খাদ্যমূল্য বাড়ছেই: সীমিত আয়ের মানুষ আর কত কাটছাঁট করে চলবে?
বিহঙ্গ পরিবহনের হেল্পার আল আমিনের স্ত্রী-সন্তানসহ চারজনের পরিবার। প্রতি মাসে আল আমিনের ১৩–১৫ হাজার টাকার আয় দিয়েই চলতে হয় এই পরিবারকে। কিন্তু বাজারে জিনিসপত্রের চড়া দামের কারণে মাসের খাবারেই এই আয়ের বড় অংশ শেষ হয়ে যায়। এর বাইরে বাসাভাড়া দেওয়ার পর হাতে আর টাকা থাকে না।
নির্দিষ্ট ছকের বাইরে গিয়ে বাজার করা, দুই সন্তানের পেছনে বাড়তি খরচের সুযোগ পান না আল আমিন। কারণ একটাই—খাবারের খরচ বেড়ে যাওয়া।
ঢাকার কাঁচাবাজারগুলোতে প্রধান সবজিগুলোর দাম হয়ে গেছে আকাশছোঁয়া। রামপুরা, বাড্ডা, সেগুনবাগিচা, কারওয়ানবাজারসহ কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৫–৬০ টাকা কেজি দরে। যা নিয়মিত দামের দ্বিগুণ।
শুধু আলুই নয়, সারা বছর যে কাঁচা পেপে বিক্রি হয় ২৫–৩০ টাকায়, সেটির দামও এখন দ্বিগুণের বেশি। বাজারভেদে ৬০–৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি। কয়েকদিন আগে অবশ্য এই দাম ৯০–১০০ টাকায় উঠেছিল।
ঝিঙ্গা, বেগুন, বরবটিসহ এ সময়ের বিভিন্ন সবজি ৮০ টাকার কমে খুব একটা পাওয়া যায় না। মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় যোগ দিয়েছে পেঁয়াজও; পণ্যটি এখন ৭৫–৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান হোসেন মাস্টার বলেন, এই সময়টাতে সবজির দাম সবসময়ই একটু বেশি থাকে। তবে গত দুই বছরের তুলনায় এবার দাম আরও একটু বেশি।
ক্রেতা-বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম সীমিত আয়ের মানুষকে চাপে রেখেছে। অনেকে খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে, অনেকে সামান্য যা সঞ্চয় রেখেছিল তা ভেঙে খাচ্ছে।
মিরপুর বিহঙ্গ পরিবহনের এক কাউন্টারের সামনে হেল্পার আল আমিন টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য আলু, ডিম, ডাল নিত্যদিনের খাবার। আলু এখন দ্বিগুণের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। গরুর মাংস শেষ কবে কিনেছিলাম মনে নেই। গোশত বলতে ব্রয়লার মুরগি—সেটার দামও এখন চড়া। ডিমের হালিতেও ১৫ টাকা বাড়তি দিতে হচ্ছে।'
অথচ বাংলাদেশের সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভালো হওয়ার কারণে আগে সারা বছরই আলুর দাম থাকত ২০–৩৫ টাকার মধ্যে। একেবারে উৎপাদন মৌসুমের শেষভাগে গিয়ে আলুর দাম একটু চড়া হতো।
কিন্তু গত বছর মিধিলি ও মিগজাউমের মত দুটি ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে আলু উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে এখন আলুর সরবরাহ কম, দাম চড়া।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, এবারে বেশিরভাগ কোল্ড স্টোরেজগুলোতেই ২০–২৫ শতাংশ পর্যন্ত খালি পড়ে আছে আলুর উৎপাদন কম হওয়ার কারণে। প্রতি বছর যেখানে ১১–১২ টাকা কেজি দরের আলু আসত কোল্ড স্টোরেজে, এবারে সেটা ৩০–৩১ টাকায় এসেছে।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আলুর দাম এবার ৩৭.৩৩ শতাংশ বেশি। তবে পেঁপের দাম বেশি হওয়ার কোন ব্যাখ্যা বিক্রেতাদের কাছেও নেই।
ধানের পরিস্থিতিও ভালো নয়। দেশের সবচেয়ে বড় ধান উৎপাদনের মৌসুমেও (বোরো) চালের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই।
আগের মতই প্রতি কেজি মোটা চাল কিনতে হচ্ছে ৫৩–৫৪ টাকায়। চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা পর্যন্ত দামে। আর মাঝারি মানের কিছু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকার ওপরে। টিসিবি বলছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় মোটা চালের দাম ৮.৩৩ শতাংশ এবং চিকন চাল ৬.৮০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
এর বাইরে প্রোটিনের সবচেয়ে সস্তা উৎস হিসেবে পরিচিত ব্রয়লার মুরগির মাংস ও এর ডিমের দামও বেড়েছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে এখন ২১৫–২২০ টাকা কেজি দরে। গত বছরের এই সময়ে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৯০ টাকার মধ্যে।
প্রতি ডজন ডিমের দাম মাসখানেক আগেও ছিল ১২০–১৩০ টাকার মধ্যে, যেটি এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৫–১৬০ টাকায়। অবশ্য হালি কিনলে এর দাম পড়ছে ৫৫ টাকা। প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম এখন ৭৮০–৮০০ টাকা। গরুর মাংস এখন সীমিত আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে।
স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে মিরপুর ডিওএইচএসে থাকেন রিক্সাচালক আব্দুল গফুর। করোনার সময় চাকরি হারিয়ে গত তিন বছর ধরে ডিওএইচএসে রিক্সা চালান তিনি।
গফুর জানান, প্রতিদিন ২৩০ টাকা রিক্সার মালিককে দিতে হয়। এর বাইরে ৫০০–৬০০ টাকার মতো আয় হয়; কম-বেশিও হয় কখনও কখনও। এই টাকায় এখনকার বাজারে সংসার চলে না।
বাসা ভাড়া দেয়ার পর অল্প কটা টাকা থাকে গফুরের হাতে। প্রতিদিন এক কেজি করে চাল কেনেন তিনি। এর সঙ্গে সবজি-ডিম দিয়ে কোনোরকম খান।
'মেয়েটা মাছ-মাংস খাইতে চায়। কিন্তু খাওয়াইতে পারি না,' বলেন গফুর।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সম্প্রতি বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে পরিবারপ্রতি খাবার খরচ বেড়ে ২ হাজার ৯২৩ টাকা হয়েছে, যা দুই বছর আগের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি।
এই বাড়তি খরচের চাপ সামলাতে ৬৮ শতাংশ মানুষ টিকে থাকতে ব্যয় কমিয়েছে। ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, বাকিতে খাবার কিনছে ৪৩ শতাংশ মানুষ, ২২ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা খরচ কাটছাঁট করছে এবং ১৩ শতাংশ মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এই প্রভাব মূলত সীমিত আয়ের মানুষের ওপরই পড়েছে।
বাংলামোটরের বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্টের ক্রেতা বলতে বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। এই হোটেলের ম্যানেজার গিয়াস উদ্দিন বলেন, 'মাছ-মাংস খাওয়া মানুষের সংখ্যা কমে গেছে, প্রতিনিয়ত কমছে। কারণ বাধ্য হয়েই দাম বাড়াতে হয়েছে। আমাদের ক্রয় খরচ তো বেড়ে গেছে। বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে আয়ও কমে গেছে।'
এই হোটেলে খেতে আসা সিনএনজি চালক মো. ফারুক বলেন, 'মাছ খেতে চাইলে ১০০ টাকার নিচে নেই। অথচ বছর দুয়েক আগে ৫০–৬০ টাকার মধ্যে মাছের তরকারি পাওয়া যেত। বাধ্য হয়েই ডিম দিয়ে ভাত খাচ্ছি, ডিমের দামও এখন অবশ্য এলাকাভেদে ৩০–৩৫ টাকা।'