মিটিং অনলাইনে, কিন্তু কাগজে ব্যাগ কিংবা এর জন্য নগদ টাকা- ঠিকই আছে
মাত্র ৯ দিনে অনলাইনে ৩০ কর্মশালায় অংশ নিয়ে কাগজে-কলমে ৩০টি করে অফিস ব্যাগ পেয়েছেন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রথম শ্রেণীর প্রত্যেক কর্মকর্তা। যেহেতু কোনো মানুষের এত ব্যাগের প্রয়োজন হয় না, সে কারণে ব্যাগের পরিবর্তে তারা নগদ টাকা নিয়েছেন। আবার এ ব্যাগের টাকা উঠানো হয়েছে ভুয়া বিল (ক্যাশ মেমো) দিয়ে।
প্রয়োজন না থাকলেও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে প্রকল্প মূল্যায়নের কর্মশালায় অযৌক্তিক খাতে বরাদ্দ রাখছে আইএমইডি। ব্যাগ কেনা বাবদ জমা দেওয়া হয়েছে ভুয়া বিল।
সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে ক্রয় সংক্রান্ত অনিয়ম খুঁজে বের করার দায়িত্ব পালন করে আইএমইডি। আবার তারাই ভুয়া বিল জমা দিয়ে অনিয়ম করেছে।
এ ঘটনা নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে এমন ঘটনা ঘটে আসছে আইএমডিতে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুনে কর্মশালার নামে আইএমইডির প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তারা নিয়েছেন ৭২টি করে ব্যাগের টাকা। ব্যাগের টাকার সঙ্গে ফোল্ডার, কলম ও প্যাডের টাকাও রয়েছে। এর আগে ২০১৮-১৯ বছরের জুনে ৪৮টি করে ব্যাগের টাকা নেয়া হয়।
আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বেসরকারি ফার্ম নিয়োগ নিয়ে ২০১০ সাল থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রকল্প মূল্যায়ন করে আসছে আইএমইডি। বেসরকারি ফার্ম মূল্যায়ন প্রতিবেদনে আইএমইডির কর্তকর্তারা মতামত দেন। এর জন্য কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
কর্মকর্তারা কর্মশালায় অংশগ্রহণ না করলেও তাদের সম্মানিসহ বিভিন্ন উপকরণের টাকা বরাদ্দ থাকে। গত বছরের জুনে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে অনলাইন প্লাটফর্মে অংশ নিয়েও খাবার বিলসহ অন্য বিলের টাকা নেওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে আইএমইডি। সমালোচনার মুখে আউটসোর্সিংয়ের প্রকল্প মূল্যায়নের সংখ্যা ৭২ থেকে ৩০ এ নামিয়ে আনা হয়। এছাড়া আউটসোর্সিংয়ের কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ১২০ জন থেকে কমিয়ে ৮০তে নামিয়ে আনা হয়।
এবার অনলাইন কর্মশালায় খাবার বিল বাদ দেওয়ার কারণে সরকারের ২৮ লাখ টাকা বেঁচে গিয়েছে বলে আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২০-২১) মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ওপর অনলাইন প্লাটফর্মে জুনের ৬ থেকে ১৫ তারিখ এসব কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। একদিনে চারটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপ্যায়ন বিল বাদ দিলেও কিছু অপ্রয়োজনীয় খাতে এবারও বরাদ্দ রেখেছে আইএমইডি।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে আইএমইডির আউটসোর্সিংয়ের বাজেটে প্রতিটি কর্মশালায় ব্যাগ ফোল্ডার, কলম ও প্যাড বাবদ বরাদ্দ ছিল ১৪৪০০০ টাকা। ৩০টি কর্মশালায় এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৪,৩২০,০০০ টাকা।
ভুয়া বিল
আউটসোর্সিংয়ের শর্ত অনুযায়ী কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের ব্যাগ বা অন্যান্য সামগ্রির অর্থ ব্যয় করে বেসরকারি ফার্ম। পরে তারা আলাদা আলাদাভাবে ৩০টি ক্রয় কাজের বিলের কপি আইএমইডির সংশ্লিষ্ট সেক্টরে জমা দেয়। এসব বিলে বেসরকারি ফার্ম ও আইএমইডির সংশ্লিষ্ট সেক্টরের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর থাকে। আইএমইডির সেক্টর থেকে এ বিল পাঠানো হয় আইএমইডির হিসাব শাখায়। টিবিএসের হাতে এমন বেশ কয়েকটি বিল এসেছে।
ডাটা ডেভলপমেন্ট সার্ভিস (ডিডিএস) নামে একটি বেসরকারি ফার্ম এবার জলাশয় উন্নয়নের মাধ্যমে মৎস্য চাষ প্রকল্পের মূল্যায়নের দায়িত্ব পায়। আইএমইডিতে এ প্রতিষ্ঠান ব্যাগ কেনা বাবদ ১৪৪০০০ টাকার বিল জমা দেন। তারা ব্যাগের বাইরে ফোল্ডার, কলম বা প্যাড কেনেনি।
জমা দেওয়া ক্যাশ মেমো অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি ৭ জুন নিউ মার্কেটের জি আহমেদ নামে ২৭৮ নাম্বার দোকান থেকে ৮০টি ব্যাগ কিনেছে। ক্রেতার নামের স্থানে লেখা 'ডিডিএস'। ঠিকানা উল্লেখ ছিল- 'জলাশয় মৎস্য প্রকল্প'। সরেজমিনে ওই দোকানে গিয়ে বিলের কপি দেখানো হলে, ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম বলেন, ওই ক্যাশ মেমো তাদের নয়। এছাড়া চলতি মাসে এ নামে বা এ ঠিকানায় কোনো ব্যাগ বিক্রি করা হয়নি।
তিনি উল্লেখ করেন, তাদের দোকানের ঠিকানায় ভুয়া ক্যাশ মেমো ব্যবহার করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ডিডিএসের কর্ণধার মোস্তাক আহমেদ বলেন, আইএমইডির মৌখিক নির্দেশ অনুযায়ী তারা ব্যাগের বদলে কর্মকর্তাদের নগদ টাকা দিয়েছে। আর বিল আইএমইডি তৈরি করেছে।
এদিকে গ্রামীণ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্পের মূল্যায়নের কাজ করছে পার্টিসিপেটরি ম্যানেজমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ফর ডেভেলপমেন্ট (পিএমআইডি)।
মোহাম্মদপুরের টাউন হলে অবস্থিত শহীদ পার্ক মসজিদ মার্কেটের একটি দোকান থেকে তারা ৮০টি ব্যাগ কিনেছে । ফোল্ডার, কলম বা প্যাড কেনা হয়নি। ওই দোকানের স্বত্বাধিকারী মো মিরাজ হোসেন বলেন, তারা ব্যাগ বিক্রি করে না, সুতরাং ব্যাগ সরবরাহ করার কোনও প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, পিএমআইডি তাদের কাছ থেকে কেবল ক্যাশ মেমো সংগ্রহ করেছিল।
আবার, ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপটিভ সার্ভিসেস ডেলিভারী প্রোগ্রাম (সিসিএসডিপি) কর্মসূচির মূল্যায়ন কাজে দায়িত্ব পালন করেছে ইন্টিগ্রেটেড সলিউশানস লিমিটেড নামে একটি ফার্ম। তাদের জমা দেওয়া ক্যাশমেমো অনুয়ায়ী বেসরকারি ফার্মটি জে আই কর্পোরেশন নামক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২ জুন ব্যাগ, ফোল্ডার কলম কিনে।
প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ছিল ১২/১৩ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা। সরেজমিনে ওই ১২/১৩ হোল্ডিংয়ের রহমান চেম্বারে গিয়ে জে আই কর্পোরেশন নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি।
রহমান চেম্বারের দারোয়ান কবির মিয়া জানান, প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি এখানে কাজ করছেন। জিআই কর্পোরেশন নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। কখনো ছিল বলেও তার মনে পড়ে না।
একই ধরণের মন্তব্য করেন আমিনুল, সবুজসহ ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা।
ক্যাশমেমো দেওয়া সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নাম্বারে ফোন করলে সুশান্ত বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তি জানান, তিনি ফরিদপুরে থাকেন, উচ্চ মাধ্যমিকে পড়েন। জে আই কর্পোরেশন নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম তিনি শুনেননি।
আবার একই ক্যাশমেমো বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের যে ইমেইল ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, তা ইন্টিগ্রেডেড সলিউশানসের কর্ণধার আহসান দেওয়ানের নামে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আহসান দেওয়ান কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জমা দেওয়া এ ৩টি ক্যাশমেমোই ভুয়া বলে নিশ্চিত করেছে আইএমইডির একটি সূত্র। টিবিএসের হাতে এ ধরণের আরো কিছু ভুয়া ক্যাশমেমো রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইএমইডির সঙ্গে আউটসোর্সিংয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি ফার্মের কর্মকর্তা জানান, তারা গত পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন। তারা কর্মশালার জন্য কখনো ব্যাগ কিনেন নি। সব সময় নগদ টাকা দিয়ে আসছে্ন। পরে ভুয়া বিলের কপি জমা দিয়েছেন। এটা করা হচ্ছে আইএমইডির পরামর্শ অনুযায়ী।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাগ, ফোল্ডার, কলম কেনা বাবদ ১.৩৮ কোটি টাকার বিল করা হয়। এ খাতে তার আগের অর্থবছরে ভুয়া বিল করা হয় ৯২ লাখ টাকার।
এত ব্যাগের প্রয়োজন আছে কি
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কর্মকর্তারা যদি তাদের জন্য বরাদ্দ অনুযায়ী ব্যাগ ব্যবহার করতো, তাহলে প্রতি ১২ দিনে একটি নতুন ব্যাগ ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
২০১৯-২০ অর্থবছরের জুনে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তারা যে ব্যাগ (৭২টি) পেয়েছে , তা প্রতি পাঁচ দিনে একটি করে ব্যবহার করলেও শেষ হওয়ার কথা নয়।
এ ক্ষেত্রে আইএমইডির বক্তব্য হলো- সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী কর্মশালায়, সেমিনারে ব্যাগ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। সে অনুযায়ী তারা এই ব্যাগের এই টাকা নিচ্ছেন। এটা অবৈধ নয়। এছাড়া ব্যাগের মূল্য বেশি নয় বলেও মন্তব্য করেছেন আইএমইডির অনেক কর্মকর্তা।
বাস্তবে কি কোনো সরকারি কর্মকর্তার এত ব্যাগের প্রয়োজন হয়? জানতে চাইলে আইএমইডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, প্রয়োজন হয় না বলেই তারা ব্যাগের পরিবর্তে টাকা নিয়ে নিচ্ছেন। আর ব্যাগের ভুয়া বিল আইএমডি থেকে সরকারি হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন সেমিনার বা কর্মশালায় অংশ নিয়ে ১৫টির বেশি ব্যাগ পেয়েছেন তিনি। এসব ব্যাগ ব্যবহার করা হয় না। এ কারণে আউটসোর্সিংয়ের কর্মশালায় ব্যাগের পরিবর্তে তারা টাকা নিয়ে নিচ্ছেন।
আইএমইডির অন্য এক কর্মকর্তা জানান, আইএমইডির কর্মকর্তারা অনেক বেশি কাজ করেন। এ কারণে এটা একটা প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হয়।
অন্য এক কর্মকর্তা জানান, এটা বৈধ তবে অনৈতিক। এ কারণে আউটসোর্সিংয়ের বাজেট ব্যবস্থাপনা থেকে এটা বাদ দেওয়া প্রয়োজন। যেমন- গতবছর কর্মশালায় আপ্যায়ন বিল ধরা হয়েছিল, চলতি অর্থবছর তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে গত অর্থবছর কর্মশালা এবং ব্যাগের সংখ্যা কমলেও চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুনে আবারও ৭২টি করে ব্যাগ পাবেন বলে আশা করছেন তারা। কারণ আগামী অর্থবছরে কর্মশালার সংখ্যা আবারও বাড়ানোর উদ্যোগ রয়েছে বলে আইএমইডি সূত্র জানিয়েছে।
জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে আইএমইডির অতিরিক্ত সচিব ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামানসহ আইএমডির মহাপরিচালকরাও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "ব্যয়ের প্রয়োজন নেই , তারপরও ব্যাগের টাকা বাবদ টাকা নিয়ে যাচ্ছেন কর্মকর্তারা। আবার ভুয়া বিলও দেওয়া হচ্ছে। এটা অবশ্যই দুর্নীতি। আর দুর্নীতি ছোট-বড় হিসাব করা যাবে না। সব দুর্নীতিই সমান। আইএমইডির মতো সংগঠনের এ ধরনের অনিয়ম মেনে নেওয়া যায় না। তারা সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প মনিটরিং করে। তাই তাদের কাজে স্বচ্ছতা থাকতে হবে"। এ সময় এমন অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।