রপ্তানিতে উৎসে কর দ্বিগুণ করার কথা ভাবছে সরকার
রপ্তানিকারকদের জন্য দুঃসংবাদ!
বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে, পাওয়া যাচ্ছে মন্দার পদধ্বনি। এর জেরে আগামী মাসগুলোতে রপ্তানির গতি মন্থরতার পূর্বাভাসের দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যেই সরকার আসন্ন জাতীয় বাজেটে রপ্তানি আয় থেকে কর্তনকৃত উৎসে কর ০.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার কথা ভাবছে বলে বাজেট সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এই করহার দ্বিগুণ করা হলে তা 'ভয়াবহ' পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজস্ব আদায় বাড়ানোর সম্ভাব্য সেরা উপায় হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) হয়তো উৎসে কর বাড়াতে চায়।
তবে আরএমজি খাত অন্যান্য বাড়তি কিছু সুবিধা পাওয়ায় সবার জন্য উৎসে কর সমান হলে ইফেক্টিভ রেট অব প্রোটেকশনে (ইআরপি) নন-আরএমজি খাত পিছিয়ে থাকবে বলেও মনে করছেন তারা। এই বিষয়টা বিবেচনায় নেওয়া দরকার বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো রপ্তানিকারকদের ওপর উৎসে কর আরোপ করে সরকার। শুরুতে এই করহার ছিল ০.২৫ শতাংশ। পরে বিভিন্ন সময়ে তা বাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ শতাংশ করও ছিল।
দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে কেবল তৈরি পোশাক খাত থেকে। তাই বিভিন্ন সময়ে রপ্তানির উৎসে কর বাড়লে তা ঠেকাতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হন এ খাতের উদ্যোক্তারাই।
অতীতে বিভিন্ন সময় এ খাতের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া ও দেশের অর্থনীতিতে খাতটির অবদান বিবেচনায় সহায়তার অংশ হিসেবে সরকারও খাতটির উৎসে কর কমিয়ে রাখছিল। ফলে অন্যান্য রপ্তানি খাতও এ সুবিধার আওতায় চলে আসে।
গত এক দশক বা তার বেশি সময় ধরেই দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতি বছরই রপ্তানির উৎসে কর শুরুতে বাড়ানোর পর রপ্তানিকারকরা দেনদরবার করে তা কমিয়ে আনতে সক্ষম হন।
তবে সমস্ত রপ্তানিকেন্দ্রিক খাতের জন্য উৎসে কর সমান হলেও আরএমজি খাতের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বাড়তি করহার রয়েছে নন-আরএমজি খাতের উপর।
অবশ্য গত দুই বছর ধরে কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় রপ্তানি আয়ের উপর উৎসে কর ০.৫ শতাংশ হারে আদায় করছে সরকার।
অতীতে উৎসে কর কমানোর দাবি জানিয়ে এলেও এবার বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এই করহার কমানোর দাবি না জানিয়ে বরং স্থিতিশীল কর নীতির অংশ হিসেবে বিদ্যমান করহার আগামী পাঁচ বছরের জন্য স্থির (ফিক্সড) রাখার দাবি জানিয়েছিল।
সম্প্রতি এক আলোচনায় বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান এই দাবি জানান।
রপ্তানির করহার বর্তমানের তুলনায় বেড়ে দ্বিগুণ হলে তা রপ্তানিকারকদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, ইউরোপ, আমেরিকাসহ প্রধান রপ্তানি গন্তব্যগুলোতে মূল্যস্ফীতির কারণে আসছে মাসগুলোতে এ খাতে রপ্তানির গতি ধীর হয়ে যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।
ফজলুল হক বলেন, 'এমন পরিস্থিতিতে করহার বাড়লে তা হবে মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।
'আরএমজি খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দেখে মনে হতে পারে আমাদের বুঝি আয় বেড়ে গেছে। আসলে এই প্রবৃদ্ধি মূলত কাঁচামালসহ অন্যান্য খরচ বৃদ্ধির কারণে।
'আমরা কিছুটা বাড়তি টাকা পেলেও যে হারে ব্যয় বেড়েছে, সে হারে পাই না।
তিনি আরও বলেন, লোকসান হলে দিলেও উৎসে কর হিসেবে কেটে রাখা টাকা তাদের পক্ষে ফেরত নেওয়া সম্ভব হয় না—এমনকি আয় না হলেও কর দিতে হয়। 'তারপরও আমরা চেয়েছিলাম বিনিয়োগের স্বার্থে আগামী পাঁচ বছরের জন্য বিদ্যমান করহারকে ফিক্সড রাখার জন্য।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, এনবিআর তাদের রাজস্ব সংগ্রহের বাধ্যবাধকতা থেকে উৎসে আয়কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, কেননা এটিই তাদের কর আহরণের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার।
তিনি অবশ্য এ-ও বলেন যে, 'উৎসে কর হিসেবে কেটে নেওয়া টাকার চূড়ান্ত সমন্বয়ের সময় আমরা সমস্যার কথা শুনি। ডকুমেন্টেশনের উপর ভিত্তি করে এই প্রক্রিয়াটিকে আরও স্বচ্ছ করা উচিত।'
ড. দেবপ্রিয় বলেন, সব রপ্তানিকারকের জন্যই উৎসে একই করহার নির্ধারণ করা উচিত। আরএমজি ও নন-আরএমজি রপ্তানিকারকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য করা উচিত নয়।
এই অর্থনীতিবিদের মতে, আরএমজিসহ রপ্তানিকেন্দ্রিক সব খাত যদি তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বাড়তি নীতি সহায়তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করে, তাহলে তাদের উচিত শুধু এনবিআর নয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ করা।
ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, রপ্তানি আয়ের এই অগ্রিম আয়কর বাড়ানোর প্রস্তাবে এনবিআর সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে পারে। খসড়া বাজেট আলোচনায় সময় দরকষাকষি করে—বর্তমান হারের চেয়ে বেশি রেখে—এই হার কমানো হতে পারে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৪৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এ সময় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৫ শতাংশ।
রপ্তানিকারক ও ইপিবি আশা করছে, অর্থবছরের শেষ নাগাদ রপ্তানির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে।
সেই হিসাবে রপ্তানি খাত থেকে উৎসে কর আদায় হতে পারে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা (১ ডলার=৮৬ টাকা হিসেবে)।
অর্থ মন্ত্রণালয় প্রাক্কলন করেছে, আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে চলতি অর্থবছরের চেয়ে রপ্তানি ২০ শতাংশ বেশি হবে।
এই প্রাক্কলন সত্যি হলে আগামী বছর দেশের রপ্তানি আয় হবে ৬০ বিলিয়ন ডলার। সেক্ষেত্রে যদি ১ শতাংশ উৎসে কর কার্যকর হয়, তাহলে কর আদায় হতে পারে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বা ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৩৮.৭৫ বিলিয়ন ডলার, আর রপ্তানি আয় থেকে অগ্রিম কর আদায় হয়েছে ১৯৩.৭ মিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।
সব রপ্তানিকারকের জন্য আয়কর এক নয়। তবে চলতি অর্থবছরে সব খাতের কাছ থেকেই উৎসে কর একই হারে আদায় করা হয়।
বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বর্তমানে আরএমজি খাতের রপ্তানি আয়ের উপর করপোরেট কর ১২ শতাংশ, গ্রিন কারখানা হলে তা ১০ শতাংশ। আর নন-আরএমজি খাতের ক্ষেত্রে তা ৩০ শতাংশ।
রপ্তানির ওপর ০.৫ শতাংশ অগ্রিম কর দিতে হয় রপ্তানিকারকদের। তবে শুরুতে উৎসে দেওয়া করের অর্থ পরবর্তীতে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় মূল আয়করের হিসাবে তা সমন্বয় করার সুযোগ রয়েছে।
তবে আয়কর বিভাগ ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় সব রপ্তানিকারকই উৎসে কাটা করের হিসাব অনুসারে আয় দেখান। এর ফলে বাড়তি আয় হলেও তারা আর কর দেন না। আবার লোকসান দিলেও বা আয় না করলেও তারা আর অগ্রিম কর হিসেবে দেওয়া অর্থ ফেরত নেন না বা নিতে পারেন না।
রপ্তানিকারকরা বলেন, কর কর্তৃপক্ষের শর্ত মেনে সবার পক্ষে ওই করের অর্থ ফেরত পাওয়া বাস্তবে সম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা।