পুলিশ ছাড়া কেমন চলছে জীবন
গত ৯ আগস্ট শুক্রবার বিকেলে মিন্টো রোডে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) প্রধান কার্যালয়ের সামনে এক যুবককে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
হাতে একটি প্ল্যাকার্ড ধরে কয়েক ঘন্টা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।
ডিএমপির প্রধান কার্যালয়ে কোনো পুলিশ অফিসার চোখে পড়েনি, প্রধান ফটকে ছিল তালা। প্রাঙ্গণ ফাঁকা।
ওই যুবকের হাতের প্ল্যাকার্ডে ইংরেজিতে লেখা ছিল: 'সেইভ পুলিশ, সেইভ বাংলাদেশ।' (পুলিশ বাঁচাও, বাংলাদেশ বাঁচাও)।
যুবকের নাম রনি, পড়াশোনা করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নরসিংদীর একটি কলেজে। তার হাতের প্ল্যাকার্ডে বাংলায় আরও লেখা: 'পুলিশ জনতা ভাই ভাই, দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় আপনাকে চাই।'
৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে পুলিশ বাহিনী পুরোপুরি দায়িত্ব পালন না করার প্রতিক্রিয়ায় রনির এই পদক্ষেপ।
দেশের অনেক থানা এখনও চালু হয়নি। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত বলে পরিচিত অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও আত্মগোপনে রয়েছেন।
গত কয়েকদিনে অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল রয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায়ই ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। অবশ্য এসব ডাকাতির অনেকগুলো খবরই পরে গুজব বলে জানা যায়।
পুলিশ যে এত ছাত্র মেরে ফেলল, তারপরও আপনি পুলিশের পক্ষে একা একা দাঁড়িয়ে আছেন কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে রনি বলেন, 'ভাই পুলিশ তো আমাকেও মেরেছে। এমন মার দিল, যতদিন বেঁচে আছি ভুলতে পারব না। কিন্ত এই বিপদের সময় পুলিশ তো দরকার।'
কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে পুলিশের দমন-পীড়ন সত্ত্বেও ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চল পর্যন্ত সর্বত্রই মানুষ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।
বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুসারে, রক্তক্ষয়ী এই আন্দোলনে দেশজুড়ে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। তাদের অনেকেই মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে। এছাড়া ৪০০টিরও বেশি থানায় হামলা হয়েছে, কয়েকটিতে আগুন দেওয়া হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকজনকে পিটিয়ে, থানা ও গাড়িতে আগুন দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
নতুন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. মায়নুল ইসলাম বলেছেন, তারা সহিংসতার সময় ৪২ জন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার খবর পেয়েছেন।
এসব ঘটনা পুলিশের মধ্যে ভীতি ও ট্রমা তৈরি করে। এছাড়া শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান।
পুলিশ ও জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসও তৈরি হয়েছে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সব থানা অন্তত চার দিন বন্ধ ছিল। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রাস্তায় ছিলেন না ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।
কিন্তু পুলিশ ছাড়া জীবন কেমন চলছে?
মিরপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ আবদুল কাদের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সম্ভাব্য ডাকাত হামলা থেকে রক্ষা পেতে মিরপুর-৬ এলাকার গলিগুলোতে বাসিন্দাদের সারারাত জেগে থাকতে হয়।
তিনি বলেন, '৫ আগস্ট থেকে আমরা প্রতি রাতে রাস্তায় নেমেছি। মানুষ গান গেয়ে ও ক্রিকেট খেলে রাত কাটায়, কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। পুলিশ সদস্যদেরকে নিজ দায়িত্বে ফিরে যেতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'পুলিশ ছাড়া সমাজ ঠিকভাবে চলতে পারে না। শিক্ষার্থীরা কতদিন ট্রাফিক ব্যবস্থা পরিচালনা করতে পারবে?'
শনিবার সাংবাদিক রাফসান গালিব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছেন, 'শুধু ছাত্রজনতা হত্যা না, পুলিশ সদস্য হত্যার বিচারও করতে হবে। হত্যাকাণ্ড হত্যাকাণ্ডই, সেটি যে-ই করুক, যে-ই শিকার হোক।'
'সরকারি বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করার জন্য সাধারণ পুলিশ সদস্যরা দায়ী নয়। যাদের আদেশে এত পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।'
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মোহাম্মদপুর ট্রাফিক জোনের সহকারী কমিশনার বায়েজিদুর রহমান তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, 'সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পত্রিকা সবখানেই শুধু ছাত্রজনতার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের সফলতা। জরুরি লেন, অ্যাম্বুলেন্সের জন্য আলাদা লেন এগুলি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। রাতের বেলা প্রতিটা এলাকায় যে সংঘবদ্ধ ডাকাতি হচ্ছে সেটা অবশ্য কেউ বলে না।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তরার একজন বাসিন্দা বলেন, তার গাড়ি থামিয়ে অন্তত চারটি মোড়ে শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবকরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তল্লাশি করেছেন।
তিনি বলেন 'শিক্ষার্থীরা সরল বিশ্বাসে স্বেচ্ছায় কাজ করছে, কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের রাস্তায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এক কিলোমিটারের মধ্যে কতবার চেক করবেন?'
পুলিশের চেইন অভ কমান্ড ভেঙে পড়েছে। এর মধ্যেই নিচের ও মধ্যম পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তারা বাহিনীর সংস্কার ও একে রাজনীতিকরণ থেকে রক্ষা করতে ১১ দফা দাবি তুলেছেন।
শুক্রবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাইনুল হাসান টিবিএসকে বলেন, তারা পুলিশকে সক্রিয় করতে এবং জনসাধারণের সুরক্ষার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।
পুলিশ স্টাফ কলেজের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. সোহেল রানা টিবিএসকে বলেন, 'আমরা সবাই জনবান্ধব পুলিশ চাচ্ছি। কিন্তু শিকল-বন্ধন থেকে পুলিশকে মুক্ত করার বিষয়ে জোরালো আওয়াজ তুলছি না। পুলিশের দোষ খুঁজতে যতটা তৎপরতা, সমস্যা সমাধানে পুলিশের পাশে দাঁড়ানোর উদাহরণ ততটা চোখে পড়ছে না'
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
তিনি বলেন, 'দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং পুলিশকে কাজে ফেরানোর বিষয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা হয়েছে।'
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা জোর দিয়ে বলেন, আইনশৃঙ্খলা ছাড়া দেশের কোনোকিছুই ঠিকভাবে চলবে না।
তিনি বলেন, 'অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে, এবং সরকার বা কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।
'কাজটি দ্রুত করা দরকার। নইলে মানুষ হতাশ হয়ে পড়তে পারে। রাস্তায় কর্তৃত্বপক্ষের দৃশ্যমান প্রতীক থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'