১৫ বছর ওয়াসাকে নিয়ে খেলেছেন তাকসিম, অবশেষে 'গ্রাসমুক্ত'
১৪ বছর ১০ মাস ১ দিন পর ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের কাছ থেকে মুক্ত হলো ঢাকা ওয়াসা। ২০১৩ সালে তিনি সপ্তমবারের মতো নিয়োগ পেয়ে এ পদ দখল করে বসে ছিলেন এতোদিন। গত বুধবার শারীরিক অসুস্থাতার কথা বলে পদত্যাগ পত্র জমা দেন তিনি। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার তার নিয়োগ বাতিলের নোটিশ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ না পাওয়া পর্যন্ত ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) প্রকৌশলী এ কে এম শহিদ উদ্দিন এমডির দায়িত্ব পালন করবেন। শহিদ উদ্দিন দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বৃহস্পতিবারই আমি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ঢাকা ওয়াসার সিনিয়র ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে যোগদানের বিষয়ে চেয়ারম্যানকে চিঠি লিখেছি। আজ থেকেই আমি দায়িত্ব পালন শুরু করেছি। পরে, মন্ত্রণালয় নতুন এমডি নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত আমি এমডির দায়িত্ব পালন করব।"
তবে তাকসেম এ খান দাবি করছেন তিনি বুধবারই তার পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। ঢাকা ওয়াসার এমডি স্টাফ অফিসার ও নির্বাহী প্রকৌশলী বদরুল আলম বলেন, "বুধবার শারীরিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে তাকসিম মন্ত্রণালয়ে তার পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন।"
২০২৩ সালে তাকসিমকে ৭ম বারের মতো তিন বছরের নতুন মেয়াদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরই প্রথমবারের মতো তিনি এই পদে নিয়োগ পান। তাকে একই পদে ১৪ বছর পুনর্বহাল রাখায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। তার বিরুদ্ধে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতিরও অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, শেষ বার যখন তিনি কাজ করেছেন তিনি কার্যালয়েই আসেননি। তিনি ভার্চুয়ালি মিটিং করেছেন এমন-কী অনৈতিক নিয়োগও দিয়েছেন। তার মেয়াদেই ১৬ বার পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। ২০০৯ সালে ওয়াসার পানির দাম ছিল প্রতি ইউনিট (১,০০০ লিটার) ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। সেই পানির দান এখনর ১৬ টাকা ৭০ পয়সায়।
ঢাকা ওয়াসা যেভাবে টিকে ছিল
তাকসিম এ খান অনিয়ম-দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে ওয়াসাকে ডুবিয়েছেন। টানা ১৫ বছর এমডি পদে থেকে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি নিজের পকেট ভারি করেছেন। ওয়াসা এখন বিদেশি ঋণের জর্জরিত। ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, তাদের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।
তাকসিমের সময়কালে, বিদেশি ঋণের অর্থে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করে ওয়াসা। ফলে ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধ করতে এখন বিশাল পরিমাণ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণের পরিমাণ ২৫,০০০ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু প্রকল্পের ধীরগতির বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়নের পর তা চালু করতে না পারায় সংস্থার ব্যয় বেড়েছে।
২০১৯ সালে ঢাকাবাসীর পানির চাহিদা মেটাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'পদ্মা-জশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প' উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের সময় জানানো হয় যে, এই পানি শোধনাগার থেকে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওয়াসা এই পরিমাণ পানি সরবরাহের কোনো রেকর্ড দেখাতে পারেনি। ওয়াসা কাগজে ২৮ কোটি লিটার দেখালেও বাস্তবে সরবরাহ হচ্ছে ২২ কোটি লিটার। ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে মাত্র ২২ কোটি লিটার পানি পাওয়া যাচ্ছে।
গত ১৫ বছরে ওয়াসার ওপর তাকসিমের একক ক্ষমতা ছিল। ওয়াসা আইনের অধীনে, বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা ওয়াসা পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাকসিম বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে ঢাকা ওয়াসা পরিচালনা করেছেন। বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল।
পরে মন্ত্রণালয়ে তাকসিমের বিরুদ্ধে অনিয়ম, অপচয় এবং দুর্নীতির অভিযোগ করার হলে সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ওয়াসা এমডি ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেছিলেন এবং এখন তিনি ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেতন ও বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণ করছেন।
ঢাকার ২৬ টি খালের দায়িত্বে ছিল ঢাকা ওয়াসা। সেসময় তাদের দুটি প্রকল্প চলমান ছিল। কিন্তু কয়েক ধাপে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়েও প্রকল্প দুটি শেষ করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা।
২০২০ পর্যন্ত ৬৪৫.৫১ কোটি টাকার "হাজারীবাগ, বৈশতেকী, কুর্মিটোলা, বেগুনবাড়ি এবং মান্ডা খালগুলোর ভূমি অধিগ্রহণ এবং পুনঃখনন প্রকল্প"র মাত্র ৩৯.০৯ কোটি টাকা এবং "ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং খাল উন্নয়ন" প্রকল্পের ৫৫০.৫০ টাকার মধ্যে ১৩৬.৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়।
এ টাকার অধিকাংশ ব্যয় হয়েছে প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাতা, সার্ভে ও বিভিন্ন মাঠকর্মে।
দুদক'র পাঠানো নোটিশকে গুরুত্ব দেয়নি এলজিআরডি মন্ত্রণালয়
২০১৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকা ওয়াসার এমডি ও প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে অনুসন্ধান করে এলজিআরডি মন্ত্রনালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগে বেশ কয়েকটি চিঠি পাঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেখানে তাকসিমের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে উল্লেখ ছিল।
দুদক'র নোটিশ পাঠানো সত্বেও তাকসিমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়। বরং দুই দফা তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। এমনকি ২০০৯ সালে তার নিয়োগ নিয়ে ছিল বিতর্ক। কারণ তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট থাকা সত্বেও তাকে ওয়াসার এমডি করা হয়েছে।
২০১৯ সালের আগস্টে দুদকের পাঠানো চিঠির জবাব দেয় এলজিআরডি মন্ত্রনালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে, তারা চিঠিতে জানান, দুদকের করা অভিযোগের কোনো প্রশাণ পাননি তারা।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকৌশলী এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জড়িত। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন হয় না এমনও অভিযোগ রয়েছে।
আর্থিক অনিয়মগুলোর মধ্যে রয়েছে, মিরপুরের ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা হ্রাসকরণ প্রকল্পের খরচ অযৌক্তিকভাবে ৫২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা অটুট রাখার স্বার্থে প্রতিদিন ৪০ কোটি লিটার অতিরিক্ত পানি সরবরাহ করার জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন, প্রতিস্থাপনম, রিজেনারেশন ও পানির লাইন নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালে নেওয়া ৬১২ কোটি টাকার প্রকল্পের যে কাজ হয়েছে সেই কাজের অগ্রগতির সাথে ঠিকাদারের পরিশোধিত বিলের অনেক পার্থক্য পায় দুদক।
'সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার (ফেইজ-৩) প্রকল্পে' ৪৫৯৭ কোটি ব্যয়ে জুলাই, ২০১৫ হতে জুন, ২০২০ মধ্যে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের কাজের তেমন কোন অগ্রগতি নেই।
দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পে' ৩৩১৭ কোটি টাকা ব্যয় হলেও ২০১৯ এর মধ্যে সমাপ্ত করার কথা ছিল। এখন কাজ শেষ হলেও এর সুবিধা পাচ্ছে না নগরবাসী। এমনকি এর সাথে সংযোগ লাইনও করেনি ঢাকা ওয়াসা।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরামর্শক ও ঠিকাদার ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট পদ্ধতি ও রাজনৈতিক পরিচয় এবং কাজ পাওয়ার বিনিময়ে ঘুষ লেনদেন বর্তমানে একটি প্রচলিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে স্পেশিফিকেশন ও ডিজাইন অনুযায়ী প্রকল্পকাজ যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় ব্যয়ভার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়।
ব্যক্তি মালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ওয়াসা এখনও ম্যানুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করায় প্রকৌশল ও রাজস্ব শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারীরা মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন, যার মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে বলে জানায় দুদক।
অনেক ক্ষেত্রে কিছু প্রভাবশালী কর্মচারী ওভারটাইম না করেও ওয়াসার কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ওভারটাইম বিল উত্তোলন করেন ফলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ঢাকা ওয়াসার কর্মচারীদের ওভারটাইম বিল অনেক বেশী বলে জানায় দুদক।