বিলীন হয়ে যাচ্ছে আদিগঙ্গা
গঙ্গা মূল উৎস থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আদিগঙ্গা নদী। ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত এই নদী আজ বিভিন্ন স্থানে দখলে-দূষণে জর্জরিত। তিন শতাব্দী আগে, বঙ্গোপসাগর থেকে গঙ্গার মূল বহিঃপ্রবাহ ছিল এই নদী। আর এখন এটি আবর্জনা ও মেট্রো রেলের নিচে চাপা পড়ে নর্দমায় পরিণত হয়েছে; অনেক জায়গায় আবার ব্যক্তিগত দখলের দরুন পুকুর কিংবা বসত বাড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে আদিগঙ্গা।
গত তিন দশকে গঙ্গার ধ্বংস হয়েছে সবচেয়ে দ্রুত। অথচ এ সময়ের মধ্যেই প্রায় ২০০ কোটি ভারতীয় রুপি (৩০ মিলিয়ন ডলার) সরবরাহ করা হয়েছে নদী 'পুনরুদ্ধারের' জন্য। এছাড়া, বিশ্বব্যাংকও দূষণ কমিয়ে গঙ্গা নদীকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে কয়েক মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প সমর্থনের ঘোষণা দেয়।
আদিগঙ্গা
অসংখ্য প্রাচীন গ্রন্থ এবং মানচিত্র ঘেঁটে জানা যায়, ১৭ শতকের শেষ দশকে কলকাতা যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে প্রধান বন্দরে পরিণত হয়, তখন এই আদি (মূল) গঙ্গাই ছিল গঙ্গার নদীর মূলধারা। বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরের পাশে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে (যা আজ নর্দমায় পরিণত হয়েছে) গড়িয়ার মধ্য দিয়ে গঙ্গাসাগরে এসে শেষ হওয়ার আগে, বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিলিত হয় গঙ্গা।
১৭৫০ সালের দিকে হাওড়ার সাঁকরাইলের কাছে সরস্বতী নদীর সঙ্গে হুগলি নদীকে সংযুক্ত করতে একটি খাল কাটা হয়েছিল। এর ফলে নাদীর বেশিরভাগ পানি প্রবাহিত হতে থাকে পশ্চিম দিক দিয়ে। আর হুগলি হয়ে ওঠে গঙ্গার প্রধান চ্যানেল, যেমনটি আজ আমরা দেখছি।
১৭৭০-এর দশকে আদিগঙ্গা যখন সরে যেতে শুরু করল, তখন উইলিয়াম টলি গড়িয়া থেকে শামুকপোতা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার চ্যানেলের ড্রেজিংয়ের কাজ তত্ত্বাবধান করেন এবং আদিগঙ্গাকে বিদ্যাধরী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করেন। নদীর সেই ধারা সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সমুদ্রে প্রবাহিত হয়েছে। আজও ড্রেজিং করা এই প্রসারিত জায়গাটি 'টলির নালা' বলে পরিচিত।
যে নদীটি আগে সুন্দরবনের প্রান্তে বোরাল, রাজপুর, হরিনাভি এবং বারুইপুর শহরগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো, তা ক্রমশ মরে যেতে শুরু করেছে। এমনকি ১৯৪০-এর দশকেও ইঞ্জিন ছাড়া নৌকা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হতো এই পথে।
অনেকের মতে, ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে মৌয়ালরা (মধু সংগ্রহকারী) সুন্দরবন থেকে নিজেরদের নৌকায় করেই নদী পার হয়ে মধু এবং বাঁশ নিয়ে গিয়েছলেন কলকাতার দক্ষিণের ব্যস্ত শহরতলি টালিগঞ্জে।
রেলপথ ও মানুষের হাতে মৃতপ্রায় আদিগঙ্গা
কেবল আবর্জনা স্তূপেই নয়, মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হয়েছে আদিগঙ্গা। আর এটি সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে কলকাতা এবং এর আশেপাশের এলাকাগুলোতে। ১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার হাইকোর্টের কাছে দেওয়া এক প্রতিবেদনে নদী দখলের বিষয়টি স্বীকার করে জানায়, হেস্টিংস (হুগলির সঙ্গে মিলনাস্থল) থেকে গড়িয়া (যেখানে টলির নালা শুরু হয়েছে) পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৫ কিলোমিটার প্রসারিত অংশে ৭ হাজার ৮৫১টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এরমধ্যে, ৯০টি মন্দির, ৬৯টি গোডাউন (পণ্য সংরক্ষণের ডিপো), ১২টি গোয়ালঘরসহ অন্তত ৪০ হাজার মানুষ এখানে বসতি গড়ে তুলেছেন। এ সবই অবৈধ দখলের ফল।
২৪ এপ্রিল, ১৯৯৮ সালে কলকাতা হাইকোর্ট সমস্ত অবৈধ স্থাপনা এক মাসের মধ্যে সরিয়ে ফেলা নির্দেশ দেন। তবে সে নির্দেশনা মানা হয়নি; অবৈধ বসতি যেখানে ছিল, এখনও সেখানেই রয়েছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয় এ কথা। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনও জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনালের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চে তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে আদিগঙ্গায় ব্যাপক দখলের কথা স্বীকার করেছে।
এছাড়া, টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো থেকে গড়িয়া পর্যন্ত মেট্রো রেলের ৬ কিলোমিটার সম্প্রসারণ ২০০৯ সালে কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার কাজই করেছিল। রেলপথ তৈরির জন্য মাঝ নদীতে বসানো হয় ৩০০টি পিলার।
এ ব্যাপারে ভারতীয় এনজিও বসুন্ধরার কর্মকর্তা ও পরিবেশকর্মী মোহিত রায় বলেন, "এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বড় জনরোষ দেখা দিয়েছিল সে সময়। এমনকি জনস্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে হাইকোর্টে একটি আবেদনও দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু ১০০ বছরের পুরানো নিয়ম দেখিয়ে পার পেয়ে যায় মেট্রো রেল; ওই নিয়ম অনুযায়ী, রেল প্রকল্পের বিরুদ্ধে কিছুই করা যাবে না।"
নদী এলাকাজুড়ে দুর্গন্ধ
সম্প্রতি দ্য থার্ড পোল ডট নেট-এর একটি দল আদিগঙ্গার ধার পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায়, সেখানে দখল কোনো অবৈধ বা ব্যতিক্রমী কিছু নয় বরং 'আদর্শ'। নদীর ধার ঘেঁষে গড়ে উঠেছে কংক্রিটের ভবন। পাশ দিয়েই বয়ে গেছে নর্দমা, যা সরাসরি যুক্ত হয়েছে আদিগঙ্গার সঙ্গে। শুধু তাই নয়, নদী ধারের চারপাশে বসানো হয়েছে স্থায়ী-অস্থায়ী শৌচাগার। এগুলোর আবর্জনাও গিয়ে পড়ছে নদীতেই। সেইসঙ্গে আশেপাশের গোয়ালঘর, ছোট ছোট কল-কারখানা এবং এমনকি পাড় বরাবর গড়ে ওঠা বিনোদন ক্লাব আর মেট্র রেলের অবদানে নালাসদৃশ নদীর পাশেই গড়ে উঠেছে ময়লার স্তূপ। পলিথিনসহ নানান আবর্জনা ভেসে বেড়াতে দেখা যায় আদিগঙ্গার 'কালো' পানিতে। আর এর চারপাশের দুর্গন্ধ যেনো সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায়!
বিলীনের পথে নদী
প্রায় বিলীন হতে চলেছে আদিগঙ্গা।
নরেন্দ্রপুর ও রাজপুর-সোনারপুরে ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত আদিগঙ্গা এখন আর দৃশ্যমান নয়। এ জায়গায় গড়ে উঠেছে কংক্রিটের ঘর, কমিউনিটি হল এবং রাস্তা। এর কাছাকাছিই দেখা যায় বেশ কয়েকটি প্রসারিত পুকুর। গঙ্গার সূত্র ধরেই রাখা হয়েছে এগুলোর নাম- কারের গঙ্গা, ঘোষের গঙ্গাসহ আরও অদ্ভুদ নামে পরিচিত এই পুকুরগুলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা জানান, একবার বাড়তি বসতির চাপে নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে, নদীর তলদেশেও শুরু হয় বড় আকারের দখল। ১৯৮০ এর দশক থেকে দ্রুতই দখল হতে থাকে নদী।
পুনরায় আবির্ভূত নদী
এতো এতো দখলের পরেও পুনরুত্থিত হয়েছে আদিগঙ্গা। থার্ড পোলের পর্যবেক্ষক দল চব্বিশ পরগনার দক্ষিণে জয়নগরের কাছে সূর্যপুরের এক প্রান্ত পর্যন্ত নদীর তৎকালীন-দক্ষিণমুখী প্রবাহ অনুসরণ করে। ওই এলাকার বাসিন্দারা জানান, নদীটি পিয়ালীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, যা কিছুদূর গিয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মাতলার সঙ্গে মিলিত হয়ে সাগরে গিয়ে মিশেছে।
তবে গবেষকরা বলছেন, দখল-দূষণে প্রায় অদৃশ্য হওয়ার পথে থাকলেও এখনও পুনরুত্থানের আশা রয়েছে আদিগঙ্গার।
কারের গঙ্গা রক্ষণাবেক্ষণ কমিটির সচিব স্বপন ঘোষ বলেন, "আমাদের বিশ্বাস, আদিগঙ্গা মৃত নয়; প্রকৃতপক্ষে, এটি অবৈধ দখল ও স্থাপনার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।"
"কয়েক বছর আগে যখন আমরা পুকুর পরিষ্কারের চেষ্টা করছিলাম, তখন আমরা নিচ থেকে অবিরাম জল প্রবাহিত হতে দেখি," যোগ করেন স্বপন।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট-এর ভূগর্ভস্থ জল বিশেষজ্ঞ প্রদীপ সিকদার বলেন। "এটা হয়তো সত্যি, বদ্ধ জলাশয়ের পানি নদীর ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিশে যেতে পারে।"
মৃতপ্রায় নদী
কিন্তু আদিগঙ্গার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মূল কারণ যেই আবর্জনা ও দখল-দূষণ, তা ঠিক কী উপায়ে মোকাবেলা করা যায় সে বিষয়টি স্পষ্ট নয় এখনও। এগুলো মোকাবেলার জন্য ইতোমধ্যে ২০০ কোটিরও বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে।
পরিবেশবাদী কর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, "এটি বড় কেলেঙ্কারি স্বরূপ। সুস্পষ্ট পৃষ্ঠপোষকতার অধীনেই আদিগঙ্গা দখল, দূষণ এবং সম্ভাব্য সব ধরনের অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে গেছে; পরিকল্পিতভাবেই রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে নদীকে হত্যা করা হয়েছে।"
পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সাবেক প্রধান আইনজীবী বিশ্বজিৎ মুখার্জিও সুভাষ দত্তের সঙ্গে একমত।
"এটি কেলেঙ্কারি ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু আদিগঙ্গার ক্ষেত্রেই নয়, এটি সমগ্র গঙ্গার ক্ষেত্রেই সত্য। গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান প্রকল্পের অধীনে এত টাকা খরচ খরচ হয়েছে, কিন্তু কার্যত গঙ্গার কোনো উন্নতি হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে পরিবেশ সম্পর্কিত কেলেঙ্কারি এবং অপরাধগুলো খুব কমই চোখে পড়ে," বলেন বিশ্বজিৎ মুখার্জি।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, আদিগঙ্গার বেশিরভাগ অংশে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা প্রায় শূন্য। এ কারণে কোনো প্রাণি বাঁচে না এখানে। গোসলের জন্য উপযুক্ত পানিতে যেখানে প্রতি ১০০ মিলিলিটারে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ৫০০-এর বেশি হওয়ার কথা নয়, সেখানে এই পানিতে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ৯ থেকে ১৬ মিলিয়ন। আবর্জনা ছাড়াও ৫৭টি নর্দমার অপরিশোধিত বর্জ্য আদিগঙ্গার মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়।
এরপরেও পুনরুদ্ধারের আশা
ভারতের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং প্রখ্যাত জলবিদ কল্যাণ রুদ্র মনে করেন, আদিগঙ্গাকে যতদূর সম্ভব পুনরুদ্ধার করা উচিত; কারণ এটি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের নিষ্কাশনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত এবং মোহিত রায়ও মনে করেন, আদিগঙ্গাকে আবার জীবিত করা যেতে পারে।
"কাজটি সম্ভব যদি রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার গঙ্গার মূল শেষ প্রবাহকে পুনরুত্থিত করতে আগ্রহ ও সক্রিয়তা দেখায়। তবে তারা কি পুরানো চ্যানেলকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন?," বলেন সুভাষ।
"বিশ্বব্যাপী এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে, (বিশেষত, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে) পুরানো এবং মৃতপ্রায় নদীর উৎসগুলোকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। তাহলে আমরা কেনো তাদের মতো করে পূর্ববর্তী ভুলগুলোকে শুধরে নিতে পারবো না?," বলেন মোহিত রায়।
- লেখক: জয়ন্ত বসু, কলকাতা ভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
- দ্য থার্ড পোল ডট নেট থেকে অনূদিত