উহানে গেলেই কি সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে?
কোভিড-১৯ এর প্রকৃত উৎসস্থল চীনেই কিনা তা তদন্ত করতে দশজন বিজ্ঞানীর একটি টীম চীনের উহান প্রদেশে পাঠাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বেইজিং শুরু থেকেই চীনে একটি স্বাধীন তদন্ত করতে দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিদের শহরে ঢুকতে দেয়া হবে কিনা তা নিয়েও বেশ কয়েক মাস ধরে তারা সংস্থাটির সঙ্গে দফায় দফায় যুক্তিতর্ক দেখিয়ে আসছিল।
ধারণা করা হয় যে উহান শহরের পশু কেনাবেচার মার্কেট থেকেই এই ভাইরাসের উৎপত্তি।
কিন্তু ভাইরাসের উৎস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি শঙ্কা প্রকাশ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভাইরাসের প্রাথমিক প্রাদুর্ভাব গোপন করার অভিযোগে গত জানুয়ারি থেকেই চীনকে সরাসরি দায়ী করে আসছিলেন।
তদন্তের উদ্দেশ্য কী?
উহানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা বিজ্ঞানীদের দলের মধ্য থেকে একজন জীববিজ্ঞানী এপি নিউজ কে জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কাউকে দোষারোপ করার জন্য এই তদন্ত পরিচালনা করছে না, বরং তারা ভবিষ্যত সংক্রমণ রোধের জন্য এই পদক্ষেপ নিচ্ছে।
জার্মানির রবার্ট কচ ইনস্টিটিউট এর ফ্যাবিয়ান লিনডার্টজ বলেন, "এখানে সত্যিই কোনো দেশকে দোষারোপ করার কোনো ব্যাপার নেই। আমরা শুধু বুঝতে চাইছি যে সেখানে সত্যিকার অর্থে কী হয়েছিল এবং যদি সম্ভব হয় , সেসব তথ্যের উপর ভিত্তি করে আমরা সমূহ বিপদ কমানোর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবো।"
ডা. লিনডার্টজ আরও বলেন, এই তদন্তের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাইরাসের সঞ্চলন আসলেই উহানে হয়েছে কিনা তা বুঝা । এই মিশনটি চার বা পাঁচ সপ্তাহ দীর্ঘ হবে বলে তিনি জানান।
কোথায় ও কখন প্রথম শনাক্ত হলো ভাইরাস?
ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে বলা হয়, চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানের তথাকথিত 'ওয়েট মার্কেট' থেকেই ভাইরাসটি প্রথম পশুর থেকে মানব শরীরে সংক্রমিত হয়।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এখন মনে করেছেন যে উহান সম্পর্কে এই খবরটি হয়তো কিছুটা অতিরঞ্জিত করে ছড়ানো হয়েছে।
গবেষণা বলছে, বাদুড়ের শরীর থেকে মনুষ্যদেহে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা হয়ত বহু দশক ধরেই চলে আসছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে লি ওয়েনলিয়াং নামের একজন চীনা ডাক্তার তার সহকর্মীদের সতর্ক করেন যে একটি মহামারি হয়তো আসতে পারে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তার এই কথাকে কানে তোলেনি, বরং 'গুজব ছড়ানো'র অভিযোগে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
ডা. লি ফেব্রুয়ারিতে তার রোগীদের চিকিৎসা করতে করতে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
এপ্রিলের দিকে সন্দেহ করা হয় উহানের একটি ল্যাবরেটরিতে লীকেজ এর মাধ্যমেই হয়ত করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
চীনের গনমাধ্যম সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে জানায় যে ভাইরাসের উৎপত্তি চীনের বাইরে থেকেও শুরু হতে পারে।
কিন্তু বিশ্লেষণে দেখা যায় যে এসব রিপোর্ট একেবারেই ভিত্তিহীন। এছাড়াও এই রিপোর্ট প্রমাণ করে বেইজিং এ ক্ষমতার প্রভাব নিয়ে যে সূক্ষ প্রতিযোগিতা চলছে তা মহামারিকালে দেশটির আন্তর্জাতিক খ্যাতি ক্ষুণ্ন করছে।
উহানে যেতে পারলেই কি সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে?
এই প্রশ্নের বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসি'র স্বাস্থ্য সংবাদদাতা নাওমি গ্রিমলে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের উৎপত্তি অনুসন্ধানের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভৌগলিক রাজনীতি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিয়ে নানা সমস্যা।
ট্রাম্প প্রশাসন শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছিল যে ডব্লিউএইচও চীনের প্রতি বেশি নরম সুরে কথা বলছে। অন্যদিকে মহামারি নিয়ে তাদের নানা পদক্ষেপ এর প্রশংসা করে যাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা।
এছাড়াও অন্য অনেক দেশও মনে করছে যে চীন, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে একটি সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। এপি সম্প্রতি একটি ভিডিও কলের তথ্য প্রকাশ করেছে যেখানে ডব্লিউএইচও এর কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন যে তারা চীনের কাছ থেকে পর্যাপ্ত ও সঠিক তথ্যাদি পাচ্ছেন না। এমনকি উহানে যাওয়ার ব্যাপারেও চীন রাজি হচ্ছে না।
তাই উহানে যাওয়ার কাজটি যদি সফল হয় তাহলে টা সম্ভবত খুব মূল প্রশ্নগুলোই সামনে রাখবে। ভাইরাস কি সত্যিই বাদুড় থেকে এসেছে? বাদুর ও মানুষের মধ্যে সংযোগের ক্ষেত্রে কি অন্য কিছু মধ্যস্থকারী হিসেবে ছিল? উহানের পশু বিক্রির বাজারই কি প্রাথমিক প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্র ছিল?
ভাইরাস সম্পর্কে চীনের দেয়া রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
জানুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইমার্জেন্সি প্রোগ্রামের প্রধান ডা. মাইক রায়ান করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীনের নেয়া নানা কার্যক্রমের প্রশংসা করেন।
বেইজিং খুব দ্রুত ভাইরাসের জেনেটিক কোড বের করে এবং তা সবাইকে জানানোর মাধ্যমে ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করেছে।
মার্চে চীনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ডা. গাডেন গ্যালিয়া বিবিসিকে বলেন যে ভাইরাস মোকাবিলায় কিছুটা 'ঘাটতি'রয়েছে, তবে বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যতে আরো কার্যকরী উপায় বের করবেন।
পরবর্তীতে ট্রাম্প সরাসরি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিকেই প্রশ্নের তীর ছুড়ে দেন যে কেন তারা এতটা 'চীন-কেন্দ্রিক' হয়ে কথা বলছে।
অন্যদিকে নভেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারক দল গঠন করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে সংযুক্ত রাখতে।