১৬ বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি, কার্যক্রম শুরুর পর কেবল প্রসারই ঘটেছে কর্ণফুলী ইপিজেডের
২০০৬ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের রপ্তানি আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে ক্রমাগতভাবে প্রসার ঘটছে ২০৯ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত কর্ণফুলী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের। ঋণের চাপে ১৯৯৯ সালে ভেঙ্গে পড়া দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইস্পাত কারখানা চট্টগ্রাম স্টিল মিল ছিল ঠিক এই জায়গাতেই।
একই জায়গায় নির্মিত কর্ণফুলী ইপিজেড ১৬ বছরের মধ্যে ৭৮ হাজারটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
দেড় যুগের ব্যবধানে মাত্র ২ হাজার শ্রমিক নিয়ে লোকসানে ডুবে থাকা স্টিল মিল পরিণত হয়েছে দেশসেরা ইপিজেডে। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে এ ইপিজেড থেকে।
২০০৬ সালে চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গায় ২৫৮টি বাণিজ্যিক প্লট নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় কর্ণফুলী ইপিজেড। প্রতিটি প্লটের আয়তন ২ হাজার বর্গমিটার।
বিনিয়োগ, উৎপাদনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে সবসময়ই আকর্ষণীয় ইপিজেড। এজন্য চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে কর্ণফুলী ইপিজেড গড়ে তুলে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন কর্তৃপক্ষ (বেপজা)।
দেড় যুগে ইপিজেডটি শুধু এগিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশসেরা ইপিজেডের মুকুট ওঠে প্রতিষ্ঠানটির ঝুড়িতে।
বেপজা'র তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠার পর ২০০৬-০৭ অর্থবছরে মাত্র ১.৯১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছিল কর্ণফুলী ইপিজেড। ১৭৪ জন জনশক্তি নিয়ে পরের অর্থবছরে (২০০৭-০৮) রপ্তানি আয় হয় ৯.৮৬ মিলিয়ন ডলার। এরপর বছর বছর বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে, সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান। নিজের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে রপ্তানি আয়।
২০১১-১২ অর্থবছরে বিনিয়োগের পরিমাণ পৌঁছে ২১৭ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলারে। কর্মসংস্থান হয় ২৬৮৩০ জনের। রপ্তানি আয় পৌঁছে ৪৮৯.০১ মিলিয়ন ডলারে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪৩৩.০৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়; ৬৩ হাজার ১১৮ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় ও ২৯২৮.৫০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে রপ্তানি আয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বিনিয়োগ ৬১১.৫৪ মিলিয়ন ডলার, ৬৯ হাজার ৩৬৪ জনের কর্মসংস্থান হয় ও রপ্তানি আয় ৬৭৬১.৫৭ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।
চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত বিনিয়োগ ৭০৪.০৫ মিলিয়ন ডলার, ৭৮ হাজার ৫৭ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং রপ্তানি আয় ৯৬৯৮.৯১ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।
বর্তমানে এই ইপিজেডে পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্ট ২৯টি প্রতিষ্ঠান, ব্যাগ উৎপাদনকারী দুটি, টেন্ট ও আউটডোর পণ্য উৎপাদনকারী দুটি, ফার্নিচার উৎপাদনকারী একটি, জুতা ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী ৫টি, বাইসেইকেল সংশ্লিষ্ট দুটি, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনকারী দুটি এবং সেবাভিত্তিক ৩টিসহ মোট ৫১টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
তবে পুরোদমে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে ৪২টি প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে বিদেশি মালিকানায় ২৭টি, দেশি মালিকানায় ১২টি ও দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় রয়েছে ৩টি প্রতিষ্ঠান।
কর্ণফুলী ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ এনামুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কর্ণফুলী ইপিজেডে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, রপ্তানি এবং কর্মসংস্থান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ইপিজেডে ৫১টি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।"
"প্রায় ৮০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ অর্থবছরেও প্রায় ১৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান ছাড়া এখানকার অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাকোয়ার্ডের কাজের মাধ্যমেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে,"
তিনি আরো বলেন, "এখানকার প্রতিষ্ঠান সাব-কন্ট্র্যাক্টের মাধ্যমে বাইরের অনেক প্রতিষ্ঠানকে দিয়েও কাজ করাচ্ছে।"
চট্টগ্রাম স্টিল মিলস চালু থাকা অবস্থায় সর্বশেষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন সালামত উল্লাহ। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কারখানাটির আধুনিকায়ন হয়নি। আমরা ওপেন হাথ মেশিনে উৎপাদন করতাম। এতে বিদ্যুৎ-গ্যাস বেশি ব্যয় হতো।"
"জাহাজ ভাঙা স্ক্র্যাপের আধিপত্যের কারণে ইস্পাত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। শুধু বিএসআরএম ও ন্যাশনাল আয়রন কোম্পানি আমাদের কাছ থেকে বিলেট নিতো। দুটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে তো চলা যায় না। এছাড়া এখানে শ্রমিকদের তিনটি গ্রুপ হয়ে যায়। তারা ঠিকভাবে কাজ করতেন না। তখন ব্যাংক ঋণ ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এসব অব্যবস্থাপনার কারণে কারখানাটি চালানো সম্ভব হয়নি।"
"২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর তৎকালীন বাণিজ্য মন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এখানে ইপিজেড প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সর্বশেষ এখানে দুই হাজার শ্রমিক কর্মরত ছিলেন," বলেন এমডি সালামত উল্লাহ।