রিসাইক্লারদের জন্য পর্যাপ্ত প্লাস্টিক বর্জ্য নেই
বিশ্বের অব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ বর্জ্য বাংলাদেশে উৎপন্ন হলেও দেশের প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানাগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য যেমন পিইটি ফ্লেক্স, পিএসএফ (পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার), পলিয়েস্টার ইয়ার্ন এবং পলিয়েস্টার ফেব্রিক তৈরির কাঁচামাল হিসেবে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করতে পারছে না।
বাংলাদেশে প্রতি বছর আট লাখ ২১ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি হলেও এর মাত্র ৩৬ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়। অন্যদিকে, পাঁচ লাখ ২৭ হাজার টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য ল্যান্ডফিল ও উন্মুক্ত পরিবেশে ফেলা হয় বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি গবেষণা।
রিসাইক্লারদের দাবি, দেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় অর্ধেক রিসাইক্লিং করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত সরবরাহের অভাবে তাদের কার্যক্ষমতা অব্যবহৃত থাকছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে দেশে প্রায় ৩০০ প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা রয়েছে। এদের মধ্যে ৮০টির বেশি প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা বছরে প্রায় ৪০ হাজার টন ফ্লেক্স রপ্তানি করে।
সম্প্রতি দেশে ছয় থেকে সাতটি প্রতিষ্ঠান পিএসএফ, পলিয়েস্টার ইয়ার্ন, পলিয়েস্টার ফেব্রিক, নন ওভেন ফেব্রিক পণ্য উৎপাদনের জন্য বড় বিনিয়োগ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মামানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ লি, মালিহা পলি টেক্স ফাইবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আম্বার পিএসএফ লিমিটেড, প্লাস্টো হাই টেক ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি।
তবে, পর্যাপ্ত কাঁচামাল না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদনে গতি আনতে পারছে না। ফলে, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানি আয়। যে কারণে তারা সরকারের কাছে দেশের বাইরে থেকে পেট বোতল স্ক্র্যাপ, পেট ফ্লেক্স আমদানির অনুমতি চাইছে। তবে, এখন অবধি কোনো সবুজ সংকেত পায়নি প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সক্ষমতা বিবেচনায় দেশে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ টন প্লাস্টিক স্ক্র্যাপের চাহিদা তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় সরবরাহ ও আমদানি যোগ করে প্রতিবছর দেশে পেট প্লাস্টিক স্ক্র্যাপের সরবরাহের পরিমাণ ৭০ হাজার টন, যা স্থানীয় চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় পেটফ্লেক্স ও পিএসএফ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ড সুবিধায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পেট প্লাস্টিক স্ক্র্যাপ আমদানি করতে পারে। তবে, ইপিজেডের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর স্ক্র্যাপ আমদানির ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন পড়ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড টেরিফ কমিশনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে প্রতিবছর পেট বোতল উৎপাদনের জন্য প্রায় এক লাখ টন প্লাস্টিকের পেট বোতল তৈরির কাঁচামাল আমদানি করা হয়। এর প্রায় ২০ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হলেও বাকি ৮০ শতাংশ ব্যবহারের পর প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। প্রতি বছর এখান থেকে প্রায় ৭৫ হাজার টন পেট প্লাস্টিক স্ক্র্যাপের সরবরাহ পাওয়া যায়, যা এই ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আম্বার পিএসএফ লিমিটেড এক লাখ ২০ হাজার স্কয়ার ফিট জায়গার ওপর তাদের কারখানা স্থাপন করেছে। ভারি মেশিনারি লাগিয়ে প্রডাকশন লাইন তৈরি করেছে তারা। প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় পর্যায় থেকে কিছু কাঁচামাল সংগ্রহ করে নামমাত্র উৎপাদনে রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ম্যানেজার মো. দিদার হোসেন টিবিএসকে বলেন, "আমরা বিনিয়োগ করে বিপাকে পড়েছি। চাহিদা অনুযায়ী আমরা কাঁচামাল পাচ্ছি না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে কাঁচামাল আমদানির অনুমতি চেয়েছি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সেটি ঝুলে আছে। প্রতিনিয়তই আমাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে না পারার জন্য।"
মালিহা পলি টেক্স ফাইবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বিনিয়োগ করেছে ২০০ কোটি টাকা। তারা পিএসএফ থেকে ইয়ার্ন তৈরি করছে। স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে কিছুটা উৎপাদনে থাকলেও সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারছে না এই প্রতিষ্ঠান। তারাও কাঁচামাল আমদানির অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছে। একই অবস্থায় রয়েছে মুমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
বছর দুয়েক আগে প্লাস্টো হাই টেক ইন্ডাস্ট্রির অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন শুরু করতে পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, বিডা এবং বন্ড লাইসেন্স পেলেও কাঁচামাল আমদানির অনুমতি পায়নি।
হাই টেকের উদ্যোক্তা এ এইচ হাফিজ আহমেদ বলেন, "আমার কারখানায় ছয় থেকে সাতটি প্রডাকশন লাইন তৈরির মত জায়গা নেওয়া হয়েছে। একেকটি লাইন তৈরি করতে ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ ডলার খরচ পড়বে। শতভাগ রপ্তানিনির্ভর একটি কারখানা এটি।"
তিনি বলেন, "আমি যদি কাঁচামালের যোগান নিশ্চিত করতে না পারি, তবে মেশিন এনে তো কোনো লাভ হবে না। এই খাতের অনেকেই কাঁচামালের অভাবে সমস্যায় পড়েছে। আমার এই প্রাথমিক বিনিয়োগও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।"
এদিকে, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে পিএসএফ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কাঁচামাল আমদানির অনুমতি প্রদানের কথা সুপারিশ করা হয়েছে।
কোনো প্রতিষ্ঠান যেন সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত আমদানি করতে না পারে, তা দেখভালের জন্যও ট্যারিফ কমিশনকে নজরদারির দায়িত্ব প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে, বোতল স্ক্র্যাপ, পেট ফ্লেক্স ব্যতীত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু যাতে আমদানি না হয় সে লক্ষ্যে কিছু বিশেষায়িত পণ্যের মতো খালাসের পূর্বে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ইন্সপেকশন বাধ্যতামূলক করার কথাও বলা হয়েছে।
পেট বোতল ফ্লেক্স ও পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার রপ্তানির বিপরীতে বর্তমানে ১০ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। উৎপাদিত ফ্লেক্স ও পিএসএফ বেশিরভাগই চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, ইউরোপের বেশ কিছু দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পেট ফ্লেক্স থেকে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা ব্যপক হারে বাড়ছে। প্লাস্টিক স্ক্র্যাপের ক্ষতি থেকে পরিবেশ রক্ষার্থে বিশ্বের বিভিন্ন ব্র্যান্ড যেমন অ্যাডিডাস পারলি, গার্লফ্রেন্ড কালেকটিভ, অলবার্ডস, এভারলেন, নাইকির মতো প্রতিষ্ঠান রিসাইকেলড স্ক্র্যাপ থেকে উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি করছে।
রিসাইক্লিং পদ্ধতি
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিকট থেকে অব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করে ফ্লেক্স উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান চার ধাপে (কাটিং, কোল্ড ওয়াটার ওয়াশিং, ড্রায়ারের মাধ্যমে ড্রাইং ও প্যাকেজিং) প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। উৎপাদিত বেশিরভাগ ফ্লেক্স রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। কিছু আবার স্থানীয় পিএসএফ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, পিএসএফ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দেখা যায়, ফ্লেক্স সংগ্রহ বা উৎপাদনের পর নয় ধাপে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পিএসএফ তৈরি করা হচ্ছে।
সেক্টর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিএসএফ মূলত পলিয়েস্টার ইয়ার্নের প্রাথমিক কাঁচামাল। পিএসএফকে কয়েক ধাপে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পলিয়েস্টার ইয়ার্ন প্রস্তুত করা হয়। পলিয়েস্টার ইয়ার্ন থেকে জিওটেক্সটাইল, পলিয়েস্টার ফেব্রিক ও ওভেন ফেব্রিক উৎপাদন করা হয়।
বাংলাদেশে স্কয়ার সিনথেটিক লিমিটেড, বেক্সিমকো সিনথেটিক লিমিটেড, সিমকো লিমিটেড ও এলকে কটনের মতো শতভাগ রপ্তানিমুখী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সিনথেটিক পলিয়েস্টার সুতা প্রস্তুত করতে কাঁচামাল হিসেবে পিএসএফ ব্যবহার করে।