‘আমি কখনও হারতে চাই না’
খালেদ মাহমুদ সুজন; বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক। কোচ, বিসিবি পরিচালকসহ আরও অনেক পরিচয় আছে তার। বাংলাদেশের ক্রিকেট বা অনেক ক্রিকেটারের কাছে আবার তিনি 'চাচা'। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয় ও সতীর্থের চাচা ডাকতে শুরু করে, এরপর ধীরে ধীরে তিনি অনেকেরই চাচা হয়ে ওঠেন সুজন। আক্ষরিক অর্থেও তিনি অনেক ক্রিকেটারের কাছে 'চাচা' বা অভিভাবক। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ থেকে শুরু করে মেহরাব হোসেন জুনিয়র, ফরহাদ রেজা, তাসকিন আহমেদ, মুস্তাফিজুর রহমান, সৌম্য সরকার, তাওহিদ হৃদয়, তানজিদ হাসান তামিমদের ক্যারিয়ারে সুজনের অবদান অনেক। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে এসে সুযোগ দেওয়া ক্রিকেটারদের বাবা হিসেবেও এক সময় ডাকা হতো তাকে।
খেলোয়াড়, সংগঠক, কোচ হিসেবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার পথচলা দীর্ঘদিনের। খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টেনে বিসিবিতে চাকরি নেওয়া সাবেক এই অলরাউন্ডার পরবর্তীতে বিসিবি পরিচালক হন। এ ছাড়াও জাতীয় দলের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান কোচ, সহকারী কোচ, জাতীয় দলের ম্যানেজার, টিম ডিরেক্টরসহ বিভিন্ন ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করেছেন সুজন।
২০১৩ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে বিসিবি পরিচালক হওয়া সুজন গেম ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ছিলেন ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের ভাইস-চেয়ারম্যানও। তবে এসব দায়িত্বে এখন তিনি সাবেক। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বিসিবি পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন তিনি। বিসিবি পরিচালকের পদ ছাড়ার কিছুদিন আগে খেলোয়াড়ি জীবন, কোচিং ও সংগঠকের ক্যারিয়ার, নিজের সাফল্য-ব্যর্থতা, ক্রিকেটার তুলে আনার ঝোঁক, বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের অবস্থানসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছিলেন সুজন।
সংগঠক সত্তাটা ছোটবেলা থেকেই নিজের মধ্যে ছিল সুজনের। তবে পরিকল্পনা করে সংগঠক হননি জানিয়ে তিনি বলেন, 'সংগঠক হবো, এভাবে ভেবে শুরু করিনি। খেলোয়াড় থাকা অবস্থাতেই আমার একটা ঝোঁক ছিল বিভিন্ন খেলোয়াড়দের দেখাশোনা করা, ক্লাবের খোঁজ রাখা, দল বানানো। এরপর তো খেলা ছাড়ি, কোচিংয়ে আসি। আমি যখন কোনো ক্লাবে কাজ করি, আমার একটা পছন্দ থাকে, আমি এমন খেলোয়াড় চাই। আমি বেক্সিমকোতে আছি, বেক্সিমকোর অনেকগুলো দল দেখি।'
'আমি যেহেতু বেক্সিমকোর হেড অব কোচিং, ওখানে আমি প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ দল দেখি। প্রিমিয়ার লিগের দল আছে শাইনপুকুর, এখন গুলশান। দল গড়ার সময় আমাকেই বাজেটিং করতে হয়, কেমন দল হবে, ছেলেরা কোথায় থাকবে, খাবে; সব কিছুতেই যুক্ত থাকতে হয়। আমি ওইভাবে সংগঠক কিনা জানি না। আমি ক্রিকেট খেলেছি, এতো বছর ধরে ক্রিকেটের সাথেই আছি। ক্রিকেটের সাথে থাকতে আনন্দ লাগে, ভালো লাগে। কোনো ছেলেকে সুযোগ করে দিতে পারলে আনন্দ হয়। ঢাকার বাইরের কেউ যখন আসে, পারফর্ম করে, তখন গর্ব হয় যে তাকে উঠিয়ে আনা গেছে।' বলেন তিনি।
খেলোয়াড়ি জীবনের নেতৃত্বগুণ কোচিং বা সংগঠকের কাজে সাহায্য করে বলে মনে করেন সুজন। তার ভাষায়, 'আমি যখন শুধু খেলোয়াড় ছিলাম, তখন এতো কিছু চিন্তা করতাম না। কিন্তু যখন আমি অধিনায়ক হই, তখন অবশ্যই সব খেলোয়াড়ের সাথে আলাদা করে কথা বলতে হয়েছে। জাতীয় দলের কথা যদি বলি, আমাকে আরও বেশি যুক্ত হতে হয়েছে। ওসব আমাকে এখন দারুণভাবে সাহায্য করে। সেই নেতৃত্বগুণের কারণে ব্যাপারগুলো ভালোভাবে সামলাতে পারি। এখন কেউ ভালো না করলে তার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলি। আবাহনীতে খেলোয়াড়দের সাথে আমার সম্পর্ক খেলোয়াড়-কোচের চেয়েও বেশি। বাবা-ছেলের মতো আমাদের আলোচনা হয়। আমি তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও অনেক কিছু জানি বা আলোচনাও করি।'
ক্রিকেট ছেড়ে ২০০৭ সালে ক্রিকেট একাডেমির (বর্তমানে এইচপি) অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে বিসিবিতে চাকরি শুরু করেন সুজন, দায়িত্ব পালন করেন সাড়ে চার বছর। সুজনের বর্ণনায়, 'খেলা ছাড়ার পর আমি বিসিবিতে চাকরিজীবী হিসেবে যোগ দিই। ক্রিকেট অ্যাকাডেমির অপারেশন ম্যানেজার ছিলাম, এটা ২০০৭ সালের দিকে। সাড়ে চার বছর আমি বোর্ডে চাকরি করি। অপারেশন ম্যানেজার ও ন্যাশনাল কোচ ছিলাম। এরপর বাংলাদেশ 'এ' দলের হেড কোচ হই। অপারেশন ম্যানেজার থাকলেও তখন আমি অনেক পদেই ছিলাম।'
একটি বিভাগের প্রধান থাকলেও বিসিবির সব বিভাগকে সাহায্য করার চেষ্টা থাকতো সুজনের। তিনি বলেন, 'অন্তর্বর্তীকালীন পরিচালক হিসেবে কাজ করার পরে নির্বাচন করে বোর্ডে আসি। এখানে আমি গেম ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান, ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের ভাইস-চেয়ারম্যান, মাঝে টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম, আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলাম (অন্তর্বর্তীকালীন)। নির্বাচিত হয়ে আসার পর আমাকে গেম ডেভেলপমেন্ট দেওয়া হয়। তখন থেকে এই দায়িত্বেই। আগে আমি সব বিভাগকেই সাহায্য করতাম। আমি নারী বিভাগকে সাহায্য করি, বাংলা টাইগার্সকে সাহায্য করি, টুর্নামেন্ট কমিটিতেও আমার সম্পৃক্ততা আছে।'
'কাজ করার জন্য কোনো বিভাগের চেয়ারম্যান হতে হবে, এটা আমি মনে করি না। সবার সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ছিল, সবকিছু নিয়েই কাজ করেছি। এখন হয়তো চেয়ারম্যানরা ডাকেন না বা প্রয়োজন মনে করেন না, আগে আমি প্রতিটা কমিটিতেই ছোটখাটো কাজ করতাম। পরিচালক হিসেবে প্রতিটা বিভাগেই দায়িত্ব থাকা উচিত। ক্রিকেট নিয়ে কাজ করতে আমার ভালো লাগে, আমার চেয়ার থাকুক আর না থাকুক। আমি কেবল লজিস্টিক বা ফাইন্যান্সে কখনও যাইনি। আমি যেহেতু মাঠে থাকি, আমার কাজই ছিল মাঠকেন্দ্রীক।' যোগ করেন তিনি।
বোর্ড পরিচালক হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে সুজন বলেন, 'আমি কখনও চিন্তা করিনি আমাকে ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হতে হবে। আমার বন্ধু বা শুভাকাঙ্খী সবাই পরিচালক হিসেবে আমাকে বোর্ডে নির্বাচন করতে বলে। তখন আমার কোনো ক্লাব ছিল না, যে ক্লাবে আছি সবাই নির্বাচক করবে। তখন প্লেয়ার্স কোটার কথা বলা হয়, যেখানে লিপু (প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু) ভাই ছিলেন। আমি বলি "লিপু ভাইয়ের সাথে আমি পারব নাকি।" কারণ লিপু ভাই অনেকদিন ধরেই আছেন বোর্ডে তখন। তবে সবাই আমাকে বেশ সাহস দেয়, করতে বলে। আমি মন স্থির করে নির্বাচনের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস হয়ে উঠি। কারণ আমি কখনও হারতে চাই না। আমার জীবনের যেখানেই লড়েছি, জেতার জন্যই লড়তাম।'
'নির্বাচনে আমাকে একা একা এগোতে হয়, কারণ আমি সেভাবে সমর্থন পাইনি। ঢাকার বাইরে বাইরে ঘোরা, সবার ভোট চাওয়া। তখন খুব মন দিয়ে কাজটা করেছিলাম। লিপু ভাইয়ের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে জিতি, যা আমার কাছে বিস্ময়ের ছিল। এরপর থেকে তো বোর্ডে আছি। বোর্ডে আমি কাজ করি, পুরোটা সময় গেম ডেভেলপমেন্ট প্রধান হিসেবে কাজ করেছি। বেশ সাফল্য আছে ডেভেলপমেন্ট বিভাগের। না জেনে পাইপ লাইন নিয়ে অনেকে কথা বলে, কিন্তু পাইপ লাইনে এখনও খেলোয়াড় আছে। তবে দায় স্বীকার করবো আমি যে ফ্যাসিলিটিস চাই, সেটা এখনও গড়ে ওঠেনি। এখানে অভাব আছে। সংগঠক বা পরিচালক হিসেবে আমি এখানে সফল নই এই কারণে যে, এখানে আমি সেই স্ট্রাকচার গড়ে তুলতে পারিনি, যেটা শক্তিশালী পাইপলাইন গড়ার ক্ষেত্রে দরকার।'
সংগঠক বা গেম ডেভেলপমেন্টের প্রধান হিসেবে অনূর্ধ্ব-১৯ দল নিয়ে গর্ব করেন সুজন। যুব বিশ্বকাপ ও এশিয়া জয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সাফল্যের কথা বললে অবশ্যই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাফল্য এটা। হোক সেটা জুনিয়র লেভেলে, কিন্তু আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। একটা জায়গাতেই আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, সেটা অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে। সেটা আমার তত্ত্বাবধানে, আমি কমিটির চেয়ারম্যান। এটা আমার জন্য গর্বের বিষয়। অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, এটা আমার জন্য গর্বের বিষয়। আমার তত্ত্বাবধানে অনেকগুলো ক্লাব প্রথম বিভাগ থেকে প্রিমিয়ার লিগে উঠেছে, সেটা আমার জন্য গর্বের বিষয়। শেখ জামাল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, আমি কোচ ছিলাম। শাইনপুকুরের কোচ ছিলাম, শাইনপুকুর অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন, যে দলে তাওহিদ হৃদয় প্রথমবার ঢাকা লিগে খেলে। এমন বেশ কিছু সাফল্য আমাকে তৃপ্তি দেয়। সংগঠক হিসেবে আমি যেহেতু কয়েকটি ক্লাবের সঙ্গে জড়িত, অনেক ক্রিকেটারকে আমি ঢাকায় নিয়ে আসি, সেটাও আমার একটা সাফল্য বলে মনে করি।'
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রিকেটার তুলে এনে তাদেরকে সুযোগ করে দেওয়াটা সুজনের কাছে নেশার মতো। তার ভাষায়, 'যেহেতু আমি ঢাকার বাইরে ক্রিকেট নিয়ে কাজ করি। একাডেমিতে কাজ করি, রাজশাহীতে গত ১০-১২ বছর ধরে একটা একডেমিতে কাজ করছি বাংলা ট্র্যাক নামে। ওইখানে আমি অনেক ট্যালেন্ট দেখি। যেমন তাওহিদ হৃদয় বা তানজিদ হাসান তামিম কিন্তু শুরুতে ছিল অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ছিল না। এ দুজন আমার একডেমির খেলোয়াড়, এদের যখন আমি দেখি, তখন আমি বলি এই দুটি ছেলে বাদ পড়ে কীভাবে। আমার কথাতে তারা দলে আসে। এ দুজন এখন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। এসব চিন্তা করলে এখন অনেক বেশি ভালো লাগে।'
'রাজশাহীতে আমি দেখি অনেক অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তান, জুতা বা ব্যাট কেনার সামর্থ্য নেই। কিন্তু অনেক ভালো ক্রিকেটার, তখন আমি তাদের ঢাকা নিয়ে এসেছি, অনেক দলে সুযোগ করে দিয়েছি। এভাবে অনেকেই দ্বিতীয় বিভাগ পেরিয়ে প্রথম বিভাগ বা প্রিমিয়ার লিগে খেলছে। পরিস্থিতির কারণে এদের অনেকে হয়তো ঢাকাতেই আসতে পারতো না। হৃদয় যেমন শাইনপুকুর থেকে বড় হয়েছে। এই দল যদি না থাকতো, আমি যদি না থাকতাম দায়িত্বে, তাহলে হয়তো হৃদয়কে এই সুযোগটা দিতে পারতাম না। অনেকেই স্বার্থ না দেখেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে আছে। দল চালায়, আমি মনে করি ঢাকা লিগ না থাকলে বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ এতোদূর আসতো না। বিপিএল নিয়ে এতো মাতামাতি, কিন্তু এটা তো সেদিন এলো। আর এটা বিনোদনের ক্রিকেট। ঢাকা লিগে প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ বা তৃতীয় বিভাগে যারা দল চালান, পৃষ্ঠপোষকতা করেন, সবচেয়ে বড় প্রশংসার দাবিদার তারা। তাদের কারণেই বাংলাদেশের ক্রিকেট এখানে এসেছে। বেক্সিমকো গ্রুপ আছে, গাজী গ্রুপ আছে।'
তরুণ বয়সে নিজেদের ক্লাব চালানোর স্মৃতির কথা মনে করে সাবেক এই অধিনায়ক বলেন, 'আমরা একটা পাড়ার ক্লাব চালাতাম, আমি জানি কাজটা কতোটা কঠিন। আম্পায়ার মুকুলকে (মাসুদুর রহমান মুকুল) আমি ফরিদপুর থেকে নিয়ে এসে আমাদের পাড়ার ক্লাবে খেলাই, কোয়ালিফাইং একটা দল করেছিলাম সিদ্বেশ্বরী ক্রীড়া সংঘ নামে। মুকুলসহ আরও একজনকে আমরা এক বন্ধুর বাসায় রাখতাম, হোটেলে রাখার মতো আর্থিক অবস্থা ছিল না। বন্ধু-বান্ধবরা মিলে চালাতাম। তাহলে বোঝেন আমি কতো আগের সংগঠক। সংগঠক ব্যাপারটা ছোট বেলা থেকেই আমার মধ্যে ছিল, আমার সফর অনেক লম্বা। আমি মধ্যবিত্ত থেকে আসা, ক্রিকেট খেলা কঠিন ছিল আমাদের জন্য। আমার বাবার এতো টাকা ছিল না যে আমাকে ব্যাট বা জুতা কিনে দেবেন। আমি জানি একটা ছেলের জন্য কতোটা কঠিন হয়।'
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় ক্রিকেট খেলা নিয়ে সুজনকেও সংগ্রাম করতে হয়েছে। বর্ণনা দিলেন এভাবে, 'বাবা খেলতে দিতে চাইতেন না। কারণ বাবা লেখাপড়া নিয়ে চিন্তা করতেন। যখন আমি ইংল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক হলাম, বাবা অবাক হয়ে যান। বাবা বলেছিলেন, "তুই কবে থেকে এভাবে ক্রিকেট খেললি আর অধিনায়ক হয়ে গেলি।" আমি বিভিন্ন দোকানে ব্যাট, জামা-কাপড় লুকিয়ে রেখে পালিয়ে পালিয়ে ক্রিকেট খেলতাম। আব্বা আমার অবস্থান জানার পরে অনেক গর্ব করেছিলেন। তবে সব মিলিয়ে আমি জানি কতোটা কঠিন। আমাদের সময়ে দেখেছি, টাকা পাইনি। টাকা চাইতে গেলে গালিও শুনেছি। উনারা সময় দিয়েও ভুলে যেতেন, নিজেকে তখন ফকির মনে হতো। ৫০ হাজার বা এক লাখ টাকার জন্য কতো কষ্ট করতাম।'
মাহমুদউল্লাহ, তাসকিন, মুস্তাফিজদের তুলে আনার গল্প জানাতে গিয়ে সুজন বলেন, 'তাসকিন ছোটবেলায় যখন নেটে বল করতো, ওকে আমি খুব পছন্দ করতাম। বাচ্চা একটা ছেলে নেটে জোরে বল করে, দেখতে দারুণ লাগতো। তাসকিনকে আমি প্রথম সুযোগ দেই বিপিএলে চিটাগং কিংসে, আমি কোচ ছিলাম। সবাই বলেছে বাচ্চা ছেলে, একেবারে নতুন, কিছুই খেলে নাই। যেদিন আমি ওকে খেলাই তার আগের দিন তো দলে অন্যরকম অবস্থা, কেউ ওকে খেলাতে দিতে রাজি ছিল না। আমি লড়াই করে খেলাই, প্রথম ম্যাচে ও ৪ উইকেট পায়। এরপর তো তাসকিন তৈরি হলো, বড় ক্রিকেটার হলো।'
'মুস্তাফিজের ব্যাপারটা যেটা ছিল, চান্দিকা হাথুরুসিংহে আমাকে আমার কাছে বাঁহাতি ফাষ্ট বোলার চান। মুস্তাফিজ এমনিতেই জাতীয় দলে খেলতো, ও সেই সামর্থ্যের খেলোয়াড়। তবে এতো দ্রুত ওর অভিষেক হতো কিনা জানি না। আমি চান্দিকাকে আবু হায়দার রনি ও মুস্তাফিজের নাম বলি। তাদের বিষেশষত্ব জানতে চাইলে সেসব জানািই। তখন মুস্তাফিজকে দেখতে চায় সে। মুস্তাফিজকে ফোন করে বলি ঢাকায় এসে বাংলাদেশের নেটে যোগ দে। ও এসে জয়েন করে, ৬ টা বল করে। তখন হাথুরুসিংহে এসে আমাকে বলেন, ও কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি খেলবে।'
কৃতিত্ব নিতে চান না সুজন। নিজেকে ক্রিকেটার ও দলের মধ্যকার সেতু মনে করেন তিনি। সৌম্যকে হাথুরুসিংহের সঙ্গে পরিচয় করোনোসহ সিনিয়র কয়েকজন ক্রিকেটারকে সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়ে সুজন বলেন, 'পরিচয় করিয়ে দিয়েছি কয়েকজনকে। সৌম্যকেও হাতুরুসিংহের কাছে পরিচয় করিয়ে দিই। সৌম্য তখন প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবে খেলে, আমি হাথরুসিংহেকে বলি, "তুমি যেহেতু টপ অর্ডারে ব্যাটসম্যান খুঁজছো, একটা ছেলে আছে দারুণ ব্যাটিং করে।" সেদিন প্রিমিয়ার লিগের খেলা ছিল, সৌম্য ভালো খেলে। হাথুরুসিংহে ওর ইনিংসটা দেখে আমাকে বলে ও দলে থাকবে। তো আমি সেতু হিসেবে কাজ করেছি। তবে হৃদয়, তামিমরা সরাসরি আমার খেলোয়াড় ছিল।'
'এরও আগে যদি যাই, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, আরাফাত সানি, মেহরাব হোসেন জুনিয়র, ফরহাদ রেজাসহ আরও কিছু খেলোয়াড়কে খুব কাছে থেকে আমি তুলে এনেছি। অনেকে বলতো আমি ওদের বাবা, আমি সেটা উপভোগও করতাম সে সময়। সিটি ক্লাবে আমি এক বছর খেলি। আমি পারফর্ম করলেও দল হেরে যেতো, সিনিয়র নাম করা ক্রিকেটাররা দলে ছিলেন। দল আমাকে বলার পর আমি বলেছি "আমি অধিনায়ক, আমি তো পারফর্ম করি। আর আমাকে বললে আমি বলবো আমি সিনিয়রদের একজনও খেলাতে চাই না। আমি বাচ্চাদের খেলাতে চাই।" তখন আমি মেহরাব, রিয়াদ, আবীরদের (শাহরিয়ার নাফিস) কথা বলি। পরে আমি ওই দল নিয়ে টানা ৯ ম্যাচ জিতি। হেড টু হেডে আমরা রানার্স আপ হই। তো অনেক ক্রিকেটারই তুলে এনেছি।' বলেন তিনি।
অনেক ক্রিকেটারের কাছে 'চাচা' হয়ে ওঠার গল্প জানাতে গিয়ে সুজন বলেন, 'যখন আমরা অনূর্ধ্ব-১৯ খেলি, শেখ হালিম শাহ নামে একজন খেলোয়াড় ছিল। সে আমাকে ভাই ডাকতো। একদিন সে আমাকে বলে তুমি আয়না-ময়না নামে কাউকে চেনো কিনা। আমি চিনি না জানানোর পর সে আমাকে আমার বাবাকে জানাতে বলে। বাসায় এসে বাবাকে বললাম আয়না-ময়না কে। বাবা বললেন 'আয়না-ময়না তোর ফুপু।' আমার দুঃসম্পর্কে ফুপু উনারা, আব্বাদের বোন। পরে আমি হালিম শাহকে বললাম আয়না-ময়না আমার ফুফু। তো তখন সে বলে 'উনারা আমার দাদী, তাহলে তুই তো আমার চাচা।' তার মুখ থেকে চাচা ডাকের শুরু, এই যে আমার চাচা হওয়ারও শুরু। তার মুখে শুনে অনেকেই আমাকে চাচা ডাকা শুরু করে, এরপর আস্তে আস্তে চাচা নামটা স্থায়ী হয়ে যায়।'
বাংলাদেশ দল টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর থেকেই আঞ্চলিক ক্রিকেট গঠনের আলোচনা। কিন্তু ২৪ বছরেও সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এর কারণ ব্যাখ্যায় সুজন বলেন, 'আমরা আসলে ফ্যাসিলিটিস উন্নত করতে পারিনি, স্ট্রাকচার উন্নত করতে পারিনি। ইনডোর বা নতুন মাঠ বানানো, সেসব হয়নি। ভালো খেলোয়াড় তৈরি জন্য তো ভালো ফ্যাসিলিটিসও লাগবে। ঢাকায় জাতীয় দল অনুশীলন করে, সেখানে ২৫-৩০ জন অনুশীলন করার সুযোগ পায়। বাকিরা পায় না, নারী বা ১৯ দল হয়তো কখনও সুযোগ পায়। কিন্তু এমন ইনডোর তো আমাদের সারা দেশে থাকা উচিত। চাঁদপুরে একটা ছেলে থাকে, তাকে এখন ঢাকা এসে ব্যাটিং করতে হবে। ঢাকার বাইরে আসলে এমন সুযোগ নেই।'
'শুরুতে আমি যেটা বললাম, এটা আমার দুঃখের জায়গা যে আমি গেম ডেভেলপমেন্টে থেকে এসব উন্নত করতে পারিনি। আমাদের টেস্ট সংস্কৃতি সেভাবে বেড়ে ওঠেনি বা এগোয়নি এসব কারণ। ওয়ানডে আমরা ভালো খেলি কারণ আমাদের অনেক পুরনো স্ট্রাকচার প্রিমিয়ার লিগে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, টাকা আছে। জাতীয় ক্রিকেট লিগে সেটা নেই। কাউন্টিতে কোনো ছেলে পারফর্ম না করলে সে চুক্তি হারায়। কিন্তু আমাদের এখানে তো তদবিরে খেলোয়াড় আসে, দল নেয়। একে খেলাও, ওকে খেলাও। স্ট্রাকচার শক্তিশালী হলে এমন হতো না।'
আবাহনী বা মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলো প্রথম শ্রেণি খেললে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যরকম হতো বলে মনে করেন সুজন। তার ভষায়, 'আজ যদি আবাহনী বা মোহামেডান প্রথম শ্রেণি খেলতো, তাহলে অন্যভাবে এগোতো। এ কারণে উন্নতি হয়নি। কারণ প্রথম শ্রেণিতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। একেবারেই হয় না, তেমন নয়। কারণ একটা দল তো চ্যাম্পিয়ন হয়, জিতেই সেরা হতে হয় তাদের। কিন্তু ঢাকা লিগ যেমন বা রেসপেক্টের জায়গা, সেটা প্রথম শ্রেণিতে নেই। এ কারণে টেস্টে আমরা পিছিয়ে আছি। এখানে সবাই সমান আয় করে। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগে একেক জনকে দলে নিতে একেকরম টাকা দিতে হয় ক্লাবগুলোকে। প্রথম শ্রেণিতে সাকিব আল হাসানও ৫ টাকা পায়, নতুন একজনও তাই পায়। এখানে তো তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে না। টেস্টে উন্নতি না হওয়ার বিরাট একটা অন্তরায় এটা।'
খেলোয়াড় নাকি কোচ; ক্রিকেটের সঙ্গে দীর্ঘ পথচলায় কোন ভূমিকাটা কঠিন মনে হয়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে সুজন বলেন, 'খেলোয়াড় ছিলাম, খেলতাম, আনন্দ হতো। আবার দুঃখও ছিল, কারণ বাদ পড়তাম। আমিই মনে হয় একমাত্র জাতীয় দলের খেলায়াড়, তখন ১০ বার দল থেকে বাদ পড়েছি, ১০ ফিরেছি। সেটা অল্প সময়ের মধ্যেই, একটু খারাপ করলেই আমাকে বাদ দিয়ে দিতো, আমার পেছনে অনেক মানুষ লেগে থাকতো। একটা টুর্নামেন্টে টপ অলরাউন্ডার হওয়ার পরও আমাকে বাদ দেওয়া হয়, অনেক সিনিয়র ক্রিকেটার ছিলেন সেখানে। কারণ আমি জানতাম না। পরে জেনেছি কে বাদ দিয়েছে, কীভাবে বাদ পড়েছি। ছোট বেলা থেকে সোজা কথা বলতাম, এ কারণে অনেক বেয়াদব মনে করতো। আসলে তেমন নয়, উচিত কথা বলতাম আমি। ওই সময়ে এসব থাকলেও খেলোয়াড় হিসেবে খুব উপভোগ করেছি। আবার কোচ হিসেবে ভিন্ন দায়িত্ব। এখানেও অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হয়। দল সাজানো, একাদশ বানানো, খেলার কৌশলসহ কতো কী। তবে আমার কাছে মনে হয় খেলোয়াড় হিসেবেই কাজটা কঠিন।'