প্যান্ডোরা পেপারস ফাঁসের সহজপাঠ
বিশ্বের কয়েকশো ধনকুবের ও প্রভাবশালী নেতার গোপন সম্পদ ও আর্থিক লেনদেন ফাঁস করেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক জোট আইসিআইজে। প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ নথি ফাঁস করেছে আইসিআইজে। এসব নথির নাম দেওয়া হয়েছে প্যান্ডোরা পেপারস।
১১৭টি দেশের ৬০০ জনের বেশি সাংবাদিক মাসের পর মাস ধরে কাজ করেছেন এই কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আনার জন্য। ১৪টি উৎস থেকে পাওয়া দলিলপত্র ঘেঁটে তারা তুলে এনেছেন প্রভাবশালী নেতা-ধনকুবেরদের অপকীর্তির প্রমাণ। এই সপ্তাহে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হবে সেসব কেলেঙ্কারির আখ্যান।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অভ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) ১৪০টি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে মিলে এই কেলেঙ্কারির প্রকাশ্যে এনেছে। এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক প্যান্ডোরা পেপারস সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
কী কী জানা গেল?
প্যান্ডোরা পেপারস লিকে রয়েছে ৬৪ লাখ ডকুমেন্ট, প্রায় ৩০ লাখ ছবি, ১০ লাখের বেশি ইমেইল এবং প্রায় ৫ লাখ স্প্রেডশিট। এখন পর্যন্ত এসব দলিল থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলোর মধ্যে আছে:
- জর্ডানের বাদশা গোপনে যুক্তরাজ্য, আমেরিকা ও মালিবুতে ১০ কোটি ডলারের সম্পদ করেছেন। এ সম্পদ তিনি করেছেন নিজস্ব মালিকানাধীন গোপন কোম্পানির মাধ্যমে।
- আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের পরিবার যুক্তরাজ্যে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের জমি ও বাড়ি কেনাবেচার চুক্তিতে জড়িত ছিলেন।
- চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেই ব্যাবিস গোপনে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে ১২ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে একটি অফশোর কোম্পানি মারফত দুটি বাড়ি কিনেছেন।
- কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা দশকের পর দশক ধরে গোপন অফশোর কোম্পানি দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে গেছেন
- মোনাকোতে গোপন সম্পদ করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সভেৎলানা ক্রিভোনোগিখ পুতিনের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশে পাচার করেছেন।
- লন্ডনে অফিস কেনার সময় তিন লাখ পাউন্ড কর ফাঁকি দিয়েছেন টনি ব্লেয়ার।
অফশোরে টাকা লুকানো একেবারেই সহজ। আপনাকে শুধু কোনো করস্বর্গে অত্যন্ত গোপনে একটা শেল কোম্পানি খুললেই চলবে। এ ধরনের কোম্পানির অস্তিত্ব কেবল কাগজে-কলমেই থাকে, কোনো কার্যালয় বা কর্মচারী থাকে না।
প্যান্ডোরা পেপারস থেকে জানা গেছে, ৯০টি দেশের ৩৩০ জনের বেশি প্রভাবশালী নেতা তাদের সম্পদ গোপন করার জন্য অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করেন। এই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বেনামি কোম্পানি ব্যবহার করে অর্থ পাচার করেন।
'অফশোর' কী?
প্যান্ডোরা পেপারস অনেকগুলো কোম্পানির এক জটিল নেটওয়ার্ক ফাঁস করেছে। এই কোম্পানিগুলো অর্থ পাচারকারী ও সম্পদ গোপন করা ব্যক্তিদের দেশের বাইরে অবস্থিত।
উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক, কারও বাংলাদেশে একটা সম্পত্তি আছে। কিন্তু সেই ব্যক্তি ওই সম্পত্তির মালিকানা ধরে রেখেছে অন্য দেশের, অর্থাৎ 'অফশোর' কোম্পানির মাধ্যমে।
অফশোর দেশ বা অঞ্চলগুলোতে:
- কোম্পানি খোলা সহজ
- এমন আইন থাকে, যার কারণে ওই কোম্পানির মালিককে শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন
- কর্পোরেশন কর খুবই কম, কিংবা একেবারেই থাকে না।
এরকম অঞ্চলগুলোকে সাধারণত করস্বর্গ বলা হয়। করস্বর্গের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে করস্বর্গ হিসেবে সবচেয়ে সুপরিচিত অঞ্চলগুলো হলো কেম্যান আইল্যান্ড ও ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো ব্রিটিশ অঞ্চল এবং সুইজারল্যান্ড, পানামা, দুবাই, মোনাকোর মতো দেশ।
করস্বর্গ ব্যবহার করা কি বেআইনি?
আইনের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে অনেকেই কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য তাদের অর্থ করস্বর্গগুলোতে সরিয়ে ফেলেন অথবা সেখানে কোম্পানি খোলেন। কিন্তু এই কাজকে অনৈতিক হিসেবে দেখা হয়।
অন্য আরও কিছু যুক্তিসংগত কারণেও অনেকে বাইরের দেশে অর্থ ও সম্পদ রাখতে চাইতে পারেন। যেমন, অপরাধীদের আক্রমণ এবং অস্থিতিশীল সরকারের হাত থেকে বাঁচতে।
দেশের বাইরে গোপন সম্পদ রাখা অবৈধ না হলেও, গোপন কোম্পানির নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অর্থ ও সম্পত্তি সরানো স্পষ্টতই অপরাধ লুকানোর মতো কাজ।
বিশ্বজুড়ে রাজনীতিবিদদের বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে কর ও সম্পদ লুকানো যেন আরও কঠিন করে তোলা হয়। বিশেষ করে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর আরও জোরালো হয় এ দাবি।
অফশোরে টাকা লুকানো কতটা সহজ?
একেবারেই সহজ। আপনাকে শুধু কোনো করস্বর্গে অত্যন্ত গোপনে একটা শেল কোম্পানি খুললেই চলবে। এ ধরনের কোম্পানির অস্তিত্ব কেবল কাগজে-কলমেই থাকে, কোনো কার্যালয় বা কর্মচারী থাকে না।
মোদ্দা কথা, শেল কোম্পানি হচ্ছে একটা বৈধ ব্যবসার খোলস। মূল অর্থের মালিক কে, তা গোপন রাখার পাশাপাশি ওই অর্থের ব্যবস্থাপনা করাই এ ধরনের কোম্পানির কাজ।
সাধারণত আসল মালিকের নাম শেল কোম্পানির কোনো কাগজে থাকে না। শেয়ার মালিকদের মধ্যে থাকেন আইনজীবী ও অ্যাকাউন্টেন্টরা। কখনো কখনো মালিকের অফিসের অফিস সহকারীও এসব শেল কোম্পানির পরিচালক বনে যান।
যেকোনো কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ থাকে এর বেশিরভাগ শেয়ারের মালিকের হাতে। কিন্তু শেল কোম্পানির ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আছে অন্য কোনো কোম্পানি। ওই কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কোনো আইনজীবী হয়তো শেল কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে এসেছেন, যদিও তিনি নিজে মালিক নন। সেই নিয়ন্ত্রক কোম্পানিও হয়তো এই শেল কোম্পানির মালিক নয়। তারা হয়তো অন্য কোনো কোম্পানির সম্পদ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে এই শেল কোম্পানিরও দেখভাল করছে।
এতে অবশ্য পয়সা খরচ হয়। স্পেশালিষ্ট ফার্ম টাকার বিনিময়ে আপনার পক্ষে শেল কোম্পানি খুলে ওই কোম্পানি চালাবে। এসব ফার্ম কোম্পানির একটি ঠিকানা এবং পরিচালকদের নামও দিয়ে থাকে। এ কারণে এই ব্যবসার পেছনের মূল হোতাটি কে, তা জানা যায় না।
অফশোরে কত টাকা লুকানো হয়েছে?
এটা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। তবে ধারণা করা হয়, ৫.৬ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ৩২ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত লুকানো হতে পারে বলে ধারণা আইসিআইজের। আইএমএফ-এর তথ্য অনুসারে, করোস্বর্গগুলো ব্যবহারের কারণে বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো বছরে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের মতো কর হারায়।
- সূত্র: বিবিসি