ছিনতাই, খুন ও কিশোর গ্যাংয়ের দাপটে তটস্থ মোহাম্মদপুর
গত ২১ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অস্ত্রের মুখে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন এক তরুণী। এ ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
ফুটেজে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে নবোদয় হাউজিং এলাকায় কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একজন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণী। হঠাৎ পেছন থেকে কয়েকজন তরুণ দৌড়ে এসে তার পথরোধ করে।
চাপাতি বের করে কথা বলতে বলতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওই তরুণীর ব্যাগ টানাটানি শুরু হয়। তরুণী ব্যাগটি না ছাড়ায় তার হাতে কোপ দেওয়া হয়।
এক পর্যায়ে সব ফেলে দৌড়ে ঘটনাস্থল থেকে পালান ওই তরুণী।
ছিনতাইয়ের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দিনের বেলায়ও একা ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন নারীরা।
মোহাম্মদপুরে ৫ আগস্ট থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। এ এলাকায় অপরাধ, বিশেষত ছিনতাই ও খুনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।
গত পাঁচ আগস্টের পরে থেকে এ পর্যন্ত মোহাম্মদপুরে খুন হয়েছেন ১০ জন। অভিযোগ উঠেছে, এসব খুনের নেপথ্য কারণ আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও বাজার দখল। প্রকাশ্যে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া, গোলাগুলি এই একালায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। বিশেষ করে চাঁদ উদ্যান, বসিলা এবং রিং রোড এলাকার মতো মোহাম্মদপুরের উপকণ্ঠের অঞ্চলগুলোতে এ আতঙ্ক বেশি। সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হতে হলে মানুষ মূল্যবান জিনিস, যেমন মোবাইল ফোন, ব্যাংক কার্ড ও বেশি টাকা সঙ্গে না রাখার চেষ্টা করেন।
গত ২০ অক্টোবর সকালে মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেডে দিনদুপুরে নেসলে কোম্পানির গাড়ি আটকে অস্ত্রের মুখে ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ছিনতাই করে ছয় দুর্বৃত্ত।
এর আগে ১১ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাতদল এক ব্যবসায়ীর বাসায় ঢুকে সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে।
২৪ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের বসিলা ৪০ ফুট এলাকার একটি মুদি দোকানে ঢুকে ধারালো অস্ত্রের মুখে দোকানিকে জিম্মি করে দুষ্কৃতকারীরা ক্যাশের সব টাকা নিয়ে যায়।
গত ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মুখে হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর হয় থেকেই থানাগুলোতে পুলিশ সদস্যদের অনুপস্থিতির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। পরবর্তীতে পুলিশ বাহিনী ফিরে এলেও পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।
সম্প্রতি জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এলাকায় পুলিশ, র্যাবের পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প।
মোহাম্মদপুরের মাদক কারবার এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে গত এক সপ্তাহের বিশেষ অভিযানে
মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকার বাসিন্দা খন্দকার রাফি জানান, গত ১৯ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তার মেস বাসার তিন সদস্য হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ করে পেছন থেকে ৯-১০ জন অল্প বয়সী ছেলে বড় ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। এসময় তাদের কাছে থাকা দুটি মোবাইল ফোন ও পকেটে থাকা প্রায় ৯ হাজার টাকাসহ সবকিছু কেড়ে পালিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, লোকবল ও টহল ভ্যান সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।
পর্যাপ্ত লোকবল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পেলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যাবে বলে উল্লেখ করেন তারা।
মোহাম্মদপুরের মাদক কারবার ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে গত এক সপ্তাহের বিশেষ অভিযানে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী।
বেশিরভাগ ছিনতাই উপকণ্ঠে, 'মোগল এলাকা' তুলনামূলক নিরাপদ
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোড, তাজমহল রোড, শেরশাহ সুরী রোডসহ মোগল সাম্রাজ্যের নামে থাকা আবাসিক এলাকা ও সড়কে পুলিশ ও অনান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নজরদারি বেশি থাকায় তুলনামূলকভাবে ছিনতাইয়ের উৎপাত কম।
অন্যদিকে চাঁদ উদ্যান, চন্দ্রিমা হাউজিং ও রিং রোডের পরের এলাকা ও বসিলায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সাকলায়েন রিজভী বলেন, মোহাম্মদপুরের কেন্দ্রে ও ধানমন্ডি-লালমাটিয়ার আশপাশের এলাকাগুলোতে তুলনামূলক ছিনতাইয়ের প্রকোপ কম।
তবে চাঁদ উদ্যান, চন্দ্রিমা হাউজিং ও রিং রোডের পরের এলাকা ও বসিলায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি। এসব এলাকায় অনেকে সন্ধ্যার পর হাঁটতেও ভয় পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
গত দুই সপ্তাহে সোয়ারিঘাট বেড়িবাঁধ সড়ক, বেড়িবাঁধ চার রাস্তার মোড়, বসিলা ও গাবতলী সেতু এলাকায় দশটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
বসিলা এলাকার বাসিন্দা খন্দকার রাফি জানান, গত ১৯ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তার মেস বাসার তিনজন সদস্য হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ করে পেছন থেকে ৯-১০ জন অল্পবয়সি ছেলে বড় ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। এ সময় তাদের কাছে থাকা দুটি মোবাইল ফোন ও পকেটে থাকা প্রায় ৯ হাজার টাকাসহ সবকিছু কেড়ে পালিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভুক্তভোগী জানান, ১৮ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে বসিলা ৪০ ফিট এলাকায় রিকশায় করে যাওয়ার সময় কয়েকজন যুবক তাকে আটকে মোবাইল ও মানিব্যাগ কেড়ে নেয়।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হাসান বলেন, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারে তৎপর রয়েছে।
কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য
মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাং বেশ পুরোনো সমসযা। এ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বহু আগে থেকেই বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত।
স্থানীয়রা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে এসব কিশোর গ্যাং সদস্যরা ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকতো। ক্ষমতার পালাবদলে তারা রূপ পাল্টেছে। বর্তমানে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিতে জড়াচ্ছে তারা।
গত ২৭ অক্টোবর দিবাগত রাতে মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযানে নামে সেনাবাহিনী। অভিযানে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের ৪০ জনের মতো সদস্যকে ধারালো অস্ত্রসহ আটক করা হয়। আটকদের অনেকের হাতে ট্যাটু ছিল। এর মধ্যে কারও কারও হাতে ডাবল স্টার খোঁচানো ট্যাটুও দেখা যায়।
একের পর এক খুন
গত ২০ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার বধ্যভূমিসংলগ্ন বেড়িবাঁধে দুই পক্ষের ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার মধ্যে নাসির বিশ্বাস (২৯) ও মুন্না (২২) নামে দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তারা একই গ্রুপের সদস্য ছিলেন।
নাসির পেশায় রাজমিস্ত্রি। বিগত সরকারের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে নাসির মোহাম্মদপুর-হাজারীবাগ এলাকায় আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে পরিচিত। পুলিশ বলছে, এই পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবজি ও মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন নাসির।
মুন্না মাদক, নাশকতাসহ অন্তত ৮টি এবং নাসির দুটি মাদক মামলার আসামি।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তিন দিন পর একটি মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর থানায়। সেই মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলা দায়েরের দিনই মিরাজ মোল্লা (২৩) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এছাড়া ১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিংয়ের কুপিয়ে হত্যা হয় বিল্লাল গাজীকে। বিল্লাল স্থানীয় আকাশ নীলা ওয়েস্টার্ন হাউজিংয়ের স্টাফ ছিলেন। তাকে হত্যার আগে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে গ্রীন ভিউ হাউজিং এলাকায় বাসায় ঢুকে শাহাদাত হোসেন নামে এক যুবককে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এছাড়া বসিলা ৪০ ফিটের আরাম হাউজিং এলাকায় হাত-পা বেঁধে সিএনজিচালক শাহরিয়ার আশিককে (২১) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মোহাম্মদপুরের আছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ইতিহাস
মোহাম্মদপুর দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর এই অংশে অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত। এই সন্ত্রাসীদের হাতেই রয়েছে এ এলাকার অপরাধমূলক কার্যকলাপের নিয়ন্ত্রণ।
ধারণা করা হয়, ১৯৯০-এর দশকে মোহাম্মদপুরে অপরাধমূলক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতেন কুখ্যাত সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম।
১৯৮৬ সালে ফার্মগেটের পূর্ব রাজাবাজারে নাজনীন স্কুলের সামনে মায়ের হাত ধরে থাকা যুবক শাকিলকে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে সুইডেন আসলামের অপরাধের ইতিহাস শুরু।
শাকিলকে হত্যার পাঁচ দিন পরই আধিপত্য বিস্তারের জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি হল এক রাতে দখল করেন। হল দখলের পর আসলাম নামটি আতঙ্কে পরিণত হয়।
এক ডজন হত্যাকাণ্ডের করে তিনি চলে যান সুইডেনে। এজন্য আসলামের নামের আগে যুক্ত হয় 'সুইডেন' শব্দটি।
পরে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। অন্তত ১২টি মামলা দায়ের করা হয় তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে সর্বশেষ মামলা ছিল ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ তেজগাঁওয়ে যুবলীগ নেতা গালিব হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে। ৩ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
অভিযোগ আছে, ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম পিচ্চি হেলাল ও সানজিদুল ইসলাম ইমন যৌথভাবে জেলে বসেই মোহাম্মদপুরের পরিবহন ও ফুটপাতে চাঁদাবাজি করতেন। হেলাল সম্প্রতি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মোহাম্মদপুরের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী হচ্ছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ জোসেফ। তার বড় ভাই মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সাবেক মহাপরিচালক; ছিলেন সেনাপ্রধানও।
পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট জোসেফ বড় ভাই হারিস আহমেদের হাত ধরে রাজনীতির মাঠে পা রাখেন। নব্বইয়ের দশকে জাতীয় পার্টি ছেড়ে হারিস যোগ দিয়েছিলেন যুবলীগে। তৎকালীন ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও হয়েছিলেন তিনি।
এরপর থেকে মোহাম্মদপুর-হাজারীবাগসহ আশপাশের এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন জোসেফ। যোগ দেন সুব্রত বাইনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আলোচিত সেভেন স্টার গ্রুপে।
সেভেন স্টার গ্রুপ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ নামে দুটি অপরাধী বাহিনী তখন পুরো ঢাকা নিয়ন্ত্রণ করত।
২০১৮ সালে রাষ্ট্রপতি সাধারণ ক্ষমার পর যাবজ্জীবন সাজা কমিয়ে দেওয়া হলে জোসেফকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।