অখ্যাত রূপসী গ্রুপের ঋণ যেভাবে সোনালী ব্যাংকের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠল
২০০৮ সালে প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় নারায়ণগঞ্জের পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রূপসী গ্রুপ। এর পরের বছরগুলোতেও এই ঋণগ্রহণ অব্যাহত রাখে প্রতিষ্ঠানটি।
গত ১২ বছরে সাতবার পুনঃতফসিল সুবিধা নিয়েছে রূপসী গ্রুপ। কিন্তু তারপরও ঋণ পরিশোধ করেনি। সর্বশেষ হিসাবে এ গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে সোনালী ব্যাংকের বকেয়া পাওনা দাঁড়িয়েছে ৪৬৫ কোটি টাকা। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের নারায়ণঞ্জ শাখার অর্ধেকের বেশি ঋণ এই গ্রুপের কাছে আটকে আছে।
রূপসী গ্রুপের নেওয়া ঋণের পুরোটাই মন্দ মানের খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। ফলে সোনালী ব্যাংককে এখন ব্যাংকিং বিধিমালা অনুযায়ী এ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের পৃথক দুটি তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রূপসী গ্রুপকে তাদের এলসি (ঋণপত্র) মূল্যের প্রায় ১৫০ শতাংশ ফান্ডেড লোন সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা ব্যাংকিং নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও ঋণগ্রহীতার যোগসাজশে এ কাজ করা হয়েছে বলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংক গ্রাহকের রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে ঋণ পুনরুদ্ধার করেনি, যা ঋণ আদায় প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করেছে।
ওইসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৩১ মে-র হিসাবে, রূপসী গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রূপসী নীটওয়্যারস লিমিটেডের কাছে ২৫৪ কোটি টাকা, রূপসী ফেব্রিকস কমপ্লেক্স (প্রাঃ) লিমিটেডের কাছে ১৪৮ কোটি টাকা ও সালমান নীট কম্পোজিটের কাছে ৬৩ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা দাঁড়িয়েছে।
২০০৮ সালে সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ কর্পোরেট শাখা থেকে এই তিন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হয়ে পড়ে।
সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারার বিষয়ে জানতে গত ২২ অক্টোবর রূপসী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। এ সময় মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দি অসুস্থতার কথা জানিয়ে পরেরদিনে দুপুরে ফোন করার অনুরোধ করেন।
পরদিন মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দির পক্ষে রূপসী গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মাদ মোশাররফ হোসেন এই প্রতিবেদককে ফোন করেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান।
তিনি টিবিএসকে বলেন, ঋণ খেলাপি হওয়ার জন্য রূপসী গ্রুপ দোষী না, ব্যাংক সম্পূর্ণভাবে দায়ী।
মোশাররফ হোসেন বলেন, ব্যাংকের সহযোগিতার অভাবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রূপসী গ্রুপের ব্যবসা বন্ধ। 'ব্যবসা বন্ধ থাকার পরও ১৭৪ কোটি টাকা সোনালী ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে। যা ঋণ নেওয়া হয়েছে, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। এর দালিলিক প্রমাণ আছে।'
ঋণ বিতরণে অনিয়ম
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, রূপসী ব্যাংককে ঋণ বিতরণে বারবার অনিয়ম করা হয়েছে। আমদানির জন্য এলসি খুলে অর্থ পরিশোধ করেনি রুপসী গ্রুপ, যা পরে ফোর্স লোন সৃষ্টি করা হয়েছে।
একাধিক এলসিতে এলসিমূল্যের ১৫২ শতাংশ, ১৪৮.৯২ শতাংশ ও ১৪৮ শতাংশ ফান্ডেড সুবিধা দিয়েছে ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণগ্রহীতা গ্রাহকের রপ্তানি বিল প্রায় শতভাগ প্রত্যাবাসিত হলেও সোনালী ব্যাংক সেখান থেকে টাকা আদায় করেনি; বরং গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে বেশিরভাগ অর্থ জমা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে এ ধরনের কার্যক্রমকে 'ব্যাংকের অর্থ সরাসরি লোপাট' করার শামিল এবং এ কাজে শাখা অথবা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সরাসরি জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রূপসী গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ ধরনের অভিযোগ করা হয়েছে। 'কিন্তু কোম্পানির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকদের এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তারা সেটি গ্রহণ করেননি,' বলেন তিনি।
জামানত ও সম্পদ মূল্যায়ন
বিপুল এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেই বলে উদ্বেগ জানানো হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
বর্তমান হিসাবে গ্রুপটি ৪৪১ কোটি টাকার সম্পত্তি জামানত রাখলেও বড় জামানত ঘাটতি রয়ে গেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রূপসী নীটওয়্যারস লিমিটেডের ১০৭.৭৮ কোটি টাকা, রূপসী ফেব্রিকস কমপ্লেক্স (প্রাঃ) লিমিটেডের ৬৭.৭৬ কোটি কোটি টাকা ও সালমান নীট কম্পোজিটের ৩১.২৮ কোটি টাকা জামানত ঘাটতি রয়েছে।
সোনালী ব্যাংক শুরুতে খুব কম জামানত গ্রহণ করে। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে মোট ১,০৯৬ শতাংশ জমি জামানত নেওয়া হয়। কিন্তু জমির দাম মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয়নি। এরপর বারবার পুনঃতফসিলের কারণে ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকলে দালান, ইটিপি ও মেশিনারিজও জামানত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপরও ঋণের বিপরীতে নিয়ম অনুযায়ী জামানত নেওয়া সম্ভব হয়নি।
জামানতের বিষয়ে রূপসী গ্রুপের মোশাররফ হোসেন বলেন, পর্যাপ্ত জামানত নেই, এ তথ্য সঠিক নয়। 'ব্যাংকের হিসাবেই পর্যাপ্ত জামানত আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'জামানতের সম্পদের ভ্যালুয়েশনের জন্য সোনালী ব্যাংক সর্বশেষ যে ফার্ম নিয়োগ করেছিল, তাদের সাথে রূপসী গ্রুপের কেউ আলোচনা করার সুযোগই পাননি। যেটা অন্যান্য সময় পাওয়া গেছে।'
অন্যান্য অনিয়ম
ঋণ খেলাপি ছাড়াও রূপসী গ্রুপের আরও কিছু অনিয়ম উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। গ্রুপটিকে সোনালী ব্যাংক নানাভাবে সুবিধা দিয়েছে।
যেমন, রূপসী গ্রুপের ব্যাক-টু-ব্যাক দায় সমন্বয় না করেই বিল পারচেজ বা ডিসকাউন্টিং করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ব-অনুমোদন নেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি।
গ্রুপটির ফোর্সড লোন পাঁচবার পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ঋণের কিস্তি না দিয়ে এই গ্রুপ সোনালী ব্যাংক থেকেই টাকা তুলে নিয়ে জমি কেনা, দালান নির্মাণের মতো কাজ করেছে।
কিছু ক্ষেত্রে রপ্তানি না হওয়া সত্ত্বেও এই গ্রুপকে প্যাকিং ক্রেডিট বা পিসি লোন দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের ওই শাখার কমপক্ষে পাঁচজন কর্মী সরাসরি জড়িত বলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতা
২০২২ সালের ২২ আগষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংক এক চিঠিতে সোনালী ব্যাংককে রূপসী গ্রুপকে দেওয়া ঋণের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার নির্দেশনা দেয়।
কিন্তু সোনালী ব্যাংক এখনও পর্যন্ত অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
২০২৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিমকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, এরকম অনিয়মের ক্ষেত্রে অভিযোগ গঠন ও তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ করা ব্যাংকটির 'অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ'। এদিকে ঋণগুলো
ওই চিঠিতে ১৪ মার্চের মধ্যে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এবং ঋণ আদায়ে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে কিছু জানানো হয়নি।
রূপসী গ্রুপের মোশাররফ হোসেন বলেন, ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের ঋণ নিয়মিত ছিল। আর জানুয়ারির পরে যে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না, তা গত বছর থেকে চিঠি দিয়ে সোনালী ব্যাংককে জানিয়ে আসছিলেন তারা।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়ে গত জানুয়ারির পরে কিস্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলেও জানিয়েছিলেন তারা।
মোশাররফ হোসেন বলেন, ২০২৩-এর ৪ অক্টোবর গভর্নরকে পাঠানো এক চিঠিতে জানানো হয়েছিল, বলেছেন, সোনালী ব্যাংকের সহযোগিতা না পাওয়ায় তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সোনালী ব্যাংক হঠাৎ করে সব ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেয়। ওই চিঠিতে ঋণ পরিশোধের সময় এক বছর বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছিল।
'আমরা ব্যবসা চালু করার জন্য ব্যাংককে সহায়তার অনুরোধ করেছি। কিন্তু ব্যাংক এগিয়ে আসেনি,' বলেন তিনি।
মোশাররফ আরও বলেন, তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। কয়েকবার ঋণ পুনর্গঠন হয়েছে। ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি রয়েছে।
তিনি বলেন, সবশেষে রূপসী গ্রুপ নারায়ণগঞ্জ আদালতে ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করেছে।
রূপসী গ্রুপ থেকে ঋণের অর্থ আদায়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ কর্পোরেট শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) সঞ্জয় কুমার রায় টিবিএসকে বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে যেসব প্রক্রিয়া ও আইনি ব্যবস্থা রয়েছে, রুপসী গ্রুপের ক্ষেত্রে সেইসব পদক্ষেপ অনুসরণ করা হচ্ছে।
মামলা করা হয়েছে কি না ও কত টাকার বিপরীতে মামলা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
ওই শাখার আরেকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রূপসী গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক যা বলেছেন, তার পুরোটা সত্য নয়।
তিনি বলেন, এই গ্রুপের ঋণ বিতরণ ও আদায়ে অনেক নিয়মই মানা হয়নি—এবং এখনও মানা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা জেনে-বুঝে গ্রাহককে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, সোনালী ব্যাংকের সাবেক একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপসীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। রূপসী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদে তিনি এই নিয়মবহির্ভূত সুবিধা দেন।
ঋণ খেলাপি হওয়ার পরেও এই বিশেষ সুবিধাপ্রদান অব্যাহত রাখা হয় উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, 'সবশেষে রূপসী গ্রুপ সোনালী ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে চলে গেছে। এর পেছনেও সাবেক ওই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের হাত ছিল। নতুন ব্যাংকেও রূপসী গ্রুপ খেলাপি হয়ে পড়েছে।'
সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের একজন জেনারেল ম্যানেজার নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, রূপসী গ্রুপ গভর্নর বরাবর যেসব দাবি করেছে, সেগুলো মিথ্যা ও মনগড়া।
তিনি বলেন, ২০২১ সালে রূপসী গ্রুপ তথ্য গোপন করে ৬৬ কোটি টাকা বাড়তি ঋণ নেয়। এ কারণে তাদের সুবিধা বাতিল করা হয়।
'পরে কিছু অর্থ পরিশোধ করা হয়। ঋণও পুনঃতফসিল করা হয়। কিন্তু তারা এখনও নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করছে না,' বলেন তিনি।