অর্থবছরের সাত মাসের মাথায় জানা গেল, প্রকল্প অগ্রাধিকার তালিকা কাজে লাগবে না
চলতি অর্থবছরের সাত মাসের মাথায় এসে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অগ্রাধিকার তালিকা আবারো পুনর্বিন্যাসের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, কারণ দেখা যাচ্ছে প্রকল্পের প্রথম অগ্রাধিকার তালিকা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ফলে গত বছরের জুলাই থেকে সরকারের উন্নয়ন কাজে ব্যয় সংকোচনের সিদ্ধান্ত কতোটা কার্যকর হয়েছে, তা নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
এছাড়া, সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ ১৫ হাজার কোটি টাকা কমানোর যে প্রস্তাবনা রয়েছে, সেটাও দেশের চাপের মুখে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে আরও শঙ্কার মধ্যে ফেলেছে। মঙ্গলবারের এডিপি পর্যালোচনা সভায় এর বিরোধিতা করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
৪৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে এই সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার তহবিল থেকে আরও ব্যয়ের পক্ষে মত দিয়েছেন, কারণ এতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।
উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ, বি এবং সি ক্যাটাগরিতে পুনর্বিন্যাসের এই প্রস্তাব এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম টিবিএসকে বলেন, এটা প্রস্তাব আকারে দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত হবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সম্মতি পাওয়া পর।
চূড়ান্ত হলে, সংশোধিত এডিপিতে অর্থছাড়ের দিক থেকে প্রকল্পগুলো পুনর্বিন্যাস করা হবে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, এর আগে ২০২২ সালের জুলাইয়ে এ, বি এবং সি ক্যাটাগরির অগ্রাধিকার তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে করা হলেও, এবার যৌথভাবে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করবে পরিকল্পনা কমিশন, অর্থবিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ।
শামসুল আলম-ও মনে করেন, প্রকল্পের অগ্রাধিকার তালিকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে আসা উচিত। কারণ কোন প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ এবং এখন অর্থব্যয় করা দরকার- সে বিষয়ে তারা সবচেয়ে ভালো বুঝবে।
'তালিকা পুনর্বিন্যাসে অর্থ বিভাগ এবং পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সহযোগিতা করবে'- যোগ করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, 'এ' ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অনেক অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, যেখানে অর্থছাড় দেওয়া হচ্ছে। এর বিপরীতে, গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরও পর্যাপ্ত অর্থছাড় পাচ্ছে না কিছু প্রকল্প। এর ফলে সরকার ব্যয় সংকোচনের যে উদ্দেশ্যে অগ্রাধিকার তালিকাটি করেছে, তা ব্যাহত হচ্ছে।
রাশিয়া– ইউক্রেন যুদ্ধ, ক্রমাগত বিশ্বমন্দার আভাস, করোনা মহামারির অভিঘাত থেকে উত্তরণ ইত্যাদি কারণে গত বছর সরকার ব্যয় সংকোচনের এই উপায় গ্রহণ করে। এর মূল লক্ষ্য ছিল- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা এবং জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
এই ধারাবাহিকতায় সরকার কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থছাড় বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। চলতি অর্থবছরের শুরুতে গত বছরের ৩ জুলাই অর্থবিভাগ থেকে জারি করা এক পরিপত্রের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ, বি এবং সি ক্যাটাগরি প্রকল্পের তালিকা প্রকাশ করা হয়।
পরিপত্র অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ প্রকল্প থেকে 'এ' ক্যাটাগরির প্রকল্প বাস্তবায়নে শতভাগ বরাদ্দ অক্ষুণ্ণ রাখা হয়।
'বি' ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর বরাদ্দের সরকারি বরাদ্দের অংশের ২৫ শতাংশ কর্তন করা হয়। আর 'সি' ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলো চলতি অর্থবছর কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারবে না।
অগ্রাধিকার তালিকায় বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট সব প্রকল্প 'এ' ক্যাটাগরিতে রাখা হয়। 'বি' ক্যাটাগরির ৬৩৬টি প্রকল্পের অর্থায়ন হ্রাস করা হয়। অর্থবিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী, 'সি' ক্যাটাগরির ৮১ প্রকল্পের অর্থছাড় বন্ধ করা হয়।
এখন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে করা ওই অগ্রাধিকার তালিকায় বেশকিছু ত্রুটি ছিল। যেমন সমাপ্ত হয়ে যাওয়া এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই এমন প্রকল্পও অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। আবার তালিকায় অনেক প্রকল্প একাধিক বার এসেছে।
তাদের মতে, নতুন করে অগ্রাধিকার তালিকা পুনর্বিন্যাস করা হলে এসব ভুল সংশোধন হবে। আবার গত ছয় মাসে সরকারিভাবে যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সংশোধিতে এডিপিতে সেসব প্রকল্পে অগ্রাধিকার অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হবে।
অবহেলা?
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, গাজীপুর এ্যাপ্রোচ সড়ক প্রশস্তকরণ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (৩য় সংশোধিত) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের করা অগ্রাধিকার তালিকায় 'এ' ক্যাটাগরিতে দুই বার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
একইভাবে, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় শেখ রাসেল এ্যাভিয়ারী এ্যান্ড ইকো-পার্ক প্রকল্পটি 'বি' ক্যাটাগরিতে দুইবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সম্পন্ন হওয়ার পরও ১২৮ কোটি টাকার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস নির্মাণ প্রকল্প 'বি' এবং 'সি' উভয় ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে।
সেতু বিভাগের ৮.৯০ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে পাতাল মেট্রোরেল নির্মাণের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প 'এ' ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে, নতুন প্রযুক্তির প্রচলন, জরিপ ও ডিজিটাল ম্যাপ প্রণয়নের মতো ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ভূমি ডিজিটাইজেশনের মোট ৪ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকার সাতটি প্রকল্পে অর্থছাড় বন্ধ করা হয়েছে।
আবার 'বি' এবং 'সি' ক্যাটাগরিতে থাকার পরও কিছু প্রকল্পের ব্যয় সীমা বাড়ানো হয়েছে। গত জুলাইয়ে ক্যাটাগরি নির্ধারণের পর সরকারি তহবিল থেকে বরাদ্দ বাড়াতে এসব প্রকল্পের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে আবেদন করা হয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেও অগ্রাধিকার প্রকল্প চূড়ান্ত করতে না পারাটা হতাশাজনক। 'প্রকল্পের যাচাই-বাছাই এখনও শেষ নাহলে– বাস্তবায়নের কাজ শেষ করা হবে কখন?"- প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, সঙ্কটকালীন সময়ে অপ্রয়োজনীয় খাতে সাশ্রয় করে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করার কথা জানানো হয়েছিল। 'এমন একটি তালিকায় ভুল থাকায় পুরো উন্নয়ন কাজে অবহেলারই বহিঃপ্রকাশ'।
বাস্তবায়ন সক্ষমতা না বাড়ায় পরিকল্পনামন্ত্রীর সাথে মঙ্গলবারের সভায় কর্মকর্তারা বিদেশি সহায়তার উন্নয়ন বরাদ্দ ১৫ হাজার কোটি টাকা হ্রাসের প্রস্তাব দেন।
চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দ থেকে ৯৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব ছিল। সংশোধিত এডিপিতে তা কমিয়ে ৭৮ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় পরিকল্পনামন্ত্রী, বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দ থেকে অর্থ ব্যয় বাড়ানোর নির্দেশ দেন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে, যাতে দুর্বল রিজার্ভের ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমে আসে।