লোহার দেশীয় চাহিদা মেটাতে বরগুনায় নতুন জাহাজভাঙ্গা শিল্পাঞ্চল
বাংলাদেশে লোহার চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে, আর তাই জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পকে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এই উদ্দেশে বরগুনার তালতলি উপকূলীয় এলাকায় পরিবেশ বান্ধব জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে সরকার।
আর তাই এই উপকূলীয় এলাকাটির সম্ভাব্যতা যাচাই করতে কাজে নামছে বাংলাদেশ লোহা এবং প্রকৌশল করপোরেশন। সঙ্গে সহযোগী হিসেবে আছে দুইটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান - দক্ষিণ কোরিয়ার জেনটেক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বাংলাদেশের টার্বো মেশিনারি সার্ভিস।
কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক এবং এই প্রকল্পের পরিচালক মো. সাইদুর রহমান জানান, খসড়া প্রস্তাবনায় পুরো প্রকল্পের জন্য অনুমিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১,২০০ কোটি থেকে ১,৩০০ কোটি টাকা। তবে এই বাজেট আরও কমিয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করার পরই কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, ১০৫ একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে একত্রে ১৬ টি জাহাজ ভাঙ্গা-গড়া চলতে পারে। এখানে পরিবেশের সুরক্ষার ব্যাপারটাও নিশ্চিত করা হচ্ছে বলেও জানান মো. সাইদুর রহমান।
উপকূল থেকে সমুদ্রের ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হবে শিপ ইয়ার্ডটি। পায়রা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এখানে ১ লাখ থেকে ১.৭৫ লাখ টন ওজনের জাহাজ অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বাংলাদেশের একটি জাহাজ ভাঙ্গা অঞ্চল আছে। এখানে ১ শয়ের বেশি ওয়ার্ক শপ আছে। এখান থেকে সারাদেশের লোহাের মোট চাহিদার ৩৫-৪০ শতাংশ সরবরাহ করা হয়।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিএসবিএ-র দাবি, সীতাকুণ্ডর জাহাজ ভাঙ্গার এসব ওয়ার্কশপই বিশ্বে খোলা আকাশের নিচে ওয়ার্কশপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়৷ চট্টগ্রামের ফোউজদারহাট থেকে কুমিরা উপজেলা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বিস্তৃত সীতাকুন্ডের এই জাহাজ শিল্প অঞ্চল। তবুও দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
কেননা এই শিল্পের জন্য কমপক্ষে ৫০ হাজার টনের বেশি ওজনের জাহাজ প্রয়োজন হয়। কিন্তু স্বল্প নাব্যতার কারণে এত ভারী জাহাজ এখানে তীরের কাছে প্রবেশ করতে পারে না। আর তাই বরগুনায় নতুন এই জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে আগ্রহী বাংলাদেশ সরকার।
যদিও জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এই শিল্পকে বিশ্বের সবচাইতে ক্ষতিকর পেশা বলে উল্লেখ করেছে।
নেদারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্রিনপিস, প্যারিস ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস এবং চট্টগ্রাম ভিত্তিক ইয়ং পাওয়ার ইন স্যোশাল অ্যাকশন একত্রে একটি জরিপ প্রকাশ করে। এই জরিপের ফলাফল অনুযায়ী- বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে এই শিল্পাঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে অন্তত একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে, কর্মরত শ্রমিকদের অন্তত একজন করে মারা যায়।
কিন্তু তালতলি জাহাজ শিল্প অঞ্চলে উন্নত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, ফলে এই দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক মৃত্যু সম্ভব হবে বলে জানালেন বাংলাদেশ লোহা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা।
তারা আরও বলেন, এই শিল্পে দুর্ঘটনা ও মানব ক্ষতি হ্রাসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নীতিমালাগুলো অনুসরণ করা হবে এখানে।
এদিকে প্রস্তাবিত এই শিপ ইয়ার্ডের আশেপাশের এলাকার পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ বান্ধব কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করা হবে- এমন আশ্বাস দেয়া হলেও চিন্তায় আছেন পরিবেশবিদরা।
‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’ সংস্থার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সালাম বলেন, এ ধরণের প্রকল্প নেয়ার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছ থেকে একটি ‘নো অবজেকশন’ সনদ নিতে হয়।
প্রকৌশলী সোবহান বলেন, এছাড়াও এই ধরণের প্রকল্পে পরিবেশের সুরক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষতি এড়াতে আরও নানা ধরণের যাচাই আর পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা প্রয়োজন।
আর এইসমস্ত যাচাই-বাচাই প্রকল্পের কাজ শুরু হবার আগেই শেষ করা এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার বলে জানান তিনি।
সীতাকুণ্ডে এক শতেরও বেশি শিপইয়ার্ড আছে, যেখানে ২ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন।
বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এই শিপ ইয়ার্ডগুলোতে প্রতি বছরে ৩০/৩৫ হাজার টন ওজনের প্রায় ২০০ টি জাহাজ ভাঙ্গা হয়। স্টিল বা লোহার দেশীয় চাহিদা মেটাতে জন্য ২৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টনের মতো কাঁচামাল সরবরাহ হয় এখান থেকে।
কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে লোহার চাহিদা আছে প্রায় ৭০ লাখ টনের। চাহিদা আর যোগানের মধ্যে এই ব্যাপক তফাৎ কাঁচামালের আমদানির উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের।
আবার অন্যদিকে, বাংলাদেশ লোহা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রস্তাবিত এই জাহাজ শিল্পাঞ্চল হলে নিঃসন্দেহে দেশের বাজারে কাঁচামালের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে, নির্ভরশীলতা কমবে বিদেশি আমদানির উপর থেকে। এছাড়াও, স্থানীয় লোকজনের জন্য সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান।