যদি মিষ্টির ওপর মানচিত্র হতো!
আমি আমার নানার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। নানাভাই বলে ডাকতাম তাকে। আমার নানা ছিলেন একজন ভারতীয়। তাই বেশিরভাগ সময়ে নানাভাই থাকতেন শিলংয়ে, সেখানে তাদের পৈতৃক ব্যবসা ছিল। তাই নানা যখন ঢাকায় আসতেন তখন ঈদ ঈদ মনে হতো। হয়তো সঙ্গে করে আমাদের জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসতেন, তাই! ছোট ছিলাম, কেউ কিছু নিয়ে এলে খুব খুশি হতাম। ১৯৬৫ সালে তিনি একেবারে ঢাকায় চলে আসেন।
যা-হোক, আমার নানাভাইয়ের সঙ্গে আমার একটা মিল ছিল। নানাভাই মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন, তিনি ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন রকমের মিষ্টি খুঁজে বের করতেন আর খেতেন।
অ্যাটম বোম
নানা একবার আমাকে একটা মিষ্টি খাইয়েছিলেন। মিষ্টির নামটা ছিল অ্যাটম বোম! আমার মনে আছে, ৫৬-তে এই অ্যাটম বোম অনেক খেতাম আমরা। জানি নামটা খুব হাস্যকর, কিন্তু এই নামকরণ হয়েছিল মিষ্টির আকৃতির কথা মাথায় রেখেই। কেননা এই মিষ্টির আকৃতি ছিল অ্যাটম বোমার মতোই বিশাল!
স্বাদের দিক দিয়ে এটা ছিল রসালো। শক্ত রসগোল্লা বলতে যদি কিছু বোঝা যায়, তাহলে সেটা হবে এই অ্যাটম বোম।
একজনের পক্ষে খাওয়া সম্ভব ছিল না, তাই কেটে ভাগ করে খেতাম । আমার ধারণা, শুধু একটা অ্যাটম বোমই আধকেজি হবে! একটা প্যাকেটে দুটো করেই বিক্রি হতো এই অ্যাটম বোম।
এই বিশেষ বোমের বিশেষত্ব হলো, এর ভিতরে একটা ক্ষীরের পুর দেয়া থাকত, সেই পুরে থাকত লবঙ্গ, এলাচির মতো বিভিন্ন সুগন্ধি মশলার মিশ্রণে তৈরি খুব ঘন একধরনের ক্ষীর।
অবশ্য কয়জনই বা চেনে এই অ্যাটম বোমকে?
এখনও এটা আছে কি না কে জানে! অন্য দেশে অন্য নামে বিক্রি হতে পারে। হতে পারে এর চাহিদা নেই, তৈরি হয় না আর।
তবে সে সময়ে এই মিষ্টি কিন্তু প্রতিদিন তৈরি হতো না। কেবল অর্ডারেই তৈরি হতো। ১৯৫৬ সালে আমার জন্মদিনে নানাভাই এই বোমা এনে দিল আমাকে। আমি একটা গোটা মিষ্টি খেতে পেরেছিলাম কি না মনে নেই, তবে আমি যেরকম পেটুক ছিলাম, তাতে আমার পক্ষে খাওয়াও সম্ভব! এরপর আমি এই মিষ্টি আর খেয়েছি কি না মনে পড়ে না। কিন্তু সেবার এই মিষ্টি খেয়ে আমি অনেক মজা পেয়েছিলাম বলে পরে একদিন নানাভাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওই মিষ্টির দোকানে। সে সময় আমরা মিষ্টি কিনতাম প্রধানত দুটো দোকান থেকে। একটি হলো মরণচাঁদ মিষ্টান্ন ভান্ডার, আরেকটি কালাচাঁদ মিষ্টান্ন ভান্ডার।
চমচম
চমচমের জন্য টাঙ্গাইল বিখ্যাত ছিল। দুরকম চমচম পাওয়া যেত। একটায় চিনির সিরা থাকত। সিরাগুলো শক্ত হয়ে ঝুরঝুরে হয়ে যেত। আরেক ধরনের চমচম হতো লম্বায় বড় এবং একটু শুকনো, আকারের দিক থেকে দুপাশ কিছুটা সরু এবং মাঝের পেটের দিকটা মোটা। এটা খুব জনপ্রিয় ছিল।
টাঙ্গাইলের চমচম প্রথম ঢাকায় আনা শুরু করে স্টেডিয়ামের পাশে থাকা প্রভেনশিয়াল সুইটমিট। এর আগেও এসে থাকতে পারে। তবে এই দোকানটিতে বিজ্ঞাপন দেয়া হতো টাঙ্গাইল চমচমের। আমরা সেখান থেকেই চমচম খেতাম।
অমৃতি
মিষ্টির মধ্যেও আঞ্চলিকতা আছে!
অমৃতি আমাদের দেশে হয় গোলাকার, আর পশ্চিমবঙ্গে হয় চ্যাপ্টাকার। অমরত্ব লাভ করা যায় যে মিষ্টি খেলে তাকেই 'অমৃতি' বলে। অমৃতিকে জিলাপির একধরনের সংস্করণ বলা যেতে পারে।
মুক্তাগাছার মন্ডা
মুক্তাগাছার মন্ডা ছিল রাজার মিষ্টি। এটি যেভাবে তৈরি হতো, অন্য কোনো জায়গায় সেভাবে তৈরি করা হতো না। মন্ডা অনেক জায়গাতেই হয়, তবে মুক্তাগাছার মন্ডা আলাদা!
বাবা কাজের জন্য ময়মনসিংহ যেতেন। একবার বাবা এই মন্ডা নিয়ে এসেছিলেন আমাদের জন্য। ওটাই মন্ডার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আরেকবার পরিবারের সবার সঙ্গে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহে। আমার বাবা সেখানকার ন্যাশনাল ব্যাংক (সোনালী ব্যাংক)-এর ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ছিলেন। গৌরীপুর মহারাজার বাসার নিচতলায় ছিল অফিস ব্যাংক। এই গৌরীপুরের রাজা ছিলেন মুক্তাগাছা মন্ডার অন্ধভক্ত।
আমি নিজেই মন্ডা বানাতে দেখেছি একদিন। আমার মনে আছে, কারিগররা আমার বাবাকে বলছিল ময়ানটা বানাতেই তাদের অনেকদিন সময় লাগে। আর এটা সবাই বানাতে পারত না, তাই মুক্তাগাছার মন্ডা এত বিখ্যাত আর দামটাও বেশি!
তারপর আস্তে আস্তে এই মন্ডা ঢাকার মার্কেটে আসা শুরু করল, অনেকেই বানাতে শুরু করল। কিন্তু বগুড়ার দই যেমন ঢাকার দইয়ের মতো হয় না, মন্ডাও তেমন মুক্তাগাছার স্বাদ আনতে পারল না।
মধ্যবিত্ত জমিদারদের সাংস্কৃতিক একটি অঞ্চল হলো ময়মনসিংহ। অনেক জমিদারের বাস ছিল ওখানে। এসব জমিদারের অসংখ্য পৃষ্ঠপোষোকতা পেয়েছে এই মন্ডা। সে সময় জমিদারদের জন্য অনেক ধরনের মিষ্টি বানানো হতো এই অঞ্চলে। এসব মিষ্টি এখন হারিয়ে গেছে…
দই
পুরান ঢাকার লোহারপুলের পাশে পাওয়া যেত পয়োধি দই। পুরান ঢাকার দই হিসেবে এটি খুব বিখ্যাত ছিল। ঢাকার বিভিন্ন দোকানে যে দই পাওয়া যায়, সেই দইয়ের সঙ্গে স্বাদে এর বিস্তর তফাৎ। লোহারপুল এখন আছে কি না জানা নেই, কিন্তু একসময় লোহার পুল দিয়ে রিকশা উঠতে পারত না। ওখানকার ছেলেরা ঠেলে ঠেলে রিকশাগুলোকে পুল পার করত। বিনিময়ে কিছু পয়সা আয় হতো তাদের। এছাড়া, মরণচাঁদের দই ছিল খুব বিখ্যাত।
আমাদের আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এখানে একটু তফাৎ আছে। আমরা মিষ্টি বলতে মিষ্টিকেই বুঝি, কিন্তু ওরা দইকেও মিষ্টি বলেই চেনে। আর আমরা মিষ্টি বলতে সাধারণত রসগোল্লা, চমচম, পানতোয়া এগুলোকে বুঝি।
বালুসাই
পুরান ঢাকার কিছু আলাদা মিষ্টি ছিল, যেমন বালুসাই। এগুলো সবাই খায়ও না, আবার পাওয়াও যায় না সবসময়। পুরান ঢাকার নওয়াববাড়ি অঞ্চলের মিষ্টি ছিল এই বালুসাই।
গজা
পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যেত গজা। গজা এখন প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। জিভের মতো দেখতে ছিল বলে আমরা ডাকতাম 'জিভে গজা'। একটি ছিল শুকনো জিভে গজা, আরেকটি ছিল সিরায় ভেজা জিভে গজা।
নর্থবেঙ্গলের মিষ্টি আবার আলাদা। ঢাকা শহরের আমাদের নর্থবেঙ্গলের মিষ্টি খাওয়া হতো না। কিন্তু ওখান থেকে কেউ আসলেই মিষ্টি নিয়ে আসত। এ অঞ্চলের একটি মিষ্টি ছিল, কাচাগোল্লা নাম।
খাজা
কিছুটা বালুসাইয়ের মতো ছিল খাজা। এখনো ঢাকায় এটা জনপ্রিয়। শুকনো হওয়ায় মিলাদে এই খাজা খেতে দেয়া হয়। তবে এত পছন্দের ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ, করাচির ওদিকে অনেক ভালো খাজা খেয়েছি। তবে বাংলাদেশের খাজা এত ভালো লাগত না।
বুলেট মিষ্টি
১৯৬৮ সালে সাভারে, (বর্তমান গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল যেখানে) মিষ্টি তৈরি হতো। সাভারে চমচম, রসগোল্লা অনেক জনপ্রিয় ছিল। বুলেট নামে একধরনের মিষ্টি পাওয়া যেত, পানতোয়ার মতো এই মিষ্টি আগে একটু ভেজে নিয়ে এরপর সিরায় ভিজিয়ে নেয়া হতো। ফলে বাইরের আস্তরণটা একটু শক্ত হলেও ভেতরটা হতো নরম আর রসালো। দুর্দান্ত লাগত খেতে! আমরা বসে বসে ওখানে খেতাম।
আসলে শুকনো মিষ্টি আর ভেজা মিষ্টির বানানোর উপকরণেও কিছু পার্থক্য আছে। একটি বানানো হয় দুধ দিয়ে, অন্যটি ময়দা। যেমন রসগোল্লা বানাতে দুধের দরকার নেই, কিন্তু সন্দেশ তৈরি হয় দুধ থেকেই। সন্দেশ হতো আবার কয়েক রকম। তারমধ্যে নলেন গুড়ের সন্দেশ খুব প্রিয় ছিল আমাদের। শীতকালে পাওয়া যেত শুধু এই সন্দেশ। এটাও আর আছে কি না জানি না।
ঢাকা এখন একটা ফাস্টফুডের দুনিয়া। কিন্তু ঢাকার খাবার আর ঢাকার বাইরের খাবারের মধ্যে এত তফাত ছিল না তখন। কী পাওয়া যেত না ঢাকায়? না পাওয়ার মধ্যে ছিল খেজুরের গুড়ের রস।
আমরা ছোটবেলায় অনেক ভেঙে ভেঙে গুড় খেতাম। খুব পছন্দ করতাম গুড়। মানুষ তখন বিকেলের নাস্তা করত টুকরা টুকরা গুড় আর সরিষার তেলে মুড়ি মাখানো দিয়ে। আরো ছিল মোরব্বা, নারকেলের নাড়ু।
আগে মধ্যবিত্ত সমাজের একটা সংস্কৃতি ছিল বাড়ির ছাদ। তখনকার বেশিরভাগ বাড়ি একতলা কি দোতলা ছিল। এই বাড়ির ছাদগুলোতে প্রায়ই নারকেলের নাড়ু, মোরব্বা, আচারের মতো কিছু না কিছু খাবার রোদে শুকোতে দেয়া হতো। আর বাড়ির ছোটোরা সেসব খাবার ছাদে বসে বসে পাহারা দিতো। কিছু মিষ্টি একদমই হারিয়ে যাওয়ার পথে। যেমন নকুল দানা, বাতাসা, কদমা ইত্যাদি।
এই হলো মিষ্টির গল্প। বাংলাদেশের মিষ্টির ওপর একটা মানচিত্র তৈরি করলে ভালো হতো। কোথায় কোথায় কী ধরনের মিষ্টি পাওয়া যেত বা যায় এর ওপর একটা মানচিত্র থাকলে এই মিষ্টিগুলোর একটা ইতিহাস উঠে আসবে। মিষ্টির মধ্যে যেমন আঞ্চলিকতার ছাপ পাওয়া যায় আছে, তেমনি পাওয়া যায় ইতিহাস ঐতিহ্যের ছাপ।
- আফসান চৌধুরী: গবেষক ও সাংবাদিক