সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়াই ‘নকল’ পোশাক রপ্তানির অভিযোগ করা হয়েছে: যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চিঠিতে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের পোশাক লোগোসহ হুবহু নকল করে রপ্তানির অভিযোগ পর্যালোচনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট। সম্প্রতি দেশটির এ পর্যালোচনার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। চিঠিতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এ অভিযোগের কোনো সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ বা সত্যতা নেই বলেও বাংলদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর (ইউএসটিআর) এর কাছে পাঠানো চিঠিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সম্প্রতি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে 'মেধাস্বত্ব রক্ষার প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার অনুপস্থিতি এবং উচ্চ পর্যায়ে চরম দুর্নীতির কারণে মেধাস্বত্ব আইন নিশ্চিত করাও অসম্ভব' বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা বাংলাদেশের বাস্তবতায় সঠিক নয়।
ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বাণিজ্য সংগঠনের তরফ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর বাংলাদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর (ইউএসটিআর)। সংগঠন দুটির একটি যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডগুলোর প্রভাবশালী সংগঠন আমেরিকান অ্যাপারেল এন্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন (এএএফএ) এবং অন্যটি প্যারিস-ভিত্তিক নকল প্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের পক্ষে কাজ করা ইউনিয়ন ডেস ফেব্রিক্স (ইউনিফ্যাব)।
এএএফএ'র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কর্পোরেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এর রিপোর্টে বাংলদেশকে বৈশ্বিক নকল পণ্যে তৈরির শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও চীন, হংকং, তুরস্ক ও ভিয়েতনামের নামও রয়েছে এ তালিকায়।
তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠিতে এ তথ্যকে ভুল বলে দাবি করা হয়েছে। একইসাথে জানানো হয়েছে যে, ওইসিডি'র ঐ তালিকায় বাংলাদেশ নকল পণ্য তৈরির শীর্ষ ২৫ দেশের মধ্যেও নেই। চিঠিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, ওইসিডি'র ঐ রিপোর্টে বাংলাদেশকে শুধু নকল পণ্যে তৈরির উৎস হিসেবে শনাক্ত করে এসব পণ্য রপ্তানির প্রবণতা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ ওঠায় 'স্পেশাল ৩০১ রিভিউ অন আইপিআর প্রোটেকশন এন্ড এনফোর্সমেন্ট' এর উদ্যোগ নিয়েছে ইউএসটিআর। এটি মূলত বৈশ্বিক মেধাসত্ত্ব রক্ষা ও কার্যকরের দিকটি তত্ত্বাবধান করে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইউএসটিআরের কাছে পাঠানো চিঠিতে জানানো হয়, ওইসিডি'র রিপোর্টে বিশ্বব্যাপী আটক করা নকল পণ্যগুলোর ৯০ ভাগ যে পাঁচটি দেশ থেকে এসেছে বলে শনাক্ত করা হয়েছিল সেখানেও বাংলাদেশের নাম নেই। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এ চিঠির পরেও পর্যালোচনা শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিপত্তিতে পরতে পারে বাংলাদেশ।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বাড়তি শুল্ক আরোপ, কোটা বেঁধে দেওয়া, এমনকি নিষেধাজ্ঞার মত ব্যবস্থা নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ইউনিটের অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল) মোঃ হাফিজুর রহমানের স্বাক্ষরিত চিঠিতে ইউএসটিআর এর প্রতি সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, "আমরা সংগঠন দুটির সাবমিশনগুলো যথাযথভাবে পর্যালোচনার দাবি জানাই। বিশেষ করে মেধাস্বত্ব রক্ষায় সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের যে অর্জন, সেটিকে বিবেচনা করে।" এছাড়াও সেকশন ৩০১ এর অধীনে পর্যালোচনায় বাংলাদেশকে যুক্ত করা হলে সেটি অন্যায্য হবে এবং মেধাস্বত্ব রক্ষায় আমাদের যে কার্যক্রম ব্যাহত হবে বলেও চিঠিতে বলে হয়েছে।
অন্যদিকে এএএফএ এর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা নকল পণ্য ব্যাপকভাবে জব্দ করা হচ্ছে। জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলে, "একটি সংগঠন থেকে ঢালাওভাবে দাবিটি করা হয়েছে এবং এর পক্ষে কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং দেশের বিদ্যমান আইনে মেধাস্বত্ব রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।"
২০ জানুয়ারি, ২০২৩ এ এএএফএ এর চিঠিতে দাবি করা হয়, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অফিস বাংলাদেশকে তৈরিকৃত নকল পোশাক রপ্তানির তৃতীয় বৃহত্তম উৎস হিসেবে শনাক্ত করেছে। এর উত্তরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিঠিতে বলে, "২০১৯ সালে প্রকাশ হওয়া ঐ রিপোর্টে বাংলাদেশকে নকল পোশাক তৈরির প্রধান উৎস হিসেবে শনাক্ত করা হয়নি।"
বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য হারে সিডি ও ডিভিডি রপ্তানি করে না। কিন্তু তবুও ঐ রিপোর্টের এক অংশে বাংলাদেশের প্রতি সিডি ও ডিভিডি নকল করার অভিযোগ করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাল্টা চিঠিতে বলা হয়, "রিপোর্টে যেসব নকল পণ্য আটক করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে খুবই কম পরিমাণে পণ্য বাংলাদেশের বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এমনকি নির্দিষ্ট কয়েকটি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এ পণ্যগুলো জব্দ করেছিল। পণ্যগুলো আসলেই নকল কি-না সে সম্পর্কে তারা কোনো প্রমাণ কিংবা ব্যাখ্যাও দেয়নি।"
এএএফএ এর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, বাংলাদেশের র্যাব ও সিআইডি দুর্নীতিপ্রবণ এবং তারা মেধাস্বত্ব ভঙ্গের অভিযোগকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। জবাবে চিঠিতে বলা হয়, "মেধাস্বত্ব রক্ষায় শুধু এ দুটি প্রতিষ্ঠানই কাজ করে বিষয়টি এমন নয়। ঠিক কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে নকল পণ্য তৈরি করছে এএএফএ সে সম্পর্কে কোন প্রমাণ দেয়নি। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ২০১৯ সালের ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস অনুযায়ী গোপন তথ্যর ভিত্তিতে কিংবা মেধাস্বত্ব যার নামে রয়েছে তার অভিযোগের ভিত্তিতে কাস্টমস পণ্য জব্দ করে থাকে।"
মেধাস্বত্ব রক্ষায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বলতে যেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেন, "বাংলাদেশ কাস্টমস, বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ এবং সকল আইন- শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না দিয়ে বরং একটি দেশের সংস্থা সম্পর্কে ঢালাওভাবে দুর্নীতির মন্তব্য করে দেওয়া ভিন্ন উদ্দেশ্য বহন করে।" এছাড়াও চিঠিতে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি মেধাস্বত্ব ভঙ্গ করে নকলের প্রমাণ পায়, তবে কাস্টমস কমিশনারকে তা অবহিত করার কথা বলা হয়েছে। ঐ আবেদনের প্রেক্ষিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বাংলাদেশের কাস্টমস যে নকল পণ্য জব্দ করতে বদ্ধপরিকর, সেটি প্রমাণে একটি ঘটনাও চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, "চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি বিখ্যাত বৈশ্বিক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম চট্টগ্রাম কাস্টমসে অভিযোগ করেন যে, এমএন্ডএইচ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের ট্রেডমার্ক অনেকটা নকল করে পোশাক রপ্তানি করছে। এইচঅ্যান্ডএম এর এ অভিযোগটি চট্টগ্রাম কাস্টমস অফিস আমলে নিয়েছে এবং এ বিষয়টি পর্যালোচনা করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।" একইসাথে চিঠিতে জানানো হয় যে, বাংলাদেশ কাস্টমস শুধু রপ্তানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রেই নয়, বরং আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রেও নকল পণ্য শনাক্তে কাজ করে যাচ্ছে।
এএএফএর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, বাংলাদেশ একটি বিক্রেতা গোষ্ঠী সোশ্যাল মিডিয়া (ফেসবুক, লিংকডইন, ওয়াটসঅ্যাপ) এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম (লাজাডা, শপি) ব্যবহার করে বিশ্ব বাজারে নকল পণ্য পাইকারি দামে বিক্রি করছে। এর উত্তরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, "বাংলাদেশে কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মেরই বিদেশে ব্যবসা নেই। এমনকি শপি ও লাজাডা বাংলাদেশের প্ল্যাটফর্মও নয়। আর নকল পণ্য কেনা-বেচা বন্ধে বাংলাদেশে ২০১৯ সালের একটি কড়া নীতিমালা রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রেও একই। নিজ দেশের সীমানায় এসব আইন প্রয়োগ করা হয়।"
অন্যদিকে ২৬ জানুয়ারির পাঠানো এক চিঠিতে ইউনিফ্যাবের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, নকল পণ্যের রপ্তানিকারক হিসেবে বাংলাদেশের নামটি সামনে আসছে। ইউরোপ, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ফিলিপাইনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো নকল পণ্য জব্দ করা হয়েছে।
ইউনিফ্যাবের এ অভিযোগের জবাবে চিঠিতে বলা হয়, "বাংলাদেশে পোশাক তৈরিতে সংশ্লিষ্টরা ব্র্যান্ডগুলোর প্রতি আস্থাশীল এবং ব্র্যান্ডগুলো অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট। জব্দকৃত পণ্যগুলো সবসময় যে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা হয় বিষয়টি এমন নয়। বরং তৃতীয় কোন দেশ থেকে বাংলাদেশে বানানো ঐসব পণ্যের ট্যাগ ব্যবহার এসব নকল পণ্য পাঠানো হতে পারে।"