হ্যারিস বনাম ট্রাম্প: যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে এশিয়ার দেশগুলো কাকে বিজয়ী দেখতে চায়
আগামী ৫ নভেম্বর ভোট দিতে যাবেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান দলের প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প – প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত এ দুজনের। তাঁদের মধ্যে থেকেই একজন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ও অপরিমেয় সামরিক শক্তিরও অধিকারী। বিশ্বের ভূরাজনীতি নিয়ন্ত্রণে দেশটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী দুজনের ঘরোয়া ও পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও রয়েছে সুস্পষ্ট পার্থক্য। ফলে এই নির্বাচনের ফলাফল নিঃসন্দেহে বিশ্বময় আলোড়ন তুলবে।
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সরকারগুলোও ঘনিষ্ঠভাবে এই নির্বাচনের দিকে নজর রাখছে।
ডাচ ইলেকশন কম্পাস রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কিয়স্ককম্পাসের সাথে এক জরিপ করেছে দ্য ডিপ্লোম্যাট। উদ্দেশ্য ছিল, তাদের পাঠকদের কতজনের ব্যক্তিগত পছন্দের সাথে কোন প্রার্থী কতোটা মিলে যান– তা বের করা। কুইজে অংশ নেওয়া এশীয় পাঠকদের পছন্দের সাথে মাত্র ৩৭ শতাংশ মিল রয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের; সে তুলনায়, ৬০ শতাংশের পছন্দ মিলে যায় কমলা হ্যারিসের সাথে।
এই নির্বাচনে তাদের সরকারগুলোর পছন্দের প্রার্থী কেউ রয়েছে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে ৪১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, তাঁদের সরকার হ্যারিসকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে পছন্দ করবে। আর ৩৭ শতাংশ বলেছেন, এমন কোনো পছন্দ-অপছন্দ তাদের দেশের সরকারের রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন না। মাত্র ১৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানান, তাঁদের সরকার ট্রাম্পকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যৌক্তিক কারণেই বাকি বিশ্বের মতো এশিয়ার সরকারগুলোও ঘনিষ্ঠ নজর রাখছে। তবে এশিয়ার জনগণ ও সরকারগুলোর মধ্যে কোনো একজন প্রার্থীর প্রতি স্পষ্ট সমর্থন নেই। যেমন রয়েছে ইউরোপে। যেখানে জরিপে অংশ নেওয়া পাঠকদের ৭৭ শতাংশ জানিয়েছেন যে, তাঁদের দেশের সরকার কমলা হ্যারিসের শাসনামল দেখতেই পছন্দ করবে।
সুতরাং তাত্ত্বিকভাবে এই প্রশ্ন রাখাই যায় যে, যদি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সরকারগুলো এই নির্বাচনে ভোট দিতে পারতো– তবে কাকে দিত তারা, এবং কেনইবা তা দিত। দ্য ডিপ্লোম্যাট এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৩ দেশের সরকারের পছন্দ এই ক্ষেত্রে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে। এরমধ্যে বাংলাদেশসহ আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দেশের জনগণ ও সরকারের চিন্তাধারা তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। প্রথম পর্বে অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া
এক দশক আগেও যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট কে নির্বাচিত হচ্ছেন – তা নিয়ে ক্যানবেরার রাজনৈতিক মহলের কোনো হেলদোল ছিল না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন বিদেশনীতির কিছু কিছু অস্ট্রেলিয়া কখনো পছন্দ করেছে, কখনোবা একেবারেই মনপুত হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডেমোক্রেট বা রিপাবলিকান উভয় দলের যেই হোয়াইট হাউসের দখল নিন না কেন – তাতে খুব একটি অস্বস্তি ছিল না অস্ট্রেলীয়দের।
এক দশক পর এসে এই মনোভাবের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। অস্ট্রলিয়ার সরকার তাদের উদ্বেগ রেখেঢেকে রাখতে পারলেও– দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এরমধ্যেই ক্ষমতায় ট্রাম্পের ফিরে আসার ব্যাপারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে উদ্বেগ প্রকাশ বা আলোচনা– বর্তমানে একটি 'ওপেন সিক্রেট'।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিজস্ব প্রভাব ধরে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হয়ে বড় দান চেলেছে অস্ট্রেলিয়া। অকাস চুক্তির মাধ্যমে নিজস্ব নৌশক্তির সক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েও বড় বাজি ধরেছে দেশটি। অকাসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র কেবল অত্যাধুনিক ডুবোজাহাজের প্রযুক্তিই দেবে না– একইসঙ্গে এটি ক্যানবেরা ও ওয়াশিংটনের একইরকম বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন। কিন্তু, ট্রাম্পের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তাঁর খেয়ালখুশি অনুযায়ী সিদ্ধান্তের পাকচক্রে পড়লে– এই প্রকল্প ব্যর্থ হতে পারে। এই ব্যর্থতা ক্যানবেরার জন্য কেবল অত্যন্ত অপমানজনক-ই হবে না, এতে পুরোনো সাবমেরিন বহরকে আধুনিকায়ন করাও হবে না– ফলে চীনের নৌশক্তির বিরুদ্ধে শক্তিসামর্থ্যে বহুগুণে পিছিয়ে পড়বে।
অর্থাৎ, ট্রাম্পের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এশিয়া- প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে এমন অস্থিতিশীলতার তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে – যা অস্ট্রেলিয়ার জন্য হবে হুমকিস্বরূপ। স্বৈরাচারী শাসকদের প্রতি ট্রাম্পের প্রীতি, মিত্রদের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাসের পাশাপাশি— বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় আমেরিকার যে ভূমিকা ট্রাম্প তা বুঝতেও পারেন না, যার ফলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সাংবিধানিকতার বিরুদ্ধে তাঁর আগের শাসনামলে একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছেন, এবং বিশ্বব্যাপী এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ের পেছনে তা ভূমিকাও রেখেছে।
অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক মহলের ধারণা, হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাবে এই অঞ্চল ও অস্ট্রেলিয়া। সহজে তাঁর সাথে কাজ করাও যাবে। হ্যারিস গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক প্রতিশ্রুতিগুলোর বিষয়ে দায়বদ্ধ থাকবেন। এবিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন এমন ব্যক্তিরা তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকবেন। ফলে তার মূল নিরাপত্তা গ্যারান্টার এবং তৃতীয় বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদারের কাছে অস্ট্রেলিয়া যে স্থিতিশীলতা চায়– সেটিও পাবে। সে তুলনায়, আমদানিতে ট্রাম্পের শুল্কারোপের প্রবণতা অস্ট্রেলিয়ার রপ্তানিকারকদের জন্যও একটি বড় ঝুঁকি।
ফলে ট্রাম্প নির্বাচনে জিতলে যে গোল বাধাবেন তা নিয়ে যেমন শঙ্কিত ক্যানবেরা, তেমনি হারলেও কোন অশান্তি বাধান– তা নিয়েও দুশ্চিন্তা রয়েছে। তবে দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে তা বেশিদিন স্থায়ী হবে না বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশ
বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাইডেন প্রশাসনের সাথে সম্পর্কে তীব্র টানাপোড়েন দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের সময়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক চর্চার ব্যাপক অবনতির দিকে ঘনিষ্ঠভাবে নজর রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র, এবং তা নিয়ে স্পষ্ট বিবৃতি দিয়েও হাসিনা সরকারকে চাপে রাখে। বিশেষত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে, এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞাও দেয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলের একটি অংশ মনে করে, হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে (গণ-অভ্যুত্থানে) গোপন সমর্থন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, যা শেষপর্যন্ত তাঁর সরকারকে উৎখাত করেছে। বিদেশি হস্তক্ষেপের বিষয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে রাশিয়াও সতর্ক করেছিল হাসিনাকে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিই ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় এখন রয়েছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকার গণতান্ত্রিক সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। চলতি বছরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সম্মেলনের সাইডলাইনে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ইউনূসকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এই ঘটনা হাসিনার আমলে ভাটা পড়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের বার্তাও দেয়। একইসঙ্গে, ইউনূসের গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় ওয়াশিংটনের সমর্থনও তুলে ধরে। বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হলে ডেমোক্রেট প্রশাসনের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর জোর দেওয়ার নীতি অব্যাহত রাখবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের অনেক বিশ্লেষক অবশ্য ট্রাম্পের ক্ষমতাসীন হওয়া নিয়েও আশাবাদী। কারণ, এর আগে তিনি প্রেসিডেন্ট থাকার সময়– দুই দেশের মধ্যেকার বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব জোরালো হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়েও ওয়াশিংটনের তেমন ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
তৈরি পোশাক শিল্পের প্রতি বহুলাংশে নির্ভর করে বাংলাদেশের অর্থনীতি, যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৪০ লাখের বেশি কর্মীর। দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি বড় অংশ হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, এই প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক গুরুত্ববহ। ট্রাম্প প্রশাসনের লেনদেন-ভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি এবং সরকার পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ের চেয়ে— অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি থাকায়– বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে তেমন কোনো জটিলতার মুখে না পড়েই রপ্তানি চালিয়ে যেতে পেরেছে।
তবে দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে – রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেতে যুক্তরাষ্ট্রে জোরালো তদ্বির বা লবিং করতে পারে বর্তমানে দুর্বল হওয়া আওয়ামী লীগ। এই রাজনৈতিক দলটির (ভারতের সুবাদে) ব্যাপক প্রভাব, গোপন যোগাযোগ ও বিপুল অর্থ রয়েছে। ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে তাঁরা অনুকূল পরিবেশ পেয়ে যেতে পারে।
অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের ভিন্ন রকম প্রত্যাশারও সুযোগ আছে। হাসিনার আমলে, চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরালো হয়েছিল, বিশেষত বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায়। সেদিক থেকে চীনের বিষয়ে ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্ট এর অনমনীয় মনোভাবের ফলে প্রধান অংশীদারদের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় মুশকিলে পড়বে ঢাকা। সে তুলনায়, বাংলাদেশে চীনের কার্যক্রম সম্পর্কে ট্রাম্পের নীরবতা বাংলাদেশকে তার পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য রক্ষায় আরেকটু ছাড় দিতে পারে।
মার্কিন নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পছন্দ-অপছন্দের ইঙ্গিত না দিলেও– এটা স্পষ্ট যে ট্রাম্পের শাসন ঢাকাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বস্তির সুযোগ দিতে পারে। যেখানে সরকারের সমালোচনা কম থাকবে। কিন্তু, প্রধান উপদেষ্টার গুরুদায়িত্বে ড. ইউনূস থাকায় এবং গণতান্ত্রিক রুপান্তরের প্রতি সমর্থনের কারণে– বাংলাদেশ যে ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্টের দিকে কিছুটা ঝুঁকে আছে সেকথাও বলা যায়।
ভারত
ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ায় – এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ভারতীয়দের আগ্রহ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। একারণে ভারতের সাধারণ নাগরিকরা কমলা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাসীন পদটির অধিকারী হোন- তা যেমন দেখতে চায়, তেমনি শুধুমাত্র বংশ পরিচয়ের সুবাদে হ্যারিস তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতকে বেশি ছাড় দেবেন– এমনটা বেশিরভাগ ভারতীয়ই প্রত্যাশা করেন না।
ভারত সরকারের কোনো পছন্দ আছে কিনা এবিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে গত ১৩ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সময় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যেই হোন না কেন, আমরা তাঁর সাথে কাজ করতে পারব বলে সর্বতোভাবে আশাবাদী।'
কথাটি সত্যও। হোয়াইট হাউসের দখল যেই নিন না কেন– নরেন্দ্র মোদির সরকার তাঁর সাথে কাজ করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দুই দলের গভীর বিভাজন থাকলেও – ভারতের সাথে শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরির বিষয়ে সর্বদলীয় ঐক্যমত্য রয়েছে। ফলস্বরূপ; গত দুই দশকে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয় দলের সরকারের অধীনেই যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে।
মূলত চীনের উত্থান ঠেকাতেই ভারতের গুরুত্ব সম্পর্কে এই সর্বদলীয় ঐক্যমত্য আরও বেড়েছে। ফলে ভারতীয় এস্টাব্লিশমেন্ট আস্থা রাখে যে, ট্রাম্প বা হ্যারিস – প্রেসিডেন্ট যেই হোক– নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
তবে মোদি সরকার এ দুই প্রার্থীর মধ্যে– একজনকে কেন বেশি পছন্দ করছে – তারও স্পষ্ট কারণ আছে।
ট্রাম্প এবং মোদি দুজনেই হলেন- সামাজিকভাবে রক্ষণশীল রাজনৈতিক মতাদর্শের, এই নেতারা 'শক্তিশালী' তথা কর্তৃত্ববাদী শাসকদের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ইতঃপূর্বে ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন তাঁরা দুজনে একসাথে বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করেছেন এবং তাঁদের মধ্যে দারুণ মিলও ছিল। তাছাড়া, মোদির প্রশংসা করতে ট্রাম্পের কোনোদিন কার্পণ্যও ছিল না।
তবে প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে এইচওয়ানবি ভিসা স্থগিত করেছিলেন ট্রাম্প, যা ভারতের আইটি খাতকে বিশেষভাবে ক্ষতির মধ্যে ফেলে। ভারতে আমদানি করা মার্কিন পণ্যে উচ্চ শুল্ক থাকার জেরে – যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকারও বন্ধ করেন তিনি। ভারত যদি পাল্টা শুল্কারোপ করে– তাহলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। এইচওয়ানবি ভিসা প্রদানের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছে বাইডেন প্রশাসন। তবে নির্বাচিত হলে আবারো এটি করার কথা বলেছেন ট্রাম্প। এই অবস্থায়, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি ভারতের অভিবাসন, বাণিজ্য ও প্রযুক্তি খাতের জন্য হতে পারে দুঃসংবাদ।
অন্যদিকে, ভারত সম্পর্কে বাইডেন প্রশাসনের নীতি নির্বাচিত হলে অব্যাহত রাখতে পারেন কমলা হ্যারিস। ভারতকে সঙ্গে নিয়ে তিনি টেকসই সরবরাহ চক্র গড়ে তোলা, বাণিজ্য ও উন্নত প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে কাজ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে বাইডেনের মতোই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কঠোর বিরোধিতা অব্যাহত রাখবেন হ্যারিস। ইউক্রেন সংকটের ক্ষেত্রে ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে মোদির ঘনিষ্ঠতায় বাইডেন প্রশাসনকে ক্ষুদ্ধও করেছে। ফলে হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হলে– দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জটিলতার ক্ষেত্রে এবিষয়টি প্রভাব ফেলতে পারে।
কমলা হ্যারিসের প্রগতিশীল-উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও এসব মতাদর্শ প্রচারে তাঁর সোচ্চার ভূমিকা থাকার ঘটনাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য বেশি সমস্যাসঙ্কুল হবে বলে মনে করে ভারতীয় এস্টাব্লিশমেন্ট। মোদি সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি ও কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ট্রাম্পের তুলনায় তিনি কম ছাড় দিতে পারেন, বিশেষত ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দমনপীড়ন ও গণতান্ত্রিক অধিকারের বিষয়গুলোতে। এসব নিয়ে সমালোচনা, বিশেষত পশ্চিমা কোনো দেশের থেকে যদি তা আসে– মোদি সরকার তাঁর কঠোর প্রতিক্রিয়া জানায়। একারণে মোদি সরকারের পছন্দের অংশীদার হিসেবে হ্যারিসের চেয়ে ট্রাম্পই এগিয়ে রয়েছেন।