শিমি এমন এক প্রযুক্তি যা মানুষের হেরে যাওয়া ঠেকাতে লড়ছে
মেশিনের সঙ্গে মানুষকে লড়তে হবে, কল্পকাহিনীগুলোর এ ভবিষদ্বানী যে এত শিগগিরই ফলতে শুরু করবে তা বুঝতে কিছু বাকীই ছিল বুঝি। তবে মানুষও প্রস্তুত হচ্ছে যেন মেশিন চূড়ান্ত পর্যায়ে জিতে না যেতে পারে। মানে ফন্দিটা হচ্ছে, কিছু কাজ মানুষ মেশিনকে দিয়ে করিয়ে নেবে ঠিকই তবে নাটাইয়ের সুতোটা রাখবে নিজের হাতেই। তার প্রস্তুতিও চলছে দিকে দিকে।
বাংলাদেশ দেশটা ঠিক কোনদিকে তা ঠাহর করতে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক লোকই হঠাৎ করে গুলিয়ে ফেলে। তবে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' কথাটার সঙ্গে বেশ চেনাজানা হয়ে গেছে ওই মানুষগুলোর। তাদের গায়ের পোশাকআশাকগুলোয় এ কথাটা পরিস্কার করেই লেখা থাকে। তাই তারা জানে বাংলাদেশ নামের দেশটা পোশাক তৈরি করতে পারে ভালো।
তবে ২০১৩ সালে ঘটে যাওয়া রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় পুরো বিশ্ব আঁৎকে ওঠে। যাদের তৈরি পোশাক পরে সৈকতে বাতাস খাই, পার্টিতে নাচি সেই মানুষগুলোর জানের নিরাপত্তা এতো কম? চমকে উঠেছিলেন,আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার সারাহ ক্রাসলেও।
তখন তিনি একনাগাড়ে বাংলাদেশে ছিলেন বেশ কিছুদিন। গার্মেন্টকর্মীদের সঙ্গে আপনজন হয়ে মিশেছেন, বোঝার চেষ্টা করেছেন তাদের কষ্ট। খুঁজতে চেয়েছেন কষ্ট নিবারণের উপায়। একইসঙ্গে তাঁর মনে পড়েছে নিজের পিতামহের কথা। জীবনধারণের তাগিদে যিনি একটি স্টিল মিলে কাজ করতেন এবং সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরতেন কালিঝুলিতে মাখামাখি হয়ে- তখন তাকে আর চেনা যেত না। সারাহ তাই খনি বা কারখানার মতো কাজের জায়গাগুলোয় মেশিনের ব্যবহারকে স্বাগতই জানান; তবে তা যেন মানুষকে কর্মহীন না করতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। তাই তিনি যখন এমআইটিতে পড়াশোনা করেছেন তখনো ভেবেছেন মেশিন মানুষের কষ্ট কমাবে মানুষের নিয়ন্ত্রণে থেকেই। তাঁর চিন্তার ফসল হিসাবেই পাওয়া গেল শিমি টেকনোলজি।
গার্মেন্ট কর্মীদের কাজ সহজ করতে
এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রয়োগ করে তৈরি হয়েছে সাড়ে চার ঘণ্টার শিমি গেইমিং অ্যাপ । মূলত গার্মেন্ট শিল্পের কর্মীদের কাজ সহজ করতেই এটি তৈরি করা হয়েছে। আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া আর বাংলাদেশে কাজ করে শিমি। বিভিন্ন দেশের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠায় শিমিকে বলা যায় একটি বহুজাতিক দল। সারাহ ক্রাসলে দলটির নেতৃত্ব দেন। নিউইয়র্কে এর হেডকোয়ার্টার। বাংলাদেশ টিমে রুদ্র রহমান প্রশিক্ষণ ও ফিল্ড অপারেশনসের প্রধান হিসাবে কাজ করছেন।
বাংলাদেশ কাজের একটি বড় ক্ষেত্র হওয়ায় এখানে দলটিও তুলনামূলক বড়। এখানে সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষক আছেন ৮ জন। এদের মধ্যে ছায়েরা খাতুন, রুমা আক্তার, মাক্তুবা হোসেব প্রমুখ ছিলেন গার্মেন্টকর্মী বা সুপারভাইজার। কম্পিউটারের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে।
স্মৃতির পাতা উল্টে রুদ্র রহমান বলছিলেন, 'তাদের হাতে যখন ট্যাবলেট তুলে দেওয়া হলো তারা যেন ভয় পেল, ক্রমে যন্ত্রটির সঙ্গে তাদের সখ্যতা তৈরি হলো এবং অন্যদের সঙ্গেও নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে থাকল। প্রধান কারণ অ্যাপটি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল। এটি ব্যবহারকারীকে আকৃষ্ট করে। ব্যবহারকারীরা এটি খেলতে খেলতে শেখে, এখানে তাদেরকে একটি লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। এ লক্ষ্যে পৌঁছানো গার্মেন্টকর্মীর জন্য জরুরী; কারণ এতে তার জীবিকা নির্ভর করে। একজন গার্মেন্টকর্মীকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে 'কাট টু ফিট' পর্যন্ত যতগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয় তার সবগুলোই সাড়ে ৪ ঘণ্টার শিমী নামের অ্যাপটিতে যুক্ত আছে।'
শিমির ট্যাবগুলো মাইক্রোসফটের কাছ থেকে পাওয়া। দিনে দিনে শিমির যাত্রাপথ প্রশস্ত হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর শিমি অনেকগুলো পুরস্কার জিতেছে। তার অন্যতম হলো মোস্ট পটেনশিয়াল টু স্কেল (অকুমেন), আরএসএ ফিউচার টু ওয়ার্ক অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি। টমি হিলফিগারের সোশ্যাল ইনোভেশন চ্যালেঞ্জের ফাইনালিস্টও হয়েছিল।
১,০০০ এর মাইলফলক
এবার শিমির সময়ক্রম জেনে নেওয়া যাক। ২০১৬ সালে এর প্রতিষ্ঠা গার্মেন্ট শিল্পে ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ কাজের পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে। নিউ ইয়র্ক ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কফোর্স ইনস্টিটিউট শিমি আপস্কিলের জন্য প্রথম তহবিল দেয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। আঠারো সালের মে মাসে প্রথম আপস্কিল ট্রায়াল হয় নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে। একই বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি আপস্কিল পাইলট প্রকল্প শুরু হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এমআইটি সলভ ওয়ার্কফোর্সে (বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় যারা উদ্ভাবনী ভূমিকা রাখে)অন্তর্ভুক্ত হয়। পরের বছরের ডিসেম্বর মাসে সুইজারল্যান্ডের লডস ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে অনুদান লাভ করে। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে শিমি বাংলাদেশের ৩০টি কারখানায় অটোমেশন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ শুরু করে। ২০২১ এর সেপ্টেম্বর মাসে ৬৫০ জন নারী গার্মেন্ট কর্মীকে আপস্কিল ট্রেনিংয়ে যুক্ত করে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে শিমি ১,০০০ জনকে প্রশিক্ষিত করার মাইলফলক স্পর্শ করে।
রুদ্র যুক্ত করলেন, 'শিমি অডিও, ভিডিও এবং টাচ প্রযুক্তির সমন্বয়ে কাজ করে। অনভ্যস্ততার প্রথম সংকোচ কাটিয়ে উঠলে পরে এতে দ্রুতই সংযুক্ত হয় প্রশিক্ষণার্থী। আমরা গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষকে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বোঝাই এবং এটা বিনামূল্যে পাওয়া যাওয়ার কথাও উল্লেখ করি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক সমর্থন পাওয়া যায়। আমাদের দেশের কর্মীরা কিন্তু পরম্পরাসূত্রে প্রশিক্ষিত। এর একটা বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। ওস্তাদ থেকে শিষ্য, সেই শিষ্য ওস্তাদ হয়ে ওঠার পর আবার নতুন শিষ্যদল; আর এ ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে, ব্যাপারটি অবাক করার মতো কারণ এটা অভিজ্ঞতা দিয়ে চলে এবং বিজ্ঞানের মতোই ফল দেয়। এক্ষেত্রে শিমি সাড়ে চার ঘণ্টায় কাটিং থেকে ফিটিং পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটিকে গাণিতিক হিসাবনিকাশের মধ্যে নিয়ে এসেছে। মেশিন এই চ্যালেঞ্জটাই ছুড়ে দিচ্ছে কর্মীর প্রতি- স্লিভ, পকেট, ওয়েস্ট, চেস্ট ইত্যাদি সব কিছুই আপ-ডাউন ঠিক রেখে উপযুক্ত অনুপাতে পোশাক তৈরি করতে পারো কি-না যেমনটা আমি পারি।
এক্ষেত্রে শিমি চাইছে, যন্ত্রের সব সুবিধা নিয়েও কর্মীই যেন নিয়ন্ত্রণকারী হয়। যন্ত্রের কাছে যেন হেরে না যায় মানুষ। তাই কর্মীকে এগিয়ে রাখছে শিমি; আর মেথডটা হলো রি-স্কিলিং এবং আপ-স্কিলিং। শিমি শুধু কাপড় তৈরি করার উপায়ই জানাবে না, বরং যন্ত্রটিকে কীভাবে সচল রাখতে হয় ও সংযুক্ত করতে হয়- তাও শেখাবে।'
শিমির সঙ্গীদল
শিমির সঙ্গে এমআইটি, মাইক্রোসফট, টাইডস, এশিয়া ফাউন্ডেশন, ক্যাটারপিলার ফাউন্ডেশন, এইচএন্ডএম, আন্ডার আর্মারের মতো প্রতিষ্ঠান যুক্ত আছে। ওয়ার্কার কলোনিগুলোতে গিয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে থাকে শিমি।
অটোমেশন পালস রিসার্চ (প্রযুক্তির বিকাশ) সব সময় চালু রাখে শিমি। কারণ আধুনিকায়ন হবেই। সবক্ষেত্রে হয়তো সমান গতিতে হবে না, তবে হবেই। সোয়েটার তৈরি করে যেসব প্রতিষ্ঠান তারা ইতিমধ্যেই জ্যাকার্ড মেশিন বসিয়েছে। আর নতুন হওয়ায় তা পরিচালনা কিছুটা কঠিন, পুরুষরাই এর সিংহভাগ পরিচালনা করে থাকে।
রুদ্র জানিয়েছেন, তাঁরা অল্প জায়গাতেই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। যারা টাচ মোবাইল ব্যবহার করে- তারা শিমি প্রযুক্তি দ্র্রুতই আয়ত্ত করতে পারে। প্রশিক্ষক দল প্রথমে কোনো কারখানায় গিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের নির্দিষ্ট কোনো স্থানে জড়ো করে, তারপর কিছু ইনফরমাল আলাপচারিতার মাধ্যমে তাদের মূল্যায়ন করা হয়, কোথায় কোথায় ফাঁক আছে তা চিহ্নিত করা হয় তারপরই ট্রেনিং ডে নির্ধারণ করা হয়। টিকটকও শিমির একটি লার্নিং প্লাটফর্ম কারণ গার্মেন্টকর্মীদের মধ্যে টিকটক বিশেষ জনপ্রিয়। এবছরের ২১ মার্চ পর্যন্ত শিমি ২,৫০০ জনকে প্রশিক্ষিত করেছে যার ৭০ ভাগ নারী। আশা করা হচ্ছে এবছর শেষ হতে হতে ৮,০০০ জন প্রশিক্ষিত হবেন।
নারী দিবসের অর্জন
গত ৮ মার্চ নারী দিবসে শিমির টেকনোলজি পার্টনার মাইক্রোসফট প্রশিক্ষক রুমাকে নিয়ে একটি অ্যানিমেশন ছবি প্রকাশ করে- যাতে রুমার স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ, সিঙ্গেল মাদার হিসাবে সন্তানকে নিয়ে সংগ্রাম, গার্মেন্টে চাকরি নেওয়া, কারখানায় নারীদের উপযুক্ত পদে নিয়োগ না দেওয়া ইত্যাদি তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে নতুন প্রযুক্তি এলে তাতে ভীত হওয়া এবং ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা এবং আরো কিছুকাল পরে প্রশিক্ষক হয়ে ওঠার কথাও এসেছে চলচ্চিত্রটিতে। শেষে বলা হয়, এখন আর হেরে যাওয়া বা চাকরি হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে ভীত করে না বরং সকলে মিলে আত্মনির্ভরশীল যে সমাজ গড়ে তুলছে তারা তাতে আনন্দ পাচ্ছে, সুখ অনুভব করছে। এপর্যন্ত ২০০ জনকে প্রশিক্ষিত করেছেন রুমা। তাই গেল নারী দিবসে তাকে সম্মান জানিয়েছে মাইক্রোসফট।