চীনা রাজদরবারে বাংলার জিরাফ
একটি জিরাফ
চীনের মিং সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট ইয়ংলে (ব্যক্তিগত নাম ঝু ডি)। ১৪০২ থেকে ১৪২৪ সাল অবধি ক্ষমতায় ছিলেন তিনি।
'মিং শি-লু' বা 'ভেরিটেবল রেকর্ডস অব দ্য মিং ডাইনাস্টি (১৩৬৮-১৬৪৪)' থেকে জানা যাচ্ছে, ইয়ংলের শাসনামলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই তাঁর জন্য উপহার হিসেবে যেত চমকপ্রদ সব পশু-পাখি।
যেমন চম্পা থেকে যেত হাতি ও গণ্ডার, সিয়াম থেকে ভালুক, জাভা থেকে টিয়াপাখি ও ময়ূর, এডেন থেকে অস্ট্রিচ ইত্যাদি। নানজিংয়ের রাজকীয় মাঠে জিন-ইউয়ান বা নিষিদ্ধ বাগান নামক একটি বিশেষ অংশও ছিল, যেখানে এসব পশুপাখিকে রাখা হতো, করা হতো যত্নআত্তি।
তবে এই এতসব পশুপাখির মধ্যে, সম্রাটের সবচেয়ে পছন্দের ছিল বিশেষ একটি প্রাণী। এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন সেটিকে যে, ক্যালিগ্রাফার ও চিত্রশিল্পী শেন দুকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই প্রাণীটির ছবিও এঁকে ফেলার জন্য।
জানতে চান, কী সেই প্রাণী? একটি 'কি-লিন', তথা চীনা পৌরাণিক জন্তু। তবে আদতে সেটি ছিল একটি জিরাফ — 'বাং-গে-লার জিরাফ'।
বাংলার সঙ্গে কী যোগসূত্র?
বাং-গে-লা হলো 'বাঙ্গালা' শব্দটির চীনা সংস্করণ। মধ্যযুগে বাঙ্গালা নামেই পরিচিত ছিল আমাদের এই বাংলা অঞ্চল।
নথি অনুযায়ী, জিরাফটি চীনা সম্রাটের কাছে পাঠিয়েছিলেন বাংলার কোনো এক 'রাজা সাই-ফু-দিং'। এবার স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে মনে, এই সাই-ফু-দিং আবার কে!
ইতিহাসের সাল-তারিখ মিলিয়ে বাংলার এক রাজার সঙ্গে অবশ্য নামের ধ্বনিগত সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় এই সাই-ফু-দিং এর। তিনি হলেন সাইফউদ্দিন হামজা শাহ (শাসনকাল ১৪১০-১৪১২ সাল)। বাংলার প্রথম ইলিয়াস শাহি রাজবংশের চতুর্থ সুলতান ছিলেন তিনি। তার পিতা সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুত পর তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং 'সুলতানুস সালাতিন' উপাধি ধারণ করেন।
চীনা সম্রাটের কাছে জিরাফটি পাঠানো হয় ১৪১৪ সালে বাংলা থেকে চীনে যাওয়া দূতদের মাধ্যমে। ওই দূতরা ছিলেন, কাগজে-কলমে, চীনা সম্রাটের কাছে পাঠানো বাংলা সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব। জিরাফটি ছাড়াও তাঁরা সম্রাটের জন্য উপহারস্বরূপ নিয়ে যান বিভিন্ন বিখ্যাত জাতের ঘোড়া এবং বাংলার স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী সব পণ্য। এছাড়াও সম্রাটের কাছে তারা পেশ করেন একটি স্মারক (আনুষ্ঠানিক চিঠি)।
এসবের বিনিময়ে তারাও সম্রাটের রাজদরবার ত্যাগ করেন দুহাত ভরে অজস্র উপহার সামগ্রী নিয়ে।
এই যে চীনা সম্রাটের প্রতি অন্যান্য দেশের উপহার, এবং চীনা সম্রাটেরও তাদেরকে ফিরতি উপহার প্রদান, এর নাম ছিল 'শ্রদ্ধাঞ্জলী প্রথা'। বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সেই সুদূর অতীত থেকেই চীনে এই প্রথাটি আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করা হতো।
যখনই কোনো বিদেশি সরকারের প্রতিনিধি গিয়ে চীনা সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপন করতেন, চীনা রাজ-কর্মচারীরা সেটিকে মনে করতেন ওইসব বিদেশি সরকার কর্তৃক চীনা আধিপত্যের স্বীকৃতি হিসেবে।
কিছু প্রশ্ন
'মিং শি-লু'র কয়েকটি অনুচ্ছেদে উল্লিখিত এসব তথ্য অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন ধরুন, বাংলার জিরাফকে কেন সেখানে বলা হচ্ছে 'কি-লিন'? তাছাড়া জিরাফ নামক প্রাণীটিও তো বাংলার স্থানীয় কোনো প্রাণী নয়। তবে সেটি প্রথমে বাংলায় এলোই বা কীভাবে? কেনই বা সুলতান এটি উপহার দিলেন চীনা সম্রাটকে? কীভাবে এটি নিয়ে যাওয়া হলো চীনে? এটি পেয়ে প্রাথমিকভাবে চীনাদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? এটি কীভাবে পরিণত হলো একটি বিখ্যাত চীনা চিত্রকর্মের বিষয়বস্তুতে?
এদিকে বাংলার সরকারের পক্ষ থেকে চীনে যাওয়া সেই দূতেরাই বা কারা ছিলেন? সংখ্যায় তারা কতজন ছিলেন? কীভাবে চীনে গিয়েছিলেন তাঁরা? কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে তাদের এই চীন গমন বাংলার সঙ্গে চীনের সম্পর্কে কেমন প্রভাব ফেলেছিল? তাদের সম্পর্কের মাত্রা ঠিক কতটা গভীর ছিল, এবং একটি জিরাফ কীভাবে সেই সম্পর্কের প্রতীক বনে গেল?
এই লেখায় সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আপনাদের কৌতূহলী মনকে তৃপ্ত করা সম্ভব নয়। চেষ্টা করছি প্রধান কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার।
বাংলার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক
১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সালের মধ্যে শি-লু এবং অন্যান্য বিভিন্ন চীনা নথি ঘাঁটলে দেখা যায়, বাংলার কথা মাঝেমধ্যে এসেছে বটে, কিন্তু খুব বেশি কূটনৈতিক বিনিময়ের উল্লেখ সেখানে নেই। মিং ইতিহাসের দলিল মিং শিতে বাংলার ব্যাপারে অল্পবিস্তর উল্লেখ থাকলেও, লেখক বাংলার পরিবর্তে প্রধানত সমগ্র ভারতবর্ষকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নথিভুক্ত করেছেন সুদূর অতীত থেকে ভারতবর্ষের সঙ্গে চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কথা। ভারতকে সেখানে ডাকা হয়েছে 'শেন-দু' ও 'তিয়ান-ঝু' নামে, যেগুলো সম্ভবত 'হিন্দু' শব্দের চীনা উচ্চারণ।
বলা হয়েছে, মধ্য ভারত থেকে লিয়াংয়ে (৫০২-৫৭ এবং দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর ওয়েইতে (৩৮৬-৫৩৪) শ্রদ্ধাঞ্জলী হিসেবে উপঢৌকন পাঠানো হতো। তাং (৬১৮-৯০৬) চীনাদের দৃষ্টিতে, ভারত ছিল পাঁচটি তিয়ান-ঝুতে বিভক্ত। সংরাও (৯৬০-১২৭৯) ভারতকে ডাকত তিয়ান-ঝু নামে। এসব কথা তুলে ধরা হয়েছে যে অনুচ্ছেদে, সেটির শেষ লাইনে গিয়েই কেবল বাংলার প্রসঙ্গ এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলা অবস্থিত ভারতের পূর্বাঞ্চলে, এবং সমুদ্র-পশাই থেকে ২০ দিন সমুদ্রযাত্রার মাধ্যমে সেখানে পৌঁছানো সম্ভব।
এছাড়া অন্য কয়েকটি উৎস থেকেও আমরা জানতে পারি, সাম্রাজ্যের ইতিহাসের গোড়ার দিকে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী ও কূটনৈতিকের চীন থেকে বাংলায় যাওয়া-আসা ছিল। এছাড়া ফা-শিয়ান থেকে শুরু করে আরও অনেক চীনা বুদ্ধ সন্ন্যাসী গঙ্গার মুখে তাম্রলিপ্তি বন্দরে (আধুনিক তামলুক) ভ্রমণ করতে শুরু করেন। কিছু প্রাক-মিং লিপিতেও বাংলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী স্থান পেয়েছে, যদিও এ কথা বলা মুশকিল যে সেখানে বাংলা অঞ্চলকেই সঠিকভাবেই শনাক্ত করা হয়েছে কি না। হং-ইউ আমলে চীনের সঙ্গে বাংলার কোনো ধরনের কূটনীতিক বিনিময়ই ছিল না। তাই আমরা এ কথা নিঃসন্দেহে বলতেই পারি যে ইয়ংলের শাসনামল থেকেই দুই অঞ্চলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা হয়।
অ্যাডমিরাল ঝেং হের নৌ-অভিযান
রাজ নপুংসক ঝেং হের (১৩৭১-১৪৩৫) নেতৃত্বে পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিকে চীন প্রকাণ্ড সাতটি নৌ-অভিযান শুরু করে। ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সাল পর্যন্ত নিয়মিত বিরতিতে এসব অভিযান পরিচালিত হয়। প্রতিটি নৌ-অভিযানেই থাকত প্রায় আড়াইশোর মতো জাহাজের নৌ-বহর। নানজিং থেকে যাত্রা শুরু করে ইয়াংজি নদী হয়ে সেগুলো যেত তাই-কাংয়ে (বর্তমান সাংহাইয়ের নিকটে)। এরপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে মালাক্কা প্রণালীর মধ্য দিয়ে ভারত সাগরে পাড়ি জমাত তারা।
প্রথম দিকের কয়েকটি নৌ-অভিযানে কেবল ভারতের পশ্চিমের কালিকট বন্দর অবধিই যেতে সক্ষম হয় তারা। চতুর্থ নৌ-অভিযান থেকে সেগুলো আরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে থাকে, এমনকি আরব পেনিনসুলা হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলেও পৌঁছে যায়। প্রথম ছয়টি নৌ-অভিযান পরিচালিত হয় ইয়ংলের শাসনামলে।
কিন্তু ১৪২৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পর হং-শির শাসনামলে (১৪২৪-২৫) নৌ-অভিযানে একটা ছেদ পড়ে। এসব নৌ-অভিযান হলো অহেতুক সময় নষ্ট এবং এর কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঢাকা পড়ে যায়, এই যুক্তি দেখিয়ে তিনি অভিযান বন্ধ করে দেন।
সপ্তম ও সর্বশেষ নৌ-অভিযানটি পরিচালিত হয় শুয়ান-দের শাসনামলে (১৪২৫-৩৫), ১৪৩১ থেকে ১৪৩৩ সালের মধ্যে। প্রতিটি অভিযান চীন থেকে শুরু করে আবার চীনে ফিরে শেষ করতে বছর দুয়েক সময় লেগে যেত।
এই নৌ-অভিযানগুলোকে আমরা বলতে পারি 'ট্যাক্সি সার্ভিস'। কেন? কারণ এসব অভিযানের নৌ-বহরে চেপে চীনা নাবিক, সামরিক কর্মকর্তা, কূটনৈতিক, ডাক্তার ও অন্যান্য চাকুরি ও পেশাজীবীরা যেমন বিদেশ ভ্রমণে বের হতেন, তেমনই আবার সেসব বহরের মাধ্যমে বিদেশি অনেক দূতও চীনে হাজির হতেন সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপন ও বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে।
শি-লুর এন্ট্রিগুলোতে দেখা যায়, একেকটি নৌ-অভিযান চীনে এসে শেষ হওয়ার পরপরই সম্রাটের প্রতি অনেক বিদেশি দূতের শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপনের উল্লেখ রয়েছে। সেখান থেকে ধারণা করা যেতেই পারে, ওইসব দূতেরা চীনে আসতেন নৌ-অভিযানের বহরে করেই। এবং সম্ভবত, ওই দূতেরা চীনে অবস্থান করতেন চীন থেকে পরবর্তী নৌ-অভিযান যাত্রা শুরুর আগ পর্যন্ত।
অনেকেই বলে থাকেন, অ্যাডমিরাল ঝেং হে তাঁর নৌ-অভিযানের অংশ হিসেবে বাংলাতেও এসেছিলেন, এবং এমনও সম্ভাবনা রয়েছে যে তিনিই বাংলার জিরাফটি চীনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
দূতরা চীনে আসতেন নিজস্ব জাহাজেও
ঝেং হের নৌ-বহরের কল্যাণে অনেক বিদেশি দূত চীনে এলেও, চীনের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক সার্বিকভাবে শুধু এসব অভিযানের উপরই নির্ভরশীল ছিল না। কয়েকটি দেশ থেকে দূতেরা তাদের নিজস্ব জাহাজে করেও চীনে আসতেন। সেজন্যই, চীনা নৌ-অভিযান বন্ধ ছিল যে সময়টায়, তখনও বাইরের কিছু দেশ থেকে চীনে দূতদের আগমন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। এগুলো হলো সেইসব দেশ, যাদের সঙ্গে চীনের দূরত্ব খুব বেশি নয়, এবং যাদের সঙ্গে চীনের দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্যিক ও শ্রদ্ধাঞ্জলী সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল; যেমন আন্নাম, চম্পা, সিয়াম, জাভা, কোরিয়া, জাপান এবং রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ।
কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এসব দেশ বাদে দূরবর্তী আরও কিছু দেশ থেকেও নৌ-অভিযান শুরুর আগে থেকেই চীনে দূত প্রেরণের রীতি চালু ছিল। যেমন সেই ১৪০৩ সালে, অর্থাৎ প্রথম নৌ-অভিযানেরও বছর দুয়েক আগেই, কালিকট ও সুও-লি থেকে দূতেরা আসেন চীনে। ধারণা করা যেতে পারে, ১৪০২ সালে ইয়ংলের রাজ্যাভিষেকের কথা শুনে তারা চীন ভ্রমণ করেন। কেননা ইয়ংলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সে খবর অনেক দেশেই পাঠিয়েছিলেন।
বাংলার দূতদের চীনে আগমন
এখন, নির্দিষ্ট করে বাংলা থেকে কবে প্রথম রাজদূতরা চীনে পৌঁছান, সে ব্যাপারে অনেকেরই মতপার্থক্য রয়েছে। অধিকাংশ সূত্রই দাবি করে, চীনে প্রথম বাঙালি দূতদের পদচারণা ঘটে ১৪০৮ সালে। কিন্তু অন্য কিছু সূত্র থেকে আবার ১৪০৮ সালেরও আগে অন্তত দুবার চীনে বাঙালি দূতদের আগমনের কথা জানা যায়। তাদের মধ্যে প্রথমটি ছিল ১৪০৪ সালে। কোনো এক 'রাজা আই-ইয়া-সি-দিং' নাকি চীনে উপঢৌকন পাঠান। এই 'রাজা আই-ইয়া-সি-দিং' সম্ভবত ছিলেন তখন বাংলার শাসনে থাকা গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (শাসনকাল ১৩৮৯-১৪১০)। ১৪০৫ সালেও তিনিই চীনে দূত পাঠান বলে জানিয়েছে আরেকটি সূত্র।
তবে ১৪০৪ ও ১৪০৫ সালে বাঙালি দূতদের চীনে আগমনের কথা উল্লেখ নেই শি-লুতে। তাই নির্দিষ্ট করে তাদের আগমনের দিনক্ষণ বলা সম্ভব নয়। সত্যিই যদি তারা চীনে গিয়ে থাকেন, সেটি সম্ভবত ছিল নিজস্ব জাহাজে চেপে, কেননা ১৪০৭ সালের নবম মাসের আগে ঝেং হের নৌ-বহর চীনে ফেরেনি। তবে অন্য কোনো প্রধান বাণিজ্যিক দেশের জাহাজের সহায়তাও তারা নিয়ে থাকতে পারেন। যেমন ১৪০৫ সালের ৩ অক্টোবর মালাক্কা ও অন্যান্য দেশ থেকে একটি শ্রদ্ধাঞ্জলী যাত্রার বহর গিয়ে পৌঁছায় চীনে।
যেমনটি আগেই বলেছি, ১৪০৮ সালে চীনে বাঙালি দূতদের আগমনের কথা প্রায় সকল সূত্রেই উল্লেখ করা হয়েছে। শি-লুতে এ ব্যাপারে লেখা হয়েছে : 'বাংলার রাজা গিয়াসউদ্দিন দূত হিসেবে [চীনে] সাই-ই-মা-হা-মা ও অন্যান্যদের পাঠান। তারা উপহারস্বরূপ বিভিন্ন স্থানীয় পণ্য নিয়ে আসেন। পদক্রম অনুসারে তাদেরকে কাগজের টাকা দেওয়া হয়।' যদিও এই সময়ের মধ্যে নৌ-অভিযানগুলো শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু কোনোটিই ১৪০৮ সালে চীনে ফিরে আসেনি। তাই এ কথা বলাই যায় যে ওই বাঙালি দূতরা কেউই ঝেং হের নৌ-বহরে আসেননি।
পরের বছরের দ্বিতীয় মাসে (১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৪০৯) বাংলা থেকে আরেক দল দূতের আগমনের উল্লেখ রয়েছে শি-লুতে। এবারের দলটির আকৃতি বিস্ময়কর, কেননা তাতে সদস্য ছিল ২৩০ জনের বেশি। তাছাড়া অফিশিয়াল মিং ইতিহাসে বলা হয়েছে, ১৪০৯ সালের ওই মিশনের পর থেকেই ফি বছর নিয়ম করে বাংলার দূতরা আসতে থাকেন চীনে।
সুতরাং, ১৪১৪ সালে যদি আসলেই চীনা সম্রাটের কাছে 'কি-লিন' খ্যাত জিরাফটি পাঠানো হয় ১৪১৪ সালে বাংলা থেকে চীনে যাওয়া দূতদের মাধ্যমে, তাতে আর কোনো বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটে না। কেননা ততদিনে ইতোমধ্যেই চীনে বাঙালি দূতদের ভালো রকমের যাতায়াত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
জিরাফটি কি আসলেই সাইফউদ্দিনের পাঠানো?
এবার মুখোমুখি হওয়া যাক একটি চমকপ্রদ ব্যাপারের। এই লেখার শুরুর দিকেই নিশ্চয়ই আপনারা খেয়াল করেছেন, সাইফউদ্দিন হামজা শাহর শাসনকাল বলা হয়েছে ১৪১০ থেকে ১৪১২ পর্যন্ত। এদিকে ১৪১৪ সালে যখন চীনে জিরাফসহ অন্যান্য উপঢৌকন নিয়ে দূতরা পৌঁছান, তখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তাঁর ছেলে শিহাবউদ্দিন বায়েজীদ শাহ। তাহলে চীনা নথিতে কেন সাইফউদ্দিনকে তখনও 'রাজা' বলে অভিহিত করা হচ্ছে?
টাইম ট্র্যাভেলে চেপে যেহেতু পঞ্চদশ শতকে ফিরে যাওয়া সম্ভব না, তাই এই প্রশ্নের নিশ্চিত কোনো উত্তর আমরা পাব না। তারপরও কয়েকটি অনুমান করা যেতেই পারে।
যেমন ধরুন, যখন বাংলা থেকে ওই দূতরা জিরাফটিকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন, তখনও হয়তো সাইফউদ্দিনই ক্ষমতায় ছিলেন। পরে যে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে, তা ছিল তাদের অজানা। তবে এই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। চীনের উদ্দেশে রওনা দিয়ে দূতরা যদি পথিমধ্যে অন্য কোথাও দীর্ঘদিনের জন্য যাত্রাবিরতি না করেন, তাহলে বাংলা থেকে চীনে যেতে তো তাদের এত সময় লাগার কথা না!
এদিকে আরেকটি সম্ভাবনা হতে পারে, চীনা নথিতেই হয়তো ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। জিরাফটি আসলে পাঠিয়েছিলেন শিহাবউদ্দিন বায়েজীদ শাহ, কিন্তু তাঁকে চীনারা সাইফউদ্দিনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। তবে এই সম্ভাবনার একটি বড় ধরনের ক্ষতিকর দিক আছে। জিরাফটি সাইফউদ্দিন পাঠালেন নাকি শিহাবউদ্দিন পাঠালেন, তাতে খুব বেশি কিছু যায় আসে না। কিন্তু যদি শি-লুর মতো চীনা নথিতে ভুল তথ্য দেওয়া থাকে, তাহলে এর এতদিনকার বিশ্বাসযোগ্যতা বড় ধরনের ধাক্কা খায়।
তবে চলুন, জিরাফটি সাইফউদ্দিনই পাঠিয়েছিলেন, সেই বিশ্বাসে অটল থাকি। কেননা তাঁর চীনা সম্রাটের কাছে উপঢৌকন পাঠানোর বেশ কিছু জোরালো কারণ ছিল। প্রথমত, চীনা সম্রাট তাঁর বাবার মৃত্যুতে সমবেদনা জানিয়েছেন বলে তিনি হয়তো চীনা সম্রাটের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, চীন যে তাঁর ক্ষমতায় আসীন হওয়াকে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং তাঁর অন্যতম বড় সমর্থক ছিল, এজন্যও তাঁর কৃতজ্ঞ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তৃতীয়ত, তিনি হয়তো চাইতেন চীন তাঁর মিত্রশক্তিতে হয়ে থাকবে, এবং শত্রুদের আক্রমণ থেকে তাঁকে যেকোনো সময় রক্ষা করবে।
'কি-লিন' কেন?
যেই প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটিয়েছে গবেষক ও ইতিহাসবিদদের মনে তা হলো, জিরাফটিকে চীনা ভাষায় 'কি-লিন' নামে অভিহিত করা হয়েছে কেন?
'কি-লিন' নামটি বিস্ময়কর এজন্য যে, এটি দ্বারা চীনে সাধারণত ডাকা হয় এমন পৌরাণিক কোনো জন্তুকে, যা মূলত পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত 'ইউনিকর্ন'।
চীনা সংস্কৃতিতে 'কি-লিন'-এর রয়েছে স্বতন্ত্র তাৎপর্য। এটিকে ভাবা হয়ে থাকে যাবতীয় ভালোত্ব ও বদান্যতার প্রতীক হিসেবে। তাই এটির রয়েছে প্রধান কনফুসিয়ান গুণের সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা। এটির শরীর হরিণ সদৃশ, লেজ ষাঁড়ের ন্যায়, ঘোড়াসুলভ খুর, একটি শিং, মাছের মতো দাড়ি। কিংবদন্তী অনুযায়ী, ইয়েলো এমপেরর বা হুয়াংডি (কাল্পনিক শাসনকাল খ্রিস্টপূর্ব ২৬৯৮-২৫৯৮) একজন অতিগুণবান শাসক হওয়ায়, তাঁর শাসনামলে একটি 'কি-লিন'-এর আবির্ভাব ঘটেছিল।
কিন্তু চীনা নথিকররা কেন বাংলার জিরাফকে 'কি-লিন' নামে ডাকবেন? পৌরাণিক 'কি-লিন'-এর যে বিবরণ দেওয়া হয়েছিল, জিরাফের সঙ্গে তো তার কোনো ধরনের মিলও নেই।
এমন একটি সম্ভাবনা রয়েছে যে, 'কি-লিন' নামকরণটি হয়তো বাংলার দূতদেরই করা। হতেই পারে, চীনা দূতরা বাংলায় গিয়ে কথায় কথায় বলেছিলেন, চীনা সম্রাটকে মুগ্ধ করার ও তাঁর মন জয় করার জন্য যত ধরনের উপঢৌকন দেওয়া যেতে পারে, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হলো একটি 'কি-লিন'। তাই চীনা সম্রাটের মন জয়ের উদ্দেশ্যেই হয়তো বাংলার দূতরা একটি জিরাফকে 'কি-লিন' হিসেবে উপহার দিয়েছিলেন।
আবার আমরা যদি খানিক আগের কিংবদন্তীটা খেয়াল করি, তাহলে এ কথাও খুব একটা অবিশ্বাস্য হবে না যে, বাংলার জিরাফকে 'কি-লিন' নামটি দিয়েছেন স্বয়ং সম্রাট ইয়ংলে কিংবা তাঁরই অধীনস্থ কেউ। শাসক অতিগুণবান হলে যদি সাম্রাজ্যে 'কি-লিন'-এর আবির্ভাব ঘটে, তাহলে বাংলার জিরাফকে 'কি-লিন' নামে চালিয়ে দিয়ে সম্রাট ইয়ংলেকেও একজন অতিগুণবান শাসক হিসেবে প্রমাণ করা তো খুবই স্বাভাবিক, তাই না?
যদি জিরাফটি বাংলারই না হয়?
ইতিহাসবিদ স্যালি কে চার্চ তাঁর 'The Giraffe of Bengal: A Medieval Encounter in Ming China' শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে বাংলার জিরাফের চীনে গমন নিয়ে যে কালানুক্রম সাজিয়েছেন, তাতে এমন কোনো উল্লেখ নেই যে বাংলার জিরাফ বা 'কি-লিন' ঝেং হের নৌ-বহরে চেপে চীনে পৌঁছেছে। তিনি এমন অনুমানও করেছেন, ঝেং হে সম্ভবত কোনোদিন বাংলায় আসেনইনি।
কিন্তু তাঁর এই অনুমানের সঙ্গে বর্তমান সময়ে প্রচলিত অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত সাংঘর্ষিক। অ্যাডমিরাল ঝেং হো শুধু বাংলায়ই নয়, নির্দিষ্ট করে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এসেছেন বলেও উল্লেখ পাওয়া যায় অনেক জায়গায়। চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকেই তিনি জিরাফ তাঁর নৌ-বহরের মাধ্যমে নিয়ে গিয়েছিলেন চীনে, এমন দাবি অনেকের।
এদিকে সায়েন্স নিউজে সারাহ জিয়েলিনস্কি বলছেন একেবারেই ভিন্ন কথা, যার সঙ্গে আমাদের এতক্ষণের আলোচনার খুব কম মিলই আছে। তিনি বলছেন, অ্যাডমিরাল জেং হে বাংলায় এসেছিলেন বটে, এবং ১৪১৪ সালে তাঁর চতুর্থ নৌ-অভিযানের মাধ্যমেই জিরাফটিকে চীনে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু, জিরাফটি বাংলার ছিল না।
তাহলে জিরাফটি কাদের? এখানেই আসল মজা। জিয়েলিনস্কির মতে, বাংলা অঞ্চলে এসে ঝেং হের সাক্ষাৎ হয় মালিন্দির (বর্তমানে কেনিয়ার অংশ) দূতদের সঙ্গে। ওই দূতেরাই উপহারস্বরূপ বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন কয়েকটি জিরাফ, যার মধ্যে একটি তাঁরা চীনাদের দিয়ে দেন। এবং ওই জিরাফটিই পরবর্তীতে 'বাংলার জিরাফ' কিংবা 'কি-লিন' হিসেবে হাজির হয় সম্রাট ইয়ংলের নিষিদ্ধ বাগানে। পরের বছর মালিন্দি থেকে আরও একটি জিরাফ পাঠানো হয় চীনে। হয়তো এ কারণেই, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বাংলার জিরাফটিকে চিহ্নিত করেছে 'পূর্ব আফ্রিকার জিরাফ' হিসেবে।
শেষ কথা
চীনে বাংলার জিরাফের প্রসঙ্গটি এতটাই বিস্তৃত ও কুহেলিপূর্ণ যে, কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে এসে এই লেখা শেষ করা অসম্ভব। তবে এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা বাংলার সঙ্গে চীনের ইতিহাসের অনেকটা গভীরেই যে যেতে পারলাম, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। এবং এই এত ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের সম্মিলনও যে ঘটল নিছকই একটি জিরাফকে কেন্দ্র করে, সেটিও কি কম আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার!