সামনে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন, রপ্তানি প্রণোদনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সরকারের
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণ হওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের। এই লক্ষ্যে, পর্যায়ক্রমে সব ধরনের রপ্তানি পণ্যে প্রণোদনা হ্রাস করার একটি কৌশলগত পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এই উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকরা।
বিশ্লেষকরা অবশ্য এটিকে দূরদর্শী পদক্ষেপ বলেই মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, দিনশেষে করদাতাদের টাকায় রপ্তানিতে দেওয়া এসব প্রণোদনার সুফল পায় পশ্চিমা বায়ার (ক্রেতা প্রতিষ্ঠান) ও তাঁদের ভোক্তারা।
গতকাল মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলারে জানায়, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী সময়ে একত্রে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না করে– চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকেই সরকার বিভিন্ন ধাপে নগদ সহায়তা/ প্রণোদনার হার অল্প অল্প করে হ্রাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকেই হ্রাসকৃত প্রণোদনা হার কার্যকর হয়েছে, যা ৩০ জুন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
অর্থনীতিতে পরিমাণের দিক থেকে পোশাক খাতই সবচেয়ে বেশি প্রণোদনা পায়। নতুন নীতিতে, তৈরি পোশাক খাতে বিশেষ নগদ সহায়তার হার ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
ক্রাস্ট লেদার রপ্তানিতে রপ্তানি প্রণোদনা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য শতাংশ করা হয়েছে।
এছাড়া, নতুন বাজারগুলোয় রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রণোদনার হার ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। এই হ্রাসের আওতাভুক্ত হয়েছে পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, কৃষিপণ্যসহ আরও অন্যান্য খাত।
সার্কুলারটি কার্যকর হওয়ার আগে, প্রণোদনার সর্বোচ্চ হার ছিল কৃষিপণ্যের জন্য। যেমন আলু ও প্রক্রিয়াজাত মাংস রপ্তানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হতো, যা এখন কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, প্রধান তিনটি নতুন বাজার– অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানে রপ্তানিতে ৪ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হতো। নতুন সার্কুলারে, এসব বাজারকে প্রচলিত বাজারের তালিকায় আনা হয়েছে, যেক্ষেত্রে নগদ সহায়তার হার হলো শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী, সরকার ৪৩টি খাতে রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা প্রদান করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, নগদ প্রণোদনার ৬৫ শতাংশ বা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার মূল সুবিধাভোগী হলো তৈরি পোশাক ও বস্ত্র শিল্প।
রপ্তানিকারকদের শঙ্কা
প্রণোদনা হ্রাসের বিষয়ে রপ্তানিকারকরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, এতে তাঁদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তৈরি পোশাক প্রস্তত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন - বিজিএমইএ'র সভাপতি ফারুক হাসান টিবিএস'কে বলেন, "শুরুতে ৪টা ক্যাটাগরিতে প্রণোদনার হার কমানো হয়। তারপর ফাইনালি এসে সরকার বলছে, পাঁচটি এইচএস (হারমোনাইজড সিস্টেম) কোডের আইটেম এখন আর কোনো ইনসেনটিভ পাবে না। অথচ এই পাঁচ আইটেম পোশাক রপ্তানির অপরিহার্য অংশ।"
নতুন সার্কুলার অনুসারে যেসব পোশাক পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা দেওয়া হবে না, সেগুলো হচ্ছে– পুরুষ ও বাচ্চা ছেলেদের জন্য নিটেড বা ক্রশেট শার্ট, টি শার্ট, ভেস্ট, জার্সি, পুলওভার, কার্ডিগান, জ্যাকেট, ব্লেজার, ট্রাউজার, স্যুট ও সমজাতীয় পণ্য। এদের এইচএস কোডগুলো হলো– ৬১০৫, ৬১০৭, ৬১০৯, ৬১১০ এবং ৬২০৩।
বিজিএমইএ'র তথ্যমতে, নগদ সহায়তা প্রত্যাহার করা এই পাঁচ ধরনের আইটেম ২৫.৯৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় অর্জনে ভূমিকা রেখেছে, যা গত অর্থবছরে হওয়া মোট রপ্তানির ৪৬.৭১ শতাংশ। মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির মধ্যে যা ছিল ৫৫.২২ শতাংশ।
নতুন বাজারের ক্যাটাগরি থেকে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে ফারুক হাসান বলেন, "আমরা এই তিনটা দেশে খুব কষ্ট করে মার্কেট ডেভলপ করেছিলাম। হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত আমাদের পুরো শিল্পকে ব্যাপক ঝুঁকির মুখে ফেললো। নতুন সার্কুলারের পর এখন অল্প কিছু পণ্যে নগদ সহায়তা পাওয়া যাবে।"
তিনি বলেন, সার্কুলারের প্রথমে বলা হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটও)-র বিধিবিধান অনুসারে, ২০২৬ সালের পর আর নগদ সহায়তা দেওয়া যাবে না, সেজন্য এটি হ্রাস করা হয়েছে।
"কিন্তু, আমরা বারবার বলে আসছি এখন কমায়েন না। কারণ ফরেন কারেন্সিতে আমাদের কম্পিটিটিভ থাকতে হবে। ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক অর্ডার কম। দেশে ডলারের সংকট। সে কারণে দেশে কীভাবে আরও ডলার আনা যায়- সেকাজ করতে হবে। আমাদের রিজার্ভ কমতে কমতে এমন জায়গায় গেছে যে এলসি খুলতেও সমস্যা হচ্ছে।"
"একারণে কাঁচামাল আমদানি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই আমরা প্রণোদনা না কমানোর কথা বলেছিলাম। কিন্তু, সরকার তাতে রাজি হলো না"- যোগ করেন তিনি।
নিটওয়্যার প্রস্তুতকারকরা হতাশ
বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বিকেএমইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান বলেন, "একদিকে সরকার আমাদের মূল্য সংযোজনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। অন্যদিকে, অন্যদিকে মূল্য সংযোজিত পণ্যের জন্য নগদ সহায়তা তুলে নিচ্ছে। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।"
স্যুট, ব্লেজার, এনসেম্বল-সহ বিবিধ উচ্চ মূল্যের পণ্যের জন্য নগদ সহায়তা কমানোর বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি পণ্য বৈচিত্র্যকরণকেও বাধাগ্রস্ত করবে।
"পোশাক রপ্তানি আয়ে সিংহভাগ অবদান রাখে নিটওয়্যার খাত, কিন্তু এই ধরনের জটিল শর্তের অর্থ হলো– খুব বেশি নগদ সহায়তা পাবে না। ফলে বিশ্ব বাজারে আমরা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাব। বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক অর্ডার চলে যাবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে"- যোগ করেন বিকেএমইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট।
বাংলাদেশ তুলা ও পেট্রোকেমিক্যাল থেকে শুরু করে পোশাক শিল্পের সব ধরনের কাঁচামাল আমদানি করে। অন্যদিকে, ভারত ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশগুলো নিজেরাই কাঁচামাল উৎপন্ন করে। শুধুমাত্র সস্তা শ্রম নিয়েই বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা করছে।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন:
এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, করদাতাদের টাকায় রপ্তানিতে দেওয়ার প্রণোদনার দিনশেষে সুফল পায় পশ্চিমা ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও তাঁদের ভোক্তারা। পশ্চিমা ব্র্যান্ড ও বায়াররা প্রণোদনার হিসাব করেই দাম ঠিক করে। তাঁরা নিজেদের কৌশলগুলোয় প্রণোদনাকে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য প্রভাবিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে দেখে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান– পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এলডিসি গ্রাজুয়েশন নীতির আলোকে, গত কয়েক বছর ধরেই পর্যায়ক্রমে রপ্তানিতে প্রণোদনা বন্ধের আলোচনা হয়ে আসছে।
"রপ্তানিকারকরা এখন সুবিধাজনক এক্সচেঞ্জ রেট (বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় দর)- এর সুবিধা পাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে কোন ধরণের নগদ সহায়তার প্রয়োজন নেই"- বলেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
ধাপে ধাপে রপ্তানি প্রণোদনা প্রত্যাহারের সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন– সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, আমরা রপ্তানিকারকদের শুধুমাত্র প্রণোদনার মাধ্যমেই সহায়তা করি না। আরও অনেক জায়গা রয়েছে। সেসব জায়গায় অসুবিধাগুলো কমিয়ে আনতে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
যেমন- আমাদের অধিকাংশ রপ্তানিকারককে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের অসুবিধা পোহাতে হয়। নানান কারণে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পরিচালনার খরচ বেড়ে যায়, চাঁদাবাজির কারণেও তাদের খরচ বাড়ে। এসব জায়গাতে কাজ করতে হবে সরকারকে। আমলাতান্ত্রিক সমস্যা দূর করে ব্যবসার বিকাশকে প্রণোদিত করতে হবে।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিধিবিধানের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে যা বলা হয়েছে:
এতে বলা হয়েছে, ডব্লিউটিও'র বিধিবিধান অনুসারে, নগদ সহায়তাকে রপ্তানি-নির্ভর ভর্তুকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং সংস্থাটির এগ্রিমেন্ট অন সাবসিডিস অ্যান্ড কাউন্টারভেইলিং মেজার্স (এএসসিএম) অনুসারে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কোনো প্রণোদনা প্রদান করা যাবে না।