির্দিষ্ট বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে—এমন কিছু পাওয়া যায়নি।
আটক অনেক সন্দহভাজন
ঢাকা উদ্যানের বাসিন্দা রিকশাচালক মোকাররম হোসেন বলেন, 'গত দুই দিন আমরা সারা রাত জেগে পাহারা দিয়েছি। গতকাল রাতে ঢাকা উদ্যান নবীনগর ৭ নং রোড থেকে সন্দেহভাজন দুইজনকে আমরা আটক করি। তাদের কাছে বড় দুটি ছুরি পাওয়া গেছে। আটককৃতরা জানিয়েছে, তারা ছিনতাইয়ের জন্য বেরিয়েছিল। পরে তাদেরকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছি।'
মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং সোসাইটির ম্যানেজার মিজান বলেন, 'ডাকাতির আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে গতকাল রাতে এলাকার শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় ১০০ জন মিলে আমরা এলাকা পাহারা দিয়েছি। এখানে গতকাল রাতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটেনি। তবে শিক্ষার্থীরা শিয়া মসজিদ এলাকা থেকে সন্দেহভাজন একজনকে ধরে এনে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়।'
মিরপুর ১২ বি ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ একরাম বলেন, 'রাতে আমরা ডাকাত সন্দেহে একদল লোককে ধাওয়া দিয়েছি। তারা প্রায় ৫০ জনের কাছাকাছি হবে। তাদের হাতে চাপাতি ছিল। পরে তাদের চারজন ধরা পড়ে। তাদেরকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।'
এছাড়া উত্তরায়ও চারজনকে আটক করা হয়।
পুলিশবিহীন ঢাকায় ডাকাতি-ছিনতাই বেড়েছে
একটি বেসরাকি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সুমন হাওলাদার জানান, বুধবার সন্ধায় রায়েরবাজারে ৫-৬ জন তরুণ তার রিকশা থামিয়ে তার মানিব্যাগ, মোবাইল নিয়ে যায়। বাসার জন্য কিছু বাজার নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, তা-ও রেখে দেয় ছিনতাইকারীরা।
মোহাম্মদপুর বসিলার বাসিন্দা মোবারক হোসেন টিবিএসকে বলেন, বসিলার ওয়েস্ট ধানমন্ডি হাউজিংয়ে ডাকাতি ও লুটপাটের চেষ্টা হয়েছে, তবে এলাকাবাসীর প্রতিরোধের কারণে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।
এর আগে মঙ্গলবার নবোদয় হাউজিংয়ের একটি বাড়িতে ডাকাতির বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয়রা। পাশেই শ্যামলী হাউজিং আবাসিক এলাকায় স্থানীয় মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ নেতা হাজী জামালের বাড়ি ও খামার লুট হয়েছে।
একই দিন রাতে মিরপুর শ্যাওড়াপাড়ায় তিনটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।