মধ্যরাতে প্রিয়জনের ঠিকানায় সারপ্রাইজ উপহার পাঠিয়ে চমকে দিতে চাইলে!
ঘড়ির কাটায় তখন রাত বারোটা বেজে এক মিনিট, ওমনি দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই সাবিতা মেহরোজ দেখলেন একজন যুবক বড় ফুলের তোড়া, সাথে একটি কেক ও কিছু চকলেট সাজানো বাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই যুবককে চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলেন- তার দুবাই প্রবাসী স্বামী বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে এইসব গিফট পাঠিয়েছেন! একসঙ্গে থেকে বিশেষ দিনটি উদযাপন করতে পারছেন না, সে আক্ষেপের দূরত্বটা কমাতেই এমন সারপ্রাইজের আয়োজন।
চলছে ভালোবাসার মাস। কিন্তু অনেকেই তাদের প্রিয়জনের সাথে নেই। 'কাছে থেকে ভালোবাসতে হয়'- এমন তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে অনলাইন একটি পেজ হয়ে উঠেছে ভালোবাসা পৌঁছে দেওয়ার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। প্রিয়জন ও আপনজনদের ঠিকানায় জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী ও বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে উপহার পৌঁছে যাচ্ছে অর্ডারের মাত্র ২ ঘণ্টার মধ্যে। গ্রাহকদের উল্লেখিত সময়ে সে উপহার তুলে দেওয়া হয় তাদের প্রিয়জনদের হাতে।
'মিডনাইট সারপ্রাইজ' নামের ফেসবুক পেজটি দিন হোক বা মধ্যরাত- গিফট নিয়ে হাজির হয়ে যায় ঢাকা ও আশেপাশের জেলা, বিভাগীয় শহরগুলোতে। এক মুহূর্ত দেরি হলেই সারপ্রাইজের আবেদন কমে যেতে পারে। তাই তড়িঘড়ি করে যানজট ও সবরকম প্রতিবন্ধকতা ঠেলে ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া চাই ভালোবাসার টোকেনটি।
'মিডনাইট সারপ্রাইজের' স্বত্বাধিকারী সাদমান সাদ জানান, "অন্যান্য সময়ের তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের কাজের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। রোজ ডে থেকে ভ্যালেন্টাইনের মতো স্পেশাল দিনগুলোতে গ্রাহকদের ঠিকানায় উপহার নিয়ে ছুটতে গিয়ে অন্যকিছু করার সময় থাকে না। এই সময় আমরা গিফট প্যাকেজের উপহার যেমন চকলেট, চিপস, শাড়ি-পাঞ্জাবি ও বেলুনের বাকেটগুলো আগে থেকেই তৈরি করে রাখি-যাতে অর্ডারের সাথে সাথে ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হয়।"
"চাপ বেশি থাকলে কাস্টোমাইজ গিফটের অর্ডার নেওয়া হয় না। বছরের শেষ থেকে শুরুর সময় বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি বিয়ের মৌসুম চলে। তাই বিবাহ বার্ষিকী ও অন্যান্য উপহারের জন্য অর্ডারের পরিমাণ বছরের অন্য সময়ের থেকে বেশি আসে। বছরে পাওয়া ৩০০-৪০০ অর্ডারের বেশিরভাগই এই কয়েকমাসে এসে থাকে।"
"উপহার সামগ্রীর পেজ হলেও আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডেকোরেশনের কাজও করে থাকি। 'মিডনাইট সারপ্রাইজ' উপহারের সাথে ভালোবাসার আনন্দও পৌঁছে দেয়। প্রিয়জনের পাঠানো উপহারগুলো পাওয়ার পর সবাই খুব খুশি হয়। মাঝেমধ্যে কাস্টোমাররা অর্ডারের সময় উপহার গ্রহীতার কাছে নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করে। আমরা তখন নাম উহ্য রেখেই উপহার পৌঁছে দেই," বলছিলেন সাদমান।
ভালোবাসা প্রকাশে ভিন্নরকম উদ্যোগ
অনেকেই আছেন প্রিয়জনকে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলতে পারছেন না। কেউ আবার কাজের সূত্রে দূরে আছেন বলে ভালোবাসার মানুষের স্পেশাল দিনটি রঙিন করে তুলতে চাইলেও উপায় নেই।
সবকিছু যখন ঠিক সময়তে ঘটছে ও করা সম্ভব হচ্ছে, তখন ভালোবাসার ক্ষেত্রে কেন এইসব বাধা থাকবে? এমন সমস্যা ঘুচাতেই ২০১৯ সালে সাদমান সাদ নামের এক তরুণ নতুন এক উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করলেন। দিনের বেলা হাতের নাগালে সব কিছু পাওয়া গেলেও রাত ৯টার পর মার্কেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা মুশকিল হয়ে পড়ে। সে সময় যানবাহনও তেমন থাকে না। তাই চাইলেও উপহার, কেক, ফুল ও অন্যান্য জিনিস একসাথে পাওয়া যায় না।
তার উদ্যোগের মূল বিষয়টি ছিলো দিনের প্রথম প্রহরে, অর্থাৎ রাত যতো গভীরই হোক না কেন গ্রাহকের ঠিকানায় গিফট ও আনন্দ পৌঁছে দিয়ে, তাদের বিশেষ দিনকে আরও আনন্দময় ও স্মরণীয় করে রাখা। তার এই কাজের সাথে মিল রেখে ফেসবুক পেজটির নাম রাখলেন 'মিডনাইট সারপ্রাইজ' যার অর্থ (মধ্যরাতের উপহার)। পেজটিতে বর্তমানে ৮০ হাজার মানুষ লাইক দিয়েছেন।
উদ্যোক্তা হিসেবে কেন এমন ভিন্নধর্মী পথে হাঁটলেন তা জানাচ্ছিলেন সাদমান সাদ। "যে সময় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো, তখন অনলাইনে অনেক ব্যবসায়িক পেজ থাকলেও- শুধু গিফট নিয়ে কাজ করছে এমন একটিও ছিলো না। এমন আইডিয়া অবশ্য আমার মাথায় এসেছিলো তামিল একটি সিনেমা থেকে। ঐ সিনেমায় মধ্যরাতে এভাবে গিফট পৌঁছে দিতে দেখা যায়। তখন আমার মনে হয় আমিও এমন কিছু শুরু করলে কেমন হবে?"
"বর্তমানে গিফটের এমন বেশ কয়েকটি পেজ ও ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমি যখন শুরু করেছিলাম তখন এমন গিফট পেজ নিয়ে কেউ কাজ শুরু করেনি। সে হিসেবে আমিই প্রথম বলা চলে। করোনার আগে মানুষ খুব বেশি অনলাইন নির্ভর ছিলো না। তাই শুরুর দিকে আমার কাজে তেমন একটা সাড়া মিলেনি।"
দেশের থেকেও দেশের বাইরে বাস করা প্রবাসীদের থেকে বেশি অর্ডার আসে বলে জানান সাদমান। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা থেকে বেশিরভাগ বাঙালি প্রবাসী দেশে গিফট পাঠাতে অনলাইনে যোগাযোগ করেন। পরিবার ও আপনজনদের কাছে না থেকেও তাদের কে খুশি করতে ভুলেন না এই স্বজনেরা। তাইতো দূর দেশে থেকেও প্রিয়জনদের মনের মতো গিফট পাঠাতে নানারকম পরিকল্পনা ছক করেন। কেবল স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা নয়-পেজের মাধ্যমে অনেকে তাদের বাবা-মা, ভাইবোন, অফিসের বস ও সহকর্মীদের জন্য গিফট পাঠিয়ে থাকেন।
গ্রাহকদের চাহিদা ও প্রয়োজন মতো 'মিডনাইট সারপ্রাইজ' কাস্টোমাইজ করা উপহার নিয়ে হাজির হয়ে যায় নির্দিষ্ট ঠিকানায়। তবে কাস্টোমাইজশনের ক্ষেত্রে ২ দিন সময় হাতে নিয়ে অর্ডার দিতে হয়। নষ্ট হয়ে যাবে না এমন কিছু উপহার আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা হয়।
ঢাকার কাঁটাবন মার্কেটের একটি দোকানে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্মিলিতভাবে উপহার প্রস্তুতের কাজ চলে 'মিডনাইট সারপ্রাইজের'। নির্দিষ্ট কোনো পণ্য বিক্রি না করে অনলাইন এই পেজটি এক ধরনের সেবা বিক্রি করে যাচ্ছে। তাই কোনো কিছু স্টকে না রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কেকের দোকান থেকে কেক নেওয়া, ফুল বিক্রেতাদের নিকট হতে ফুল, বিভিন্ন রকমের চকলেট, বেলুন ইত্যাদি প্রয়োজন মতো যখন যা দরকার তা নিয়ে আসা হয়। তাই রাত গভীর হলেও তারা ঠিক সবকিছু জোগাড় করে পৌঁছে দিতে পারেন।
ভালোবাসা পৌঁছে যাবে পরম যত্নে
'মিডনাইট সারপ্রাইজ' পেজটিতে ঢুকলেই একেকটি গিফট বাকেটের ছবিসহ দাম ও অন্যান্য বৃত্তান্ত দেখা যায়। এখান থেকে গ্রাহকরা সহজেই নিজেদের বাজেটের সাথে মিলিয়ে উপহার অর্ডার করতে পারেন। কেউ শুধু কেক বা ফুল অর্ডার করতে চান। সেক্ষেত্রে যাতায়াত বাবদ খরচ ও পণ্যের দাম রাখা হয়।
এই পেজের উপহার বাকেটের দাম সর্বনিম্ন ১৫০০ থেকে শুরু হয়। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সাধ্যের বাইরে হওয়ায় তাদের বেশিরভাগ কাস্টোমারের সংখ্যা ২৪ বয়সোর্ধ্ব। প্রতিটি উপহার পৌঁছে দিতে ঢাকার মধ্যে সার্ভিস চার্জ রাখা হয় ৫০০-৮০০ টাকা। ঢাকার বাইরে হলে দূরত্ব অনুযায়ী এই চার্জ বাড়তে থাকে।
'মিডনাইট সারপ্রাইজ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্ডারকৃত উপহারের মধ্যে চকলেট, কেক, পার্টি বেলুন, চিপস বক্স, মিষ্টি ও শাড়ির চাহিদা বেশি থাকে। কয়েকজন নিজেদের ছবি দিয়ে পছন্দমতো ছবির ফ্রেম তৈরি করে দিতে বলেন। এমনকি কাস্টোমারদের কথা মতো রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনে তা উপহার সমেত পৌঁছে দেওয়া হয়। এভাবে ভিন্ন ক্যাটাগরির উপহারের জন্যে নির্ধারণ করা হয় ভিন্নভিন্ন চার্জ। গ্রাহকদের কথামতো উপহারের সাথে চিরকুট ও কার্ডও দেওয়া হয়ে থাকে। কেকের ওপর লেখা হয় বিশেষ দিন ও উপহার গ্রহীতার নাম।
দাম ও সেবার মান নিয়ে সাদমান সাদ বলেন, "প্রতিটি উপহারের তোড়া অতি সতর্কতার সাথে গন্তব্যে পাঠাতে হয়। বেশিরভাগ উপহারের সাথে কেক, ফুল বা চকলেটের তৈরি বাকেট থাকে। যদি যাত্রাপথে এগুলো নষ্ট হয়ে যায় তখন আসলে সারপ্রাইজের মজা থাকে না। বেলুন বাকেটের মতো কিছু বাকেটের সাইজ বড় হওয়ায়-আমরা চাইলেই সেগুলো কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে পারি না। এমনকি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে এগুলো নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই আলাদাভাবে সিএনজি বা অন্য গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যেতে হয়। তাই সার্ভিস চার্জবাবদ খরচাটা কুরিয়ারের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে।"
"একবার আমি নিজে নওগাঁ গিয়ে উপহার পাঠিয়ে এসেছি। সেখানে যাতায়াত বাবদ যা খরচ হয়েছে তা দিতে গ্রাহক রাজি ছিলেন বিধায় আমি দায়িত্ব নিয়ে তার উপহার পৌঁছে দেই। আমাদের মাধ্যমে উপহার হিসেবে যে জিনিসগুলো পাঠানো হয়, তার সবকিছুই ভালো মানের। কুপার্সের কেক, ভালো মানের চকলেট দিয়ে আমরা গিফট প্যাকেজ সাজিয়ে থাকি। ভালো মান ও ঠিকঠাক মতো পার্সেল পৌঁছে দেওয়ার ঝক্কির কাছে সে তুলনায় চার্জ তেমন বেশি না। অনেক গিফট ওয়েবসাইট আছে যারা অনেক বেশি অর্থ নেয়। আমরা কেবল পণ্য আর সেবার মান অনুযায়ী দাম রাখছি।"
৩ বছরে 'মিডনাইট সারপ্রাইজ' প্রায় ৮০০ এর ওপর অর্ডার ডেলিভারি দিয়েছে। এই পেজের উদ্যোক্তা সাদমানের ইচ্ছে ভবিষ্যতে তিনি চীন থেকে আকর্ষণীয় অনেক উপহার আমদানি করে নিয়ে আসবেন। বাংলাদেশে অনেক উপহার সুলভমূল্যে পাওয়া যায় না। তাই তিনি আমাদানিকৃত উপহার সামগ্রী নিজ পেজে বিক্রির পাশাপাশি স্থানীয় মার্কেটে বিক্রি করতে চান।
কীভাবে এই পেজ কে দাঁড় করানো যায় এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন ভিন্নধর্মী কিছু উপহার আইডিয়া আনা যায়-তা খোঁজ করতে তিনি নিত্য নৈমিত্তিক বিদেশী গিফট পেজ ও পিনটারেস্ট সাইট ঘাঁটাঘাঁটি করেন। ভবিষ্যতে আরও বেশি অর্ডার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নিয়মিত তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এই লক্ষ্যে তিনি বলেন, "পথ তৈরি করাও এক কঠিন পথ। আর আমি সে পথে এখনো হেঁটে চলেছি।"