চীনের নতুন নিরাপত্তা বলয় হয়ে আসছে ‘হিমালয়ান কোয়াড’?
চীনের উত্থান ও মুক্ত আন্তর্জাতিক নির্দেশাবলীর বিরুদ্ধ কর্মকান্ডের সাজা দেয়ার জন্য ওয়াশিংটন ও তার মিত্ররা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা অবশেষে চীনকে নতুন করে তাদের নিরাপত্তা বলয় সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করেছে। চতুর্ভুজাকৃতির নিরাপত্তা সম্মিলন বা 'কোয়াড' (কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়লগ) ঘটানোর চিন্তা করছে চীন।
চীন দলগত কাজে বিশ্বাসী এবং পরবর্তী নীতি পরিবেষ্টনের লক্ষ্যে তারা জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে একত্রিত করার কথা ভাবছে। তবে বেইজিং এর বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন যদি সত্যিই সমবেত নিরাপত্তা বলয় তৈরির কথা ভাবে, তাহলে শুধুমাত্র নিরাপত্তার দিকেই নয়, সন্ত্রাসবিরোধী চ্যালেঞ্জ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক বিষয়গুলোর উপরেও নজর দেয়া উচিত।
গত মার্চেই অনুষ্ঠিত হয়েছে এই চতুর্ভুজের প্রথম সামিট পর্যায়ের সভা, যেখানে চার দেশের নেতারা ২০২২ সালের মধ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ডোজ কেনার জন্য ১ বিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয়েছেন। তবে এই পদক্ষেপকে বৃহৎ অর্থে বিবেচনা করলে চীনের ভ্যাকসিন-কূটনীতি বললেও ভুল হবে না।
এদিকে রাশিয়ার সঙ্গেও সামরিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য সাড়া দিয়েছে বেইজিং। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ' গত সপ্তাহে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে 'দ্য রিটার্ন অফ দ্য কোয়াড: উইল রাশিয়া অ্যান্ড চায়না ফর্ম দেয়ার ওউন ব্লক?'-এ এসব তথ্য জানায়। সেখানে আরও বলা হয়েছে যে এই চতুষ্টয় সামিটের জন্য চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমে গুয়ানজি প্রদেশে চীন ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সাক্ষাৎ করেছেন।
যদিও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরোভ এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত দুই পক্ষের মৈত্রীর সংবাদ নাকচ করে দিয়েছেন। সের্গেই দাবি করেন, গত সপ্তাহে ভারত সফরে মস্কো একটি সর্বব্যাপী সহযোগিতার সম্পর্কের দিকে আগ্রহ দেখালেও এ ধরনের মৈত্রী এখন 'বিপরীত' হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দুই দেশই জোট নিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাসী।
এ মাসের শুরুর দিকে বেলারুশিয়ান ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ-এর একজন বিশেষক ইউরি ইয়ামলিনস্কি, ভারতের অবজার্ভার রিসার্চ-দ্বারা প্রকাশিত একটি নিবন্ধে জানান, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ফলে বেইজিং খুব সম্ভবত সমতা বজায় রাখতে হিমালয়ান কোয়াড প্রজেক্টে চীন, নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকেই অন্তর্ভুক্ত করবে।
এ সপ্তাহে 'দ্য এশিয়া' ইয়ারমলিনস্কির সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, তিনি প্রাথমিকভাবে দিল্লীভিত্তিক 'মনোহর পারিকার ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস'-এর ইস্ট এশিয়া সেন্টার কো-অর্ডিনেটর ও রিসার্চ ফেলো জগন্নাথ পান্ডার মতামতের উপর ভিত্তি করে কথাটি লিখেছিলেন। জগন্নাথ পান্ডা নভেম্বরে 'দ্য ট্রান্স-হিমালয়ান কোয়াড, বেইজিংস টেরোরিজম অ্যান্ড ইন্ডিয়া' নামক নিবন্ধে 'হিমালয় কোয়াড' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
সাবেক বেলারুশীয় কূটনীতিক ইয়ারমলিনস্কি বলেন, চীনা কোয়াড এতদিন পর্যন্ত শুধুমাত্র একটি নীতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সত্যিই যদি 'রেড লাইন', অর্থাৎ দক্ষিণ চীন সমুদ্রে সামরিক হস্তক্ষেপ, তাইওয়ানের স্বাধীনতার জন্য সমর্থন ও এমন কোনো বিবৃতি বা পদক্ষেপ যা চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের ক্ষতিসাধন করতে পারে- এ জাতীয় সীমারেখা লঙ্ঘন করা হয় তাহলে এই হিমালয়ান কোয়াড বাস্তবায়িত হতে পারে।
যতদিন পর্যন্ত বেইজিং এর জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষিতে ক্যানবেরা, নয়াদিল্লী, টোকিও ও ওয়াশিংটন এই সীমারেখা বা রেড লাইন অতিক্রম না করবে, ততদিন পর্যন্ত এটি শুধুই তত্ত্ব হয়ে থেকে যাবে, বললেন ইয়ারমলিনস্কি।
কাঠামো কি ইতিমধ্যেই রয়েছে?
ইয়ারমলিনস্কি জানিয়েছেন, চীন ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা ও কৌশলগত সহযোগিতার দিক থেকে নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মিত্র হয়ে রয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে বেইজিং ও ইসলামাবাদ ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সংযোগগত ও অবকাঠামোগত প্রজেক্ট 'চীন-পাকিস্তান অর্থনীতি করিডোর'-এ যুক্ত রয়েছে। এই প্রজেক্টটি চীনকে একটি বৈশ্বিক বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক হিসেবে গড়ে তুলতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ 'বেল্ট অ্যান্ড রোড'-এর অধীনে রয়েছে। এছাড়া নিরাপত্তা প্রসঙ্গেও দুই পক্ষই যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে নেপাল বেইজিং এর কাছ থেকে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়ে আসছে যা হিমালয়ের এই ছোট দেশটিতে তিব্বতের সাথে সীমান্ত পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্যে প্যারামিলিটারি পুলিশদের নিয়ে একটি ট্রেনিং সেন্টার খুলতেও সাহায্য করেছে। দুই দেশের সেনাবাহিনীই আগেপরে অনেকবার সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে একসাথে অংশ নিয়েছে।
ইয়ারমলিনস্কি বলেন, সিনো-ইন্ডিয়ান সীমান্ত বিবাদীয় প্রেক্ষিতে নেপাল হিমালয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জিনজিয়াং-এ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আফগানিস্তান একটি বড় ভূমিকা পালন করছে।
আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী প্রতিরক্ষা কাজে চীনও আফগানিস্তানকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বেইজিং আফগানিস্তানকে ৭০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে।
এছাড়াও জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্ক এন কার্টজ বলেন, পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাস দমনের নামে আমেরিকার আগ্রাসনের ফলে আমেরিকাবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছে পাকিস্তানের মধ্যে এবং তারা চীনের সঙ্গেই মিত্রতা করতে আগ্রহী।
ভারতের যতক্ষণ পর্যন্ত চীন ও পাকিস্তান দুজনের সঙ্গেই খারাপ সম্পর্ক রয়েছে, ইসলামাবাদ ও বেইজিং এর সেদিক থেকে একে অপরকে সাহায্য করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
মনোহর পারিকার ইনস্টিটিউটের জগন্নাথ পান্ডা জানান," চীন ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯ এর নাম দিয়ে নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে একত্রে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। চীনের হিমালয় চতুর্ভুজ আসলে ভারতের এ অঞ্চলের দখলের সঙ্গে সমতা করার প্রচেষ্টা। যেহেতু বেইজিং দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তাই স্বভাবতই তারা এসব দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী মিত্র তৈরি করে ফায়দা উঠাতে চাইবে।"
আপাতদৃষ্টিতে হিমালয়ান কোয়াড নামক নিরাপত্তা বলয়কে 'অদূর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা' মনে হলেও, পান্ডার মতে, দেশগুলোর মধ্যকার সমন্বয় বৃদ্ধিই প্রমাণ দেয় যে বেইজিং এর নেতৃত্বে এরকম একটি জোট অসম্ভব কিছু নয়। চীনের নেতৃত্বে এই জোটে রাশিয়া, পাকিস্তান, এমনকি ইরান, তুরস্কও আসতে পারে।
অনাস্থাভাজক মিত্র
বেশকিছু দেশকে চীনকে সহায়তা দিয়ে গেলেও, তাদের মিত্র দেশগুলোর নিজস্ব দারিদ্র, দুর্বল অর্থনীতি এবং সামরিক দুর্বলতাসহ নিজেদের নানা সমস্যায় ব্যস্ত থাকার ফলে তারা চীনের পক্ষে খুব কার্যকরী মিত্র হবেন না বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা।
জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্টজ বলেন, 'দুই বড় দেশের মাঝখানে চাপা পড়া নেপাল কখনো চাইবে না একটির সঙ্গে অতি মিত্রতার মাধ্যমে অন্যটির শত্রু হয়ে দাঁড়াতে। যদিও সম্প্রতি কাঠমান্ডুকে দিল্লীর পরিবর্তে বেইজিং এর দিকেই ঝুঁকতে দেখা গেছে'।
ভারতের সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবে মিত্রতা থাকলেও ২০১৫ সাল থেকে দিল্লীর চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের কারণে সীমান্ত বিবাদের ফলে দুই দেশের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের সরকার নিজেরাই দুর্বল এবং অস্থিতিশীল। তালেবানদের ক্রমাগত হামলা-হুমকিতে ভীত তারা। আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নিবে বলে ঘোষণা দেয়ার পর সেখানে আবারও কঠোর ইসলামি শাসনের তালেবান ক্ষমতা জারি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কার্টজ এর মতে, যুক্তরাষ্ট্র চলে যাবার পরপরই চীন যদি কাবুলে ভালোরকম সহায়তা না দেয়, তাহলে তালেবানদের ঠেকানো সম্ভব হবেনা। তবে চীন হয়ত তালেবানদের সঙ্গে কাজ করতে রাজি থাকবে যদি না তারা আবার উইঘুর মুসলিমদের সাহায্য করার দাবি না করে বসে।
তাই দেখা যাচ্ছে যে চীনের সকল সম্ভাব্য মিত্র দেশেরই অন্য কারো সঙ্গে মিত্রতা তৈরি করে ফেলার সম্ভাবনাও রয়েছে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে রাশিয়া, যারা পশ্চিমের চাইতেও চীনকে বড় ঝুঁকি মনে করে।
তবে এক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হচ্ছে পুতিনের পরবর্তী উত্তরসূরিও কি একইভাবে চিন্তা করবেন কিনা; এ ব্যাপারে পুতিন এখনো পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত জানাননি।
- সূত্র- সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট