৫৫ বছর আগের নিউমার্কেট, আর সারি সারি বইয়ের দোকান!
'দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড' বাংলায় ২৯ অক্টোবর ২০২২ প্রকাশিত রাফিয়া মাহমুদ প্রাত লিখিত 'ঢাকার হারানো বইয়ের দোকানের খোঁজে' রচনাটি আমাকে ৫৫ বছর আগের নিউমার্কেটে নিয়ে গেছে। সেদিনগুলোতে আমি অবাক হয়ে মাথা বাঁকিয়ে মুখ আকাশমুখী করে নিউমার্কেটের তিনটি গেটের দিকে তাকিয়েছি। তারও আগের ১৯৬২ কি ১৯৬৩ সালে বাবা কিংবা মায়ের আঙুল ধরে যখন বলাকা সিনেমা হলের দিককার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেছি, গেটটাকে তখন মনে হতো অনেক উঁচুতে, এতই উঁচুতে যে ওপরে গিয়ে আকাশের সাথে ধাক্কা লেগে তবে থেমেছে। তখন জানতাম না এটা নিউমার্কেটের দুই নম্বর গেট। জেনেছি আরও পরে; আজিমপুর কলোনিমুখী গেট হচ্ছে এক নম্বর, বলাকামুখীটা দুই নম্বর আর কাঁচাবাজারমুখীটা তিন নম্বর। নিউমার্কেটের তিনটা গেট চেনা তখন কলম্বাসের নতুন পৃথিবী আবিষ্কারের চেয়ে কম কিছু আমার মনে হয়নি।
আরও পরে আবিষ্কার করেছি নতুন প্রেমিক-প্রেমিকার প্রথম অভিসারের স্থানটিও নিউমার্কেট। ১৯৫৮ সালে বিয়ে হয়েছে এমন এক পরিচিত দম্পতির বেলায় পাত্রী দেখার ব্যাপারটি ঘটেছে নিউমার্কেটের একটি স্বর্ণালংকারের দোকানে। স্বর্ণালংকারের দোকানে তিন দিক থেকে আয়না ফিট করা থাকে। সুতরাং সরাসরি তাকানোর বিব্রতাবস্থা এড়াতে আয়নাতে দেখে নিলেই হয়। এই সুযোগে পাত্রীও তার হবু স্বামী সম্পর্কে একটা ধারণা করে নিতে পারেন। নিউমার্কেট উদ্বোধন হয় ১৯৫৪ সালে, ৩৫ একর জমিনের ওপর ছড়ানো এত সুন্দর মার্কেট শুনেছি এশিয়া মহাদেশেও নাকি ছিল না।
নিজেদের বাসার অবস্থানগত কারণে বলাকামুখী গেট ছিল আমাদের ঢোকার এবং বেরোবার সিংহদুয়ার। গ্রিন রোড থেকে আমাকে আসতে হতো, এই রাস্তাটাকেই আরও কিছুকাল আগে বলা হতো কুলি রোড। গ্রিন রোডে যে নিত্যদিনই ভোরবেলা কুলির বাজার বসত, সে তো আমিই দেখেছি। রাস্তার দুপাশের বিশিষ্ট বাসিন্দারা দেখলেন ঠিকানা কুলি রোড বললে স্ট্যাটাস কমে যায়, তাই নামের পরিবর্তন। রাস্তার নাম যদি হয় গরম পানির গলি, তাতে স্ট্যাটাস বাড়ে না কমে, বোঝা মুশকিল। একবার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও লেখক ধ্রুব এষ আমাকে গরম পানির গলিতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেই গলি থেকে বেরোবার পথে এক ভাঙারির দোকানে পুরোনো কাগজের সাথে আসা প্রচ্ছদহীন যাযাবর রচনাবলি কিনেছিলাম পনেরো টাকায়। যারা বইয়ের খোঁজে বেরোন, ভাঙারির দোকানেও ঢুঁ মারতে পারেন। অমূল্য রতন স্বল্পমূল্যে পেয়েও যেতে পারেন।
দুই নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে বাঁয়ে মোড়, অনেকটা হেঁটে বাঁ দিকে তাকালে ভেতর থেকে চোখে পড়ত আর একটা গেট-এটাই এক নম্বর। সেই এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে চোখ একটু ত্যাড়া করে ডান দিকে নিউমার্কেটের বিশাল করিডরের ওপারে তাকালে চোখে পড়ত নভেল ড্রিংকস হাউস। না কোনো মাদকদ্রব্য নয়, এমনকি কোক-ফান্টাও নয়, ড্রিংকস মানে মিল্কশেক, কিন্তু আসল খাবার আইসক্রিম। আইসক্রিমের জন্য যে বিশেষ কাপ থাকে, আইসক্রিম যে চামচ দিয়ে খাওয়া যায়, আইসক্রিমের যে রেস্তোরাঁ থাকতে পারে, নভেল ড্রিংকস হাউসে ঢোকার সুযোগ না পেলে আমার জানতে হয়তো আরও কয়েক বছর লেগে যেত। আমাদের সময়ের আইসক্রিম মানেই কাঠিতে জমাট বাঁধা বিভিন্ন স্বাদের, বিভিন্ন মানের বরফ। কাঠি না হলে আবার আইসক্রিম কিসের? দুই পয়সা (মানে এক আনার অর্ধেক) দামের আইসক্রিম মানে চুষে খাবার মতো কেবলই মিষ্টি বরফ, এক আনা দামের আইসক্রিমের পরিচিতি মালাই আইসক্রিম মধ্যবিত্তের আইসক্রিমের মধ্যে এটারও মধ্যবিত্তের মর্যাদা। কিন্তু সবচেয়ে লোভনীয়টা পাতলা কাগজে মোড়ানো দুগ্ধফেননিভ, কিশমিশ-বাদাম ইত্যাদি মাখানো দ্বিগুণ দামের দুই আনার আইসক্রিম। কিন্তু নভেল ড্রিংকসে বসে খেতে হলে পয়সা বেশি গুনতে হবে, চার আনার কম কোনো কিছু নেই। অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল বালক-বালিকাদের প্রিয় বেবি আইসক্রিম, ইগলু আরও পরে এসেছে। এগুলো প্যাট্রিশিয়ানদের। তারা অভিজাত।
কিন্তু মূল আকর্ষণ জুয়েলার্স বা ওয়াচ হাউস, কিংবা রেডিমেড কাপড়ের দোকান নয়। এক নম্বর গেটের বাঁ দিক থেকে শুরু করে যতই হাঁটি, বইয়ের দোকান আর শেষ হয় না। আবার সেখানে দাঁড়িয়ে উল্টো দিকে তাকালেও বেশ কটা বইয়ের দোকান। সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের প্রিয় অঞ্চল তো এটিই। আমি যে বইয়ের দোকানটির কথা বিশেষ করে স্মরণ করছি, সে দোকানের নাম মনে নেই। মালিক এবং বই বিক্রেতা একজনই। সাড়ে পাঁচ ফুটের ওপরে নন, তিনি একালের ভাষায় স্লিম, সেকালের ভাষায় রোগা, পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। ঘিয়ে রঙের একটি চাদরও জড়াতেন। এটি ছিল একটি পুরোনো বইয়ের দোকান! ভাবুন তো সেকালের সবচেয়ে 'পশ' শপিং মল (মল শব্দটা তখনো চালু হয়নি) নিউমার্কেটে বহু দাম দিয়ে কেনা অথবা ভাড়া নেওয়া একটি দোকানে পুরোনো বই বিক্রি হচ্ছে। বই শেলফেও আছে, মেঝেতেও আছে; ভেতরের প্রান্তে একটি ছোট টেবিল-তাতে ড্রয়ার আছে, একটি কাঠের চেয়ার বইয়ের দাম নেবার সময় কেবল সেই মানুষটি এখানে বসেন।
এই দোকানের খবর আমার আব্বার জানা ছিল। ১৯৬৮ সালে তিনিই আমাকে নিয়ে আসেন এবং যে আন্তরিকতায় দোকানদারের সাথে কথা বলেন, তাতে মনে করার কারণ আছে যে আব্বা তাকে যথেষ্ট সমীহও করেন। আমার জন্যই তিনি তিনটি বই বের করে দিলেন: যাদবচন্দ্র চক্রবর্তীর 'পাটীগণিত', কে পি বসুর 'অ্যালজেব্রা' এবং জে সি নেসফিল্ডের 'মর্ডান ইংলিশ গ্রামার'। আবার আব্বা মনে করতেন টেক্সট বই পরীক্ষা পাসের জন্য, আর এ ধরনের বই জ্ঞান অর্জনের জন্য; আর একধরনের 'আউট বই' তার নিজের পড়ার জন্য। কিন্তু আমি যে তত দিনে আউট বই পড়তে শুরু করেছি, আমার বাবা কিংবা মা টেরও পাননি। আউট বইয়ের সবচেয়ে ভালো দিকটা হচ্ছে এসব বই থেকে পরীক্ষায় কোনো প্রশ্ন করা হয় না।
আমরা সেকালে 'আঙ্কল' বলতাম না। চাচা বলতাম, কোনোভাবে মানুষটির স্ত্রী বা সন্তানেরা পরিচিত হলে খালুজানও বলতাম, আত্মীয়সূত্রে মামা না হলে অন্য কাউকে মামাও বলতাম না। একালে মামাটা বারোয়ারি ডাক, আমাদের কালে মামাটা এক্সক্লুসিভ, সংখ্যায় অতি অল্প।
বইয়ের সেই দোকানদার কিংবা দোকানমালিককে আমিও চাচা বললাম। তিনি বললেন, সময় পাইলে চইলা আইসো ভাইস্তা, বইপত্র ঘাঁটলেও মজা, জ্ঞান বাড়ে, আইসা ঘাঁটাঘাঁটি করবা।
সেদিনের কেনা তিনটি বইয়ের দুটো বই পাটীগণিত আর অ্যালজেব্রা বেশ কাজে লাগিয়েছি, ১৯৮০-এর দশকে গণিতগুরু যাবদচন্দ্র চক্রবর্তীকে শ্রদ্ধা জানাতে সিরাজগঞ্জ শহরে তার পরিত্যক্ত বাড়িতেও গিয়েছি। কে পি বসুর বাড়ি কোথায়, আমার জানা নেই। আমি একেবারেই কাজে লাগাইনি নেসফিল্ড সাহেবের বইটি। আমার বাবা পুরোনো বইটি কিনে দিলেও এটা পড়ার ওপর জোর দেননি। বলেছেন, ইংরেজি বই পড়তে পড়তে, ইংরেজি খবরের কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ইংরেজি শেখা হয়ে যাবে। নেসফিল্ড আব্বার আমলের আগে থেকেই পাঠ্য ছিল, কাজেই বাধ্য হয়ে তাকে পড়তে হয়েছে। আমার আমলে এই বইয়ের কথা আমার আব্বা আর জহুরুল হক খান স্যার ছাড়া আর কারও কাছে শুনেছি বলে মনে পড়ে না।
স্কুলজীবনেই বুঝতে পারি, বই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বইয়ের দোকানে আসে না, একজন প্রকাশক তা প্রকাশ করেন এবং বিভিন্ন দোকানে তা সরবরাহ করেন। অনেক দিন পর আমি নেসফিল্ডের গ্রামারের পাতা উল্টে দেখলাম, বইটি ১৯২৮ সালে প্রকাশিত, প্রকাশকের নাম ম্যাকমিলান এবং লেখকের 'আসল নাম' জন কলিন্স নেসফিল্ড। সেই পুরোনো বইয়ের দোকানটিতে আমার তৃতীয় কিংবা চতুর্থ আগমনীর দিন সেই চাচার মুখে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনলাম, খাইবা ফ্রেশটা আর বই কিনবা পুরানটা। একটা নতুন বইয়ের দামে তিনটা-চারটা পুরান বই কেনা যায়। একই খরচে তিন-চার গুণ বেশি শিখবা, এটাই তো বড় লাভ।
তিনি তার এই দর্শনের ব্যাখ্যাও দিলেন, বাসি-পচা পুরোনো খাবার বিভিন্ন রকম রোগবালাই সৃষ্টি করবে; কাজেই খাবারের জন্য কিনতে হবে নতুনটা। বইয়ের পাতা ছেঁড়া না থাকলে, সবগুলো পাতা থাকলে পুরোনো আর নতুন একই কথা। নতুন বই কিনলে বেশি শেখা যাবে আর পুরোনো বই পড়লে কম শেখা হবে, তা নয়। তিনিই জিজ্ঞেস করলেন, কোনটা ভালো-একটা বই না চারটা বই? অবশ্যই চারটা বই।
তত দিনে আমি নিউমার্কেট ভালোই চিনে ফেলেছি, আমি জানি কোথায় আকস স্টুডিও, কোথায় আজিজ ক্লথ স্টোর, কোথায় অপটিক্যাল কর্নার আর কোথায় রেক্স। ঢাকা কলেজ টিচার্স ট্রেনিং কলেজের গা ঘেঁষে গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়ছি; বৃত্তির কিছু টাকা আর স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য সাপ্তাহিক বরাদ্দের কিছু বাঁচিয়ে আমার এই 'বই-চাচা'র দর্শন তামিল করে পুরোনো বইয়ের দিকে ধাবিত হই। আমার কেনা পুরোনো বই নিয়ে আর একটি এপিসোড রচনা করে যাবে।
বলাকা ভবনের বইয়ের দোকানে জুতো শোভা পাচ্ছে
বলাকা সিনেমা হল ভবনে পাশাপাশি তিনটি বইয়ের দোকান ছিল। পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত শ দেড়েক পৃষ্ঠার নতুন বই দুই টাকায় কেনা যেত। তিনটি দোকানের নাম বইপত্র, বইঘর এবং বুক বিউটি। একটিতে খাতাপত্র, কলম, পেন্সিল, ইরেজার, জ্যামিতি বক্স, টি স্কোয়ার ইত্যাদিও মিলত। আমার চোখের সামনে বইয়ের শেলফ হয়ে গেল জুতোর শেলফ, রবীন্দ্র রচনাবলির জায়গায় উঠল হাই হিল লেডিস স্যান্ডেল। ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ বুক সোসাইটি, পেঙ্গুইন ও প্যালিকানের সস্তা বইয়ের খোপগুলোতে ঢুকল মোকাসিনো আর কেডস। একজন মালিক সালেহ সাহেব স্বজনদের বলেছেনও বই বেঁচে পোষাচ্ছে না, দোকানভাড়া বেড়ে গেছে। পাদুকার দখলে চলে গেল মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য সংরক্ষিত স্থান।
আ জার্নি টু বাংলাবাজার
আমার জন্মস্থান আজিমপুর মাতৃসদন হলেও বয়স যখন চার দিন, তখন থেকেই ১৬৫ রাজাবাজারে থাকছি। যখন পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মতো রাজাবাজারও একদিন পূর্ব ও পশ্চিম রাজাবাজার হয়ে গেল, আমার বাবা-মার বাড়িটার নম্বর পাল্টে হয়ে গেল ৮৯ পূর্ব রাজাবাজার। এই জায়গাটা এখন পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালের অংশ। বাসা থেকে বেরিয়ে ফার্মগেট, রিকশাভাড়া ৪ আনা (ঝড়-বৃষ্টি না থাকলে রিকশায় উঠেছি বলে মনে পড়ে না); ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান বাসভাড়া ২ আনা, মুদ্রাটি ছিল বর্গাকার। কিন্তু আমরা ২ আনা খরচ করতে রাজি নই। ছাত্র-ছাত্রী হলে এবং আইডেন্টিটি কার্ড দেখাতে পারলে ভাড়া যতই হোক দিতে হতো ১০ পয়সা। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে ১০ পয়সায় বাস ভ্রমণ শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল এক সুবর্ণ সুযোগ।
সুতরাং পায়ে হেঁটে কিংবা পদব্রজে ফার্মগেট, বাসে গুলিস্তান। ইপিআরটিসির (এখন বিআরটিসি) পৃথক এনক্লোজারে বাসস্ট্যান্ড ছিল, অন্য বাসের বেলায় জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) থেকে শুরু করে নবাবপুর রোডের শুরু পর্যন্ত প্রায় পুরোটাই বাসস্ট্যান্ড। সুতরাং বাস থেকে নেমে খানিকটা এগিয়ে গুলিস্তান-সদরঘাটের বাসের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো। বাসের সংখ্যা ছিল কম। কিন্তু আমি অপেক্ষা করতে রাজি নই, পা ভরসা করে হাঁটতে হাঁটতে মরণচাঁদ মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে একবার ভেবেছি, এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ১০ নয়া পয়সা, যেটুকু বাঁচিয়েছি, তাতে দুটো মিষ্টি অনায়াসে চালিয়ে দিতে পারি। তারপরও নিজেকে নিরস্ত করলাম, এখন নয়, বাংলাবাজার থেকে ফেরার সময় ঢুকব। বাংলাবাজার আর সদরঘাট গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা দুটো স্থান। সদরঘাটের আকর্ষণ বুড়িগঙ্গা নদী, ল টার্মিনাল, আর লাল শার্ট পরা কুলি; এমনকি বাংলাদেশ হবার পরও কুলিদের জাতীয় পোশাকের মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিল লাল শার্ট। আর বাংলাবাজারের দুর্দমনীয় আকর্ষণ ছিল বই। এটাই তখন প্রাদেশিক গ্রন্থ রাজধানী। আমার আগ্রহ এবং একই সঙ্গে স্কুলবালকের সামর্থ যোগ করে অন্তত স্কুলজীবনে আমি নতুন বইয়ের দোকানে কমই ঢুকেছি, বই খুঁজেছি ফুটপাতে, লিয়াকত অ্যাভিনিউ থেকে শুরু করে খানিকটা সদরঘাটমুখী হয়ে আবার হাতের বাঁ দিকে পূর্বমুখী এই ছিল ফুটপাথ গ্রন্থসাম্রাজ্য। সেই বিচিত্র গ্রন্থের জগৎ আর নেই। বইয়ের দোকান এখনো আছে-এর সবই নোটবই আর গাইড। এসবে আকর্ষণ আমার কোনো কালেই ছিল না, এখন তো অবশ্যই নেই। কিছু নোটবই থাকলেও গাইড নামের কিছু ছিল না। বাংলাবাজারের আদিল ব্রাদার্সের একটি বার্ষিক প্রকাশনা এসএসসি টেস্টপেপার যেদিন বাজারে আসত, বেশ হইহই পড়ে যেত। এটা গাইড নয়, চারটি বোর্ডের সর্বশেষ পাঁচ বছরের প্রশ্ন, ভালো স্কুলগুলোর টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্ন একত্র করে ছাপা হতো টেস্ট পেপার।
বাংলাবাজার ফুটপাত থেকে প্রথম কেনা বই কোনটি ছিল, স্মরণ করতে পারছি না। তবে শেষ কেনা বইটির কথা অবশ্যই বলব। ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি একদাম ১০০ টাকায় রামতনু লাহিড়ীর শিবনাথ শাস্ত্রী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ কিনেছি। অধিকাংশ সময়ই ফুটপাত থেকে কেনা বইয়ের মূল্য ও প্রকাশকাল লেখা পাতাটিতে আমিও লিখে রাখি 'অমুক জায়গা' থেকে 'অত টাকায়' কেনা। ২০১১-এর পরেও এ রাস্তায় আরও কয়েকবার গিয়েছি, কিন্তু আমার পছন্দমতো বই পাইনি।
সত্তর ও আশির দশকে বাংলাবাজার খোশরোজ কিতাব মহলে গিয়েছি অনেকবার, মূলত কম দামে অনূদিত বই কেনার জন্য। মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের ভর্তুকি পেয়ে খোশরোজ জ্যাক লন্ডনের সমুদ্রের স্বাদ, বার্নার্ড ম্যালামুডের জাদুর কলস, জন কেনেথ গলব্রেথের গণদারিদ্রের প্রকৃতিসহ বেশ কটা বই প্রকাশ করেছি। বিশেষ করে সমুদ্রের স্বাদ আকারে বড়, দামে কম (তার ওপর প্রকাশকের কাছ থেকে সরাসরি কিনলে শতকরা ৪০ কমিশন) আমি স্বজনদের উপহার দেবার জন্য বিভিন্ন সময় অন্তত পাঁচ কপি কিনেছি। বই কেনার সুবাদেই খোশরোজ কিতাব মহলের কর্ণধার মহিউদ্দিন সাহেবের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং তার সাথে চা খাবার সুযোগও হয়ে যায়, নবতিপর মহিউদ্দিন ভাই এখনো আছেন, শুনেছি অনিয়মিত হলেও বাংলাবাজারে এসে থাকেন। আরও একজন মহিউদ্দিন আহম্মদ, আহমদ পাবলিশার্সের কর্ণধার, তার সাথেও পরিচয় ঘটে, তবে তিনি আমার এক এসএসসি মেটের (একই বছর ভিন্ন স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল) বাবা হওয়াতে একটু দূরত্ব রক্ষা করেই চলেছি। বইপত্র ও প্রকাশনা জগতের আমার সবচেয়ে প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ মহিউদ্দিন আহমেদের কথা নিয়ে একটি পুরো নিবন্ধই লিখেছি- তিনি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
বাংলাবাজার আমার বর্তমান আবাসন থেকে বেশ দূরে হলেও সম্পর্কটি ছিন্ন হয়নি। ২০১০ থেকে আমার বইপত্র বের হতে শুরু করে। বাংলাবাজারে আমার প্রকাশক তালিকায় রয়েছে কথাপ্রকাশ, অন্বেষা, নালন্দা, বাংলাপ্রকাশ, সময়, অন্যপ্রকাশ এবং অক্ষর-কারও কারও প্রধান কার্যালয় নতুন শহরে। সব প্রকাশকের সাথেই সম্পর্ক পেশাদারত্বের এমন বলা যাবে না। ব্যক্তিগত সম্পর্কেরও। আবার এ সম্পর্কেরও হেরফের আছে। আমার অত্যন্ত প্রিয়জন ছিলেন 'সুবর্ণ'র কর্ণধার আহম্মদ মাহফুজুল হক, আমি ডাকতাম জাহাঙ্গীর ভাই। তার সাথে সম্পর্কটিতে চিড় ধরতে পারে, এ আশঙ্কায় তাকে জাহাঙ্গীর ভাইই রেখেছি, আমার প্রকাশক করিনি। করোনাকাল যাদের হরণ করেছে, তিনি তাদের অন্যতম।
বাংলাবাজার গেলেই আমি জানতাম কোথাও না কোথাও একজন স্বজনের সাথে দেখা হবেই-তিনি বুলবুল চৌধুরী, টুকা কাহিনীর বিখ্যাত লেখক। বাংলাবাজারের রাস্তায় হোক, প্রকাশকদের কোনো আস্তানায় হোক কিংবা চায়ের দোকানে- দেখা হতোই। করোনাকাল বুলবুল ভাইকেও হরণ করেছে। তার সাথে বাংলাবাজার থেকে নতুন শহরে রিকশা ভ্রমণের কাহিনি তার অবিচুয়ারিতে উল্লেখ করেছি।
লম্বা হাঁটার শক্তি ও উদ্যম কমে আসাতে গুলিস্তান টু বাংলাবাজার নওয়াবপুর রোডের ভেতর দিয়ে হাঁটা হয়ে ওঠে না, নয়াবাজার হয়ে চাকায় ভর দিয়ে সেখানে পৌঁছি, রিকশার কিংবা বাসের চাকা, কখনো ঘোড়ার গাড়িরও। রেসকোর্সে একসময় ঘোড়দৌড় হতো। ঘোড়দৌড়ের জুয়াও চলত, একালের কারও জানারও সুযোগ নেই যে এই রেসকোর্সের এক প্রান্তেই ছিল প্রাদেশিক চিড়িয়াখানা-পরে মিরপুরে স্থানান্তরিত।
৫৫ বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি বইয়ের দোকানে দোকানে, বিজয়নগরে, পল্টনে, ঢাকা স্টেডিয়ামে, আজিজ মার্কেট, কাঁটাবনে, শহরের তিনটি অভিজাত দোকানে এবং মিরপুর ১০ নম্বর ব্রিজের তলায় পল্লবীগামী রাস্তার পাশে সাত-আটটা বইয়ের টংদোকান বসেছে, সেখানেও। বিদেশেও পুরোনো বইয়ের দোকান খুঁজে বের করেছি-এটাও লিখিত হতে পারে ভিন্ন এক এপিসোডে।
হারানো বইয়ের দোকান খোঁজার কথা লিখতে গিয়ে প্রাত নামের লেখক আমার অপরাহ্নে জীবনের প্রাতকালের অনুসন্ধানের স্মৃতি উসকে দিয়েছেন।
ঢাকা স্টেডিয়ামে আর নিউমার্কেটে দেশের সেরা সাহিত্যিকদের দেখতে পাওয়া তরুণ লেখক ও পাঠকের জন্য ছিল অবিশ্বাস্য এক আনন্দের ব্যাপার। কাজী মোতাহার হোসেন থেকে শুরু করে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শওকত ওসমান থেকে শুরু করে শওকত আলী, আহসান হাবিব থেকে শুরু করে আবিদ আজাদ, এখলাস উদ্দিন আহমদ থেকে শুরু করে আলী ইমাম-কার সাথে আমার দেখা হয়নি? আমার কী অপার সৌভাগ্য ও শ্লাঘার ব্যাপার যে তাদের প্রায় সকলেই কেবল চেহারায় নয় নামেও আমাকে চিনতেন।