এত শিক্ষার্থীর মৃত্যুর মাঝেও ছেলেকে আন্দোলনে যেতে দিয়েছিলেন ফাতেমা
যেভাবে একজন সাহসী মা তার ছেলেকে যুদ্ধে পাঠায়, তেমনি ১৯ জুলাই ফাতেমা বেগম তার ছেলেকে অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পাঠিয়েছিলেন।
ফাতেমা বেগম স্মরণ করে বলেন, "সাগর যখন আন্দোলনে যাচ্ছিল তখন আমি যেতে বাধা দেইনি। মনে হলো, যখন এত শিক্ষার্থী মারা গেছে তখন আমার ছেলেকে ঘরে আটকে রেখে লাভ নেই।"
২২ বছর বয়সী সাগর হোসেন মোহম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ১৯ জুলাই (শুক্রবার) কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়ে রাজধানীর মোহম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হন। দুটি বুলেট তার শরীরে আঘাত হানে।
গুলি তার তলপেটের বাম পাশে লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। গুলিতে সাগরের পায়ের হাড়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রোববার (১৮ আগস্ট) সাগরকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়। তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরানো ছিল।
ফাতেমা টিবিএসকে বলেন, "আমার কোন অনুশোচনা নেই। আমি সর্বশক্তিমানের কাছে কৃতজ্ঞ যে সাগর বেঁচে গেছে।"
তিনি বলেন, "কোটা আন্দোলনে রংপুরে নিহত হওয়া আবু সাইদের মায়ের কান্না দেখেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে. আন্দোলনে সময় আবু সাঈদ যে কথা বলেছিল সেগুলোর ভিডিও দেখেছি। মনে হলো এত লোক মারা গেছে, এত শিক্ষার্থী মারা গেছে, আমার ছেলেকে ঘরে আটকে রেখে লাভ কি।"
সাগরের বন্ধু আবু রায়হান সেদিনের কথা স্মরণ করে বলেন, "আমরা ৮ থেকে ১০ জন বন্ধু দল বেধে মোহম্মদপুর এলাকায় বের হই। মোহম্মদপুর নুরজাহান রোডে বিকেল ৪টার দিকে কয়েকশ শিক্ষার্থী জড়ো হয়। তখন পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালালে, গুলি সাগরের গায়ে লাগে।"
সেদিন ঢাকা ব্যাপক সংঘর্ষের কারণে অচল হয়ে গিয়েছিল। কোটার সংস্কার আন্দোলনকারীরা তাদের নয় দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। রাতে কারফিউ জারি করা হয়, সেনা মোতায়েন করা হয় এবং ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর মোহম্মদপুরে একটি টিন সেটের বাসা ভাড়ায় থাকেন সাগর। টানাপোড়েনের সংসারে নিজের পড়ার খরচ চালানো ও পরিবারকে অর্থিকভাবে সহায়তা করতে খাবার ডেলিভারির কাজ করতেন তিনি।
ফাতেমা বেগম বলেন, ৮ হাজার টাকা ভাড়ায় মোহম্মদপুর শেখেরটেক এলাকায় একটি টিনসেট বাড়ির দুই রুমে পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। সবার বড় সাগরের দুজন ছোট বোন আছে।
তাদের বাবা পেশায় একজন ড্রাইভার। তিনি মাসে ১৮ হাজার টাকা উপার্জন করেন, যা পরিবারের খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তাই সাগর পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করতেন।
সরকার গত ছয়দিন ধরে হাসপাতালের সব খরচসহ ওষুধের খরচ বহন করায় ফাতেমা বেগম কৃতজ্ঞ।
তবে নতুন সরকার সাহায্য শুরু করার আগে সাগরের পরিবারের তার চিকিৎসার পেছনে ইতোমধ্যেই ১.৫ লাখ টাকা খরচ করে ফেলেছে, যার মধ্যে ১ লাখ টাকা ঋণ করা হয়েছে।
ফাতেমা সরকারের কাছে সাগরের সঠিক চিকিৎসার জন্য আরও সহায়তার আবেদন করেছেন। যদিও তার ভয় হয়, সাগর হয়তো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবে না।
তিনি সাগরের সুস্থ হওয়ার পর আর্থিক সহায়তা এবং একটি চাকরির আবেদনও করেছেন।
ডাক্তার জানিয়েছেন, সাগরের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন হবে, সম্ভবত তিন বছর পর্যন্ত। ইতোমধ্যে তার তিনটি অস্ত্রোপচার হয়েছে এবং আগামী সপ্তাহে আরও একটি অস্ত্রোপচার করার কথা রয়েছে।
ফাতেমাকে সাগর বলেছিলেন, "আমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পেলেই নিশ্চিত করব, আমার দুই বোনের লেখাপড়া যাতে শেষ হয়।"