বাড়তি নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রুটে প্রতি ট্রিপে ১ লাখ ডলার ব্যয় বাড়ছে শিপিং কোম্পানিগুলোর
সমুদ্রের জলদস্যুপ্রবণ এলাকা নিরাপদে পাড়ি দিতে বাংলাদেশের শিপিং কোম্পানিগুলোকে বাড়তি নিরাপত্তা নিতে হচ্ছে। এতে প্রতি ট্রিপে প্রায় এক লাখ ডলার বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে তাদের। জাহাজ মালিকরা বলছেন, বাড়তি এই ব্যয়ের কারণে বেড়ে যাচ্ছে ফ্রেইট চার্জ (মালবহনের ভাড়া), এই খরচ শেষপর্যন্ত ভোক্তাদেরই বহন করতে হবে।
ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশের একটি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ সোমালি জলদস্যুদের হাতে অপহরণের প্রেক্ষাপটে – সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থাকে যুদ্ধঝুঁকি বীমা, সশস্ত্র রক্ষী মোতায়েন, জলকামান ও লেজার অস্ত্রের মতো সুরক্ষা সরঞ্জাম কেনার জন্য অতিরিক্ত এই অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজ মালিকদের সমিতি –বিওজিএসওএ'র চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ জলদস্যুর কবলে পড়ার পর সকল সমুদ্রগামী জাহাজ মালিককে যুদ্ধঝুঁকি বীমা নিতে বলা হয়েছে। রক্ষীসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পাড়ি দিতে দেওয়া হয়েছে নির্দেশনা।"
"বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে প্রতি ভয়েসে ওয়ার রিস্ক ইন্সুরেন্স বাবদ প্রায় ৫০ হাজার ডলার যোগ হবে। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পাড়ি দেওয়ার সময় এসকর্ট (সশস্ত্র রক্ষী) নিতে গেলেও– সেক্ষেত্রে আরো প্রায় ৫০ হাজার ডলার ব্যয় হবে। অর্থাৎ, উভয় ক্ষেত্রে প্রতিটি ভয়েসে ফ্রেইট চার্জ এর সাথে অতিরিক্ত যোগ হবে প্রায় ১ লাখ ডলার। বাড়তি এই ব্যয় যোগ হলে আন্তর্জাতিকভাবে ফ্রেইট চার্জ বেড়ে যাবে। এতে পণ্যমূল্যের উপর প্রভাব পড়বে"- যোগ করেন তিনি।
শিপিং খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং হুথিদের লোহিত সাগরে হামলার কারণে– সমুদ্রপথের বাণিজ্যে অস্থিরতা চলছিল। এতে যাত্রার সময় ও ফ্রেইট চার্জ দুইই বেড়ে যায়। এরমধ্যে একটি বাংলাদেশি জাহাজে সোমালি জলসদ্যুদের অপহরণের ঘটনা সংকট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
মোজাম্বিক থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার উপকূলের অদূরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজের ২৩ নাবিককেও পণবন্দী করেছে সোমালি জলদস্যুরা।
এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের কর্তৃপক্ষ ঈদুল ফিতরের পর নাবিকদের মুক্ত করতে জলদস্যুদের সঙ্গে আলোচনার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) নির্দেশনা অনুযায়ী, জলদস্যুতা প্রতিরোধে জাহাজে উচ্চক্ষমতার জলকামান রাখার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া অ্যাকুস্টিক ও লেজার গান রাখতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে জাহাজের চারপাশে তারকাঁটার বেড়া স্থাপন করা যায়, বোট ট্র্যাপ বা জালের ফাঁদ রাখা যায় (জাল ছুড়ে দস্যুদের ব্যবহার করা ছোট নৌযান আটকে ফেলার জন্য)। লুব্রিক্যান্ট ফোম আরেকটি অস্ত্র, যা দিয়ে দস্যুদের হটিয়ে দেওয়া যায়। এসবের পাশাপাশি সশস্ত্র রক্ষী নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমবি।
মেঘনা ওশেন গোয়িং ফ্লিটের মহাব্যবস্থাপক (কারিগরি) মোহাম্মদ আবু তাহের টিবিএসকে বলেন, "আমাদের মেঘনা হারমনি জাহাজটি দুবাই থেকে সাউথ আফ্রিকার পথে রয়েছে। এই অঞ্চল পাড়ি দিতে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে আর্মড গার্ড নিতে হয়েছে। পণ্য পরিবহনে যেহেতু বাড়তি খরচ যোগ হচ্ছে– তাই স্বাভাবিকভাবেই এই প্রভাব পড়বে ভোক্তাপর্যায়ে পণ্যের মূল্যে।"
হুথিদের হামলার আগে ইউরোপ-আমেরিকার রূটে চলাচলকারী জাহাজের দৈনিক ভাড়া ছিল প্রায় ২৫ হাজার ডলার। এখন সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ডলারে। জলদস্যুদের এই সংকটের কারণে এই ভাড়া আরো বাড়তে পারে বলে জানান তাহের।
দরিয়া শিপিং লিমিটেডের পরিচালক মাশুদ আলমও একই ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে চলাচল করে এমন বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা ৯৬টি। এরমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ৭টি, কবির গ্রুপ (কেএসআরএম) এর ২৩টি, মেঘনা গ্রুপের ২২টি, আকিজ গ্রুপের ১০টি, এইচ আর লাইনের ৮টি, বসুন্ধরা গ্রুপের ৬টি, ভ্যানগার্ড শিপিংয়ের ৬টি, এম আই সিমেন্ট এর তিনটি, দরিয়া শিপিং দুটি, হানিফ গ্রুপের দুটি, পিএনএন শিপিং এর দুটি জাহাজ রয়েছে। এছাড়া, ওরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিং লিমিটেড, সানশাইন ন্যাভিগেশন, সাফিনাহ পিএইচ ন্যাভিগেশন, ডোরিন শিপিং এবং এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি করে জাহাজ রয়েছে।
বাণিজ্যিক জাহাজে গানম্যান কিংবা অস্ত্র রাখার কোনো নিয়ম বর্তমানে নেই। তবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পাড়ি দেওয়ার সময় বিভিন্ন বন্দর থেকে পাঁচজন বা তার অধিক সশস্ত্র রক্ষী (গানম্যান) নিয়ে যেত জাহাজগুলো। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পাড়ি দেওয়ার পর আশপাশের কোন বন্দরে নেমে যেত এসব রক্ষীরা।
অঞ্চল এবং ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী, গানম্যান বাবদ ২০ হাজার ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার ডলার পর্যন্ত গুনতে হতো বলে জানিয়েছেন জাহাজ মালিকরা। তবে জলদস্যুদের উৎপাত কমে আসায় জাহাজ মালিকরা বাড়তি খরচ এড়াতে সশস্ত্র রক্ষী নেওয়া প্রায় বন্ধ করে দেয়। তবে এমভি আবদুল্লাহ জলদস্যুর কবলে পড়ার পর থেকে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এসব এলাকা পাড়ি দিতে এখন রক্ষী নিচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে পরিচালন ব্যয়।
জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সমুদ্রেপথে বাণিজ্যিক জাহাজে পণ্য পরিবহনে সাতটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রুট ও স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব অঞ্চল দিয়ে জাহাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে দস্যুদের কবলে পড়ার ঝুঁকি থাকে। এই অঞ্চলগুলো হলো– সোমালিয়া উপকূল, এডেন উপসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগরের উত্তরাংশ, অফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল, গিনি উপসাগর ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূলবর্তী অঞ্চল। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি জলদস্যুপ্রবণ এলাকা সোমালিয়া ও গিনি উপসাগর।
আজম জে চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর সক্রিয় অভিযান ছাড়া, বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর জলদস্যুদের আক্রমণ বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এর আগে ২০১০ সালের দিকে যখন জলদস্যুতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল– তখন বিভিন্ন দেশের অভিযানের কারণে দস্যুতার ঘটনা প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে আসে। এখন যেহেতু আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে, তাই অভিযান পরিচালনার কোনো বিকল্প নেই।
শিপিং খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ সমুদ্রপথে পরিচালিত হয়। এর সঙ্গে প্রায় ৯৩ হাজার বাণিজ্যিক জাহাজ এবং সাড়ে ১২ লাখ নাবিক জড়িত। সমুদ্রপথে বিশ্ববাণিজ্যের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলদস্যুপ্রবণ এলাকাগুলো দিয়ে পরিচালিত হয়।