ভারতীয় হিন্দুরা বাংলাদেশের হিন্দুদের যা বোঝে না
গত ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মাঝে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তখন একজন বাঙালি হিন্দু হিসেবে আমার ভেতর দুই ধরণের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। প্রথমটি হচ্ছে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যা অর্জন করেছে সেটা নিয়ে উচ্ছ্বাস। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সাথে কী ঘটতে পারে সেটা ভেবে শঙ্কা।
আমার এমন ভয় অবশ্য অমূলক ছিল না। পতনের দিন রাতেই এই সম্পর্কিত সব সংবাদ প্রকাশ পেতে শুরু করি। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরিস্থিতি ঘিরে যে শুন্যতা তৈরি হয়েছিল তার সুযোগে উগ্রপন্থীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালায়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভাষায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ক্ষমতার শুন্যতার সুযোগ নিয়ে তাদের বিরোধীদের আক্রমণ করে। আর চরমপন্থীরা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ স্বেচ্ছায় হিন্দুদের মন্দির, খ্রিস্টানদের গির্জা এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে। ঠিক যেমনটা ১৯৭১ সালে সমস্ত সম্প্রদায় ও বাংলাদেশের ধারণাকে রক্ষা করতে সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন যে, সরকার অবশ্যই একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শসম্পন্ন হবে। যারা কি-না সংখ্যালঘুসহ সকলের অধিকারকে সম্মান করবে।
বাংলাদেশে যখন দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে সেক্ষেত্রে দেশটির সংখ্যালঘুদেরও মুক্তির এই নতুন যুগে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে। এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশ সরকারের মৌলিক সংস্কার চায়। যার মধ্যে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও সংসদে সংখ্যালঘুদের জন্য ১০ শতাংশ সিট সংরক্ষণের বিষয়টি উঠে এসেছে।
কিন্তু ভারতীয় হিন্দুরা বাংলাদেশী হিন্দুদের কথা বোঝার কিংবা শোনার খুব একটা চেষ্টা করেননি। বরং ভারতীয়দের কেউ কেউ এমনটাও বলেছেন যে, শেখ হাসিনাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশে হিন্দুদের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
বাংলাদেশী হিন্দু শিক্ষার্থীরা তাদের শত শত সহপাঠীর সাথে এই ছাত্র আন্দোলনে লড়াই করেছেন ও নিহতও হয়েছেন। যেমনটা তারা ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী বাঙালির অধিকারের জন্য সমস্ত লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন ও প্রাণ দিয়েছেন। যার মূলমন্ত্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পরিবেশ।
যদিও ভারতীয় ও প্রবাসী হিন্দুরা গণহত্যা থেকে অসহায় হিন্দু বাংলাদেশিদের রক্ষা করার জন্য বেশ সোচ্চার হয়েছে। তবে উগ্র ডানপন্থীরা এআই দিয়ে তৈরি নিহত বাংলাদেশি হিন্দুদের ছবি ব্যবহার করে বিশ্ব হিন্দু সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের আর্জি জানিয়েছে।
উগ্র-ডানপন্থী হিন্দু প্রবাসী সংগঠনগুলোর অস্তিত্ব বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায় না। তবুও এরাই আমাদের বাংলাদেশি ভাই-বোনদের ভয়কে ব্যবহার করে যুক্তি দিচ্ছেন যে, একমাত্র শেখ হাসিনাই বাংলাদেশি হিন্দুদের গণহত্যা থেকে রক্ষা করেছেন। এমনকি একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট ড. ইউনূসকে অং সান সুচির সাথে তুলনা করেছে।
যদিও সু চি বহু বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে রোহিঙ্গাদের গণহত্যায় সেনাবাহিনীকে সমর্থন করেছিলেন। আর ইউনূস সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সকল সহিংসতার প্রতিবাদ করেছেন।
এমনকি ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যেই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। একইসাথে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে তিনি সকলের অধিকার রক্ষায় তার প্রচেষ্টার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশে হিন্দুদের সাথে যা ঘটেছে তা মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাইরের হিন্দুদের আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। উগ্র ডানপন্থীদের ভুল তথ্য বাংলাদেশি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে বরং উদ্বেগ দূর করে দেয়। এক্ষেত্রে তারা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ে যায়। কারণ এক্ষেত্রে তাদের ভয় বিদেশী প্রোপাগান্ডা হিসাবে খারিজ করে দেওয়ার সুযোগ থাকে।
ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উস্কে দেওয়ার ফাঁদে পড়ার পরিবর্তে ভারতীয় হিন্দুদের উচিত হাজার হাজার বাংলাদেশি হিন্দুদের কথা শোনা। যারা কি-না বাংলাদেশের সরকারের কাছে কাঠামোগত পরিবর্তনের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছিল।
প্রতিবাদী নেতা বিপ্র প্রসূন দাস যেমনটা বলেছিলেন। বাংলাদেশি হিন্দুদের উদ্বেগ শোনার জন্য অন্যান্য হিন্দুদের প্রয়োজন প্রকৃত সহানুভূতি প্রকাশ। বাংলাদেশি হিন্দুদের ভারতীয় সাম্প্রদায়িক বিভক্তি সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে ব্যবহার করা উচিত নয়। হিন্দুদের উচিত নিজেদের স্বার্থে ঘটনাকে ব্যবহার না করে বরং একে অপরের কথা শোনা।
বাংলাদেশি হিন্দুরা নিরুপায় নয়। তারা বাইরের শক্তির কাছে সহযোগিতা চাননি। তারা স্বৈরাচারকে ফের ক্ষমতায় চায় না। একইসাথে তারা অবশ্যই তাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে চায় না।
বরং বাংলাদেশি হিন্দুরা চায় অন্যরা যাতে তাদের দৃঢ় দাবিগুলিকে তুলে ধরে। যাতে করে বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থেই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়; যা ধর্ম, বর্ণ বা জাতি নির্বিশেষে সকলের জন্য প্রয়োগ করা হবে।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান