এখনো পুরান ঢাকাবাসীর পছন্দের শীর্ষে মিরকাদিমের বুইট্টা ও ধবল গরু
ধলেশ্বরী ও ইছামতির তীরে অবস্থিত মুন্সীগঞ্জ সদরের মিরকাদিম পৌরসভা। ধলেশ্বরী তীরবর্তী মিরকাদিমের একপাশে রয়েছে প্রাচ্যের ড্যান্ডি নারায়ণগঞ্জ। অপরদিকে রয়েছে ঢাকার কেরাণীগঞ্জ। পৃথক দু'টি নদীর তীরবর্তী এ মিরকাদিমের ধবল ও বুইট্টা গরু কোরবানিতে পুরান ঢাকাবাসীর কাছে বেশ প্রিয়।
ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ বছর উভয় জাতের গরুর লালনপালনে বেশ আগ্রহ দেখা গেছে মিরকাদিমের খামারিদের। ঈদ সামনে রেখে ধবল ও বুইট্টা গরু নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের। ঢাকার রহমতগঞ্জের কোরবানীর পশুর হাটেই মূলত মিরকাদিমের ধবল ও বুইট্টা জাতের গরুর পসরা বসে থাকে। এ পশুর হাট ঘিরেই মিরকাদিমের খামারিরা প্রায় এক বছর আগে থেকে ধবল ও বুইট্টা গরু লালনপালন শুরু করে থাকেন। এখন আর মিরকাদিম জুড়ে আগের মত এ গরু লালনপালনের চিত্র দেখা যায় না। তারপরও এ বছর অন্তত ডজনখানেক খামারি মিরকাদিম পৌরসভার রামগোপালপুর ও এনায়েতনগর গ্রামে ধবল ও বুইট্টা গরু লালনপালন করে আসছেন।
এদিকে ক্রমাগত লোকসান ও গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে অনেকে এ পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় খামারের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। এক কথায় মিরকাদিমের ধবল গরু ও বুইট্টা গরু এখন বিলুপ্তির পথে। তবে ধবল গরুর পাশাপাশি নেপালি, হাঁসা, পশ্চিমা ও সিন্ধি জাতের গরু পাওয়া যায় মিরকাদিমে।
স্থানীয় খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশেষ কৌশলে পালন করায় এসব গরুর গোশত সুস্বাদু হয়। সাধারণত খৈল, ভুষি, খুদ ইত্যাদি খাওয়ানো হয় এবং স্বাস্থ্য ভালো করার জন্য গরুগুলোর বিশেষ যত্ন নেয় খামার মালিকরা। তাই দাম এবং চাহিদাও বেশি।
পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জসহ রাজধানীর বড় বড় হাটে এসব গরুর দেখা মিলবে কোরবানি হাটে। তবে কয়েক বছর ধরে পুরান ঢাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা ঈদের কয়েক মাস আগেই চলে আসেন গরু কিনতে মিরকাদিমে। তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পছন্দ হলেই গরু ক্রয় করে ফেলেন এবং ঈদ পর্যন্ত গৃহস্থদের তা পালনের দায়িত্ব ও খরচ দিয়ে যান। ফলে কোরবানির হাটে ওঠার আগেই অনেক গরু বিক্রি হয়ে যায়। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলো এখনও মিরকাদিমের গরু কোরবানিকে পারিবারিক ঐতিহ্য মনে করে থাকেন।
খামারিরা জানান, অন্যান্য অঞ্চলে বুইট্টা গরু পাওয়া গেলেও মিরকাদিমের বুইট্টা গরুর বৈশিষ্ট্য আলাদা। আকারে ছোট হলেও এই গরুর চেহারা দেখলেই বুঝা যাবে গোশতের সাধ কেমন। এর বাহ্যিক অবয়ব খুব তেলতেলে ও গোলাকৃতির হয়। গোশত মোলায়েম ও সুস্বাদু। এছাড়া নেপালি গরুর উচ্চতা খুবই আকর্ষণীয়।
সিন্ধি গরুর চাহিদা বিশ্বব্যাপী। সেটাও এখানে পাওয়া যায়। তারা আরও জানান, মিরকাদিমের গরুর চাহিদা দেখে কোরবানি ঈদের ৬ থেকে ৭ মাস আগেই তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছোট ও বাছাই করা গরু কিনে নিয়ে আসেন।
মিরকাদিম এগ্রোর মালিক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, 'অনেক দিন এ পেশা থেকে সরে ছিলাম, এখন আবার গেল দুই বছর ধরে নিয়মিতভাবে গরু পালন করছি। সাদা বুইট্টা গরু হলো 'চয়েজের' উপর বিক্রি। এটার দাম বলতে কিছু নেই। এটা শুধু চয়েজের উপর বিক্রি করি। বুইট্টা গরু দেখতে অনেক সুন্দর আর এর উপরেই দাম হাঁকানো হয়। তবে একেকটা বুইট্টা গরুর দাম ৮০ হাজারেরও বেশি হয়ে থাকে। আমার খামারে ৮টা বুইট্টা গরু রয়েছে। দাম ভালো পেলে আগামীতে আরও বেশি করে পালন শুরু করবো'।
বিল্লাল হোসেন বলেন, 'আমার খামারে ৪ ধরনের গরু আছে। গত বছর আমাদের লোকসান গুনতে হয়েছে। এবারও করোনার প্রভাব বেশী। যদি ভারত থেকে গরু না আসে তাহলে আমাদের লোকসান গুনতে হবে না। গোখাদ্যের যে পরিমাণ দাম এতে গরু লালনপালন শেষে কিছুই থাকছে না। আমার খামারে নিয়মিত ৮ জন লোক কাজ করছে'।
আরেকজন খামারি ইমন বেপারী বলেন, 'মিরকাদিমের ঐতিহ্য হলো ধবল ও বুইট্টা গরু এবং মিরকাদিমের হাফসা। আমাদের মিরকাদিমে আগে প্রচুর খামারি বুইট্টা ও ধবল গরু লালন পালন করতো। আস্তে আস্তে খামারিরা অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছে। কারণ লোকসান হলে অনেক টাকার ঋণে পড়তে হয়। এবারও করোনার কারণে গরু বিক্রি নিয়ে আতঙ্কে রয়েছি। যদি লকডাউন বাড়ানো হয় তাহলে আমাদের প্রচুর সমস্যা হবে। আমার খামারে ৭০টি গরু রয়েছে। এর মধ্যে বুইট্টা গরু রয়েছে ২০টি। ধবল রয়েছে ৩০টির মতো। আমরা দুই ভাই মিলে গরু পরিচর্যা করি'।
তিনি জানান, একটি বুইট্টা ও ধবল গরু আকারভেদে ২৫ হাজার টাকা থেকে ৬০ হাজার টাকায় কিনে এনে থাকেন খামারিরা। প্রায় ৮ মাস লালন-পালন করেন তারা এ গরু। কোরবানির হাটে সব খরচ মিলিয়ে ছোট আকারের একটি বুইট্টা ও ধবল গরু বিক্রি হয় ৬০ হাজার টাকায়। এছাড়া বড় আকারের একেকটি গরু আড়াই লাখ টাকা থেকে ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারেন। এতে গরুর আকারভেদে ১৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা লাভ করে থাকেন খামারিরা। তিনি আরও জানান, কোরবানির ঈদের দু'য়েকদিন আগে ঢাকার রহমতগঞ্জের হাটেই শুধু মাত্র এ গরু নিয়ে থাকেন তারা।