কনস্টান্টিনোপল: অর্ধশতক ধরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এক ‘জলদানব’, তটস্থ থাকতেন নাবিকেরা
বাইজেন্টাইন শাসনের সময় কনস্টান্টিনোপলের বাসিন্দারা বিভিন্ন হুমকিকে সঙ্গে করেই জীবনযাপন করেছিলেন। আভর, সাসানিড, স্লাভ, ক্রুসেডার, অটোমানরা বারবার পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানীতে হামলা চালিয়েছিল। তবে মানব হুমকির বাইরে গায়ের রক্ত হিম করে দেওয়া আরেকটি আতঙ্কের উৎস ছিল বসফরাস প্রণালী।
ওই প্রণালীর পানিতে ঘুরে বেড়াত ভয়ংকর এক 'জলদানব'। পরফিরিওস নামক বিশালাকৃতির একটি তিমির নিয়মিত হানার শিকার হতেন জলপথে কনস্টান্টিনোপলে আসা বা শহর থেকে বাইরে যাওয়া জাহাজের নাবিকেরা।
ষষ্ঠ শতকে প্রায় ৫০ বছর ধরে কনস্টান্টিনোপলের আশপাশের জলরাশিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এ তিমি। প্রাণীটি প্রায়ই জাহাজ বা নৌকার ওপর আক্রমণ চালাত, এমনকি এসব নৌযান ডুবিয়ে দেওয়ারও অসংখ্য ঘটনার কথা জানা গেছে।
ষষ্ঠ শতকের বাইজেন্টাইন ইতিহাসবিদ প্রকোপিয়াসের লেখা থেকেই পরফিরিওসের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জানা গেছে। নিজের হিস্টোরি অভ দ্য ওয়ার্স ও দ্য সিক্রেট হিস্টোরি গ্রন্থে তিমিটির কথা বর্ণনা করে গেছেন তিনি।
৫০ বছর ধরে নাবিকদের তটস্থ করে রেখেছিল এ তিমি। মাঝেমধ্যে দীর্ঘসময়ের জন্য উধাও হয়ে যেত এটি। মানুষ ভাবত অবশেষে বুঝি এ জলদানব থেকে মুক্তি পাওয় গেল। কিন্তু তারপর একদিন হুট করেই কোনো জলযান আক্রমণ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিত এটি।
প্রকোপিয়াসের লেখা থেকে জানা যায়, আক্রমণের ক্ষেত্রে কোনো বাছবিছার করত না তিমিটি। সমুদ্রগামী জাহাজ, ছোট মাছ ধরার নৌকা, বাণিজ্যপোত, বা যুদ্ধজাহাজ — কিছুই রেহাই পায়নি পরফিরিওসের তাণ্ডব থেকে। সমুদ্রের যেসব অংশে তিমিটির হামলার কথা জানা যেত, সেগুলো এড়িয়ে চলতেন নাবিকেরা।
ইতিহাসবিদ সিয়ান লুইস ও লয়েড লেলিন-জোন্সের মতে, ওই সময়ে তিমি সম্পর্কে বেশি কিছু জানত না মানুষ। তাই কনস্টান্টিনোপলের বাসিন্দারা খুব সম্ভবত পরফিরিওসকে কোনো জলদানব ভেবেছিলেন।
কিন্তু ঠিক কী প্রজাতির তিমি ছিল পরফিরিওস তা নির্ণয় করা বেশ কঠিন। প্রকোপিয়াসের লেখা অনুযায়ী, তিমিটি ১৩.৭ (৪৫ ফুট) মিটার লম্বা, ও ৪.৬ মিটার (১৫ ফুট) চওড়া ছিল।
দেহের আকার, দীর্ঘ আয়ু, ও আচরণের কারণে কেউ কেউ মনে করেন, পরফিরিওস সম্ভবত স্পার্ম হোয়েল জাতের তিমি ছিল। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন, হতে পারে পরফিরিওস ছিল অবিশ্বাস্যরকম বড় কোনো অরকা। কারণ পরফিরিওস সমুদ্রের যে অংশে অবস্থান করেছিল, সাধারণত তিমি এ ধরনের অংশে বাস করে না।
পরফিরিওসের নামের উৎপত্তি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, তিমিটির নামকরণ করা হয়েছে সমসাময়িক সারথি পরফিরিয়াস অথবা মিথোলজির দানব পরফিরিওনের নামে। আবার আরেকটি ধারণা অনুযায়ী, তৎকালীন রোমান সাম্রাজ্যের শৌর্য বোঝাতে এ নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
তবে ১৯৯৬ সালে কানাডিয়ান ইতিহাসবিদ জেমস অ্যালান স্টুয়ার্ট ইভান্স দাবি করেন, পরফিরিওসের নামটি তৈরি হয়েছে এর দেহের রং অনুসারে। তার মতে, পরফিরিওস নাম দিয়ে নিছক এর আক্ষরিক অর্থ — অর্থাৎ বেগুনি রংয় বোঝানো হয়েছে।
সে যা-ই হোক, পরফিরিওসের হামলা এতটাই বড় সমস্যা হয়ে উঠেছিল যে খোদ সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান তিমিটির একটি ব্যবস্থা করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু পানির তলায় এ বিশাল প্রাণীটিকে কীভাবে ধরা হবে, সে নিয়ে তখন কেউই কোনো উপায় বের করতে পারেনি।
শেষতক সমস্যার সমাধান হয়ে যায় নিজে থেকেই। একদল ডলফিনকে তাড়া করতে গিয়ে কৃষ্ণ সাগরের মুখে তটে উঠে যায় পরফিরিওস। অনেক চেষ্টাচরিত্র করেছিল ডাঙা ছেড়ে সমুদ্রে নামার জন্য, কিন্তু তা-তে নরম কাদার মধ্যে আরও বেশি আটকে যায় তিমিটি।
চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ার পর স্থানীয় মানুষেরা কুঠার নিয়ে পরফিরিওসকে হত্যা করতে ছোটেন। কিন্তু তিমিটির গায়ের চামড়া এতই শক্ত ছিল যে কোনো অস্ত্রই এর গায়ে ভালোমতো দাঁত বসাতে পারেনি।
এরপর বাইজেন্টাইনের বাসিন্দারা দড়ি আর ওয়াগন দিয়ে তিমিটিকে টেনে সমুদ্র থেকে আরও দূরে সরিয়ে এনে দ্বিতীয়বার হত্যার উদ্যোগ নেন। এবারের চেষ্টায় তারা সফল হন। মানুষজনের মাঝে তিমির মাংস বিলিয়ে দেওয়া হয় উদযাপনের অংশ হিসেবে।
প্রকোপিয়াস লিখেছিলেন, তিমিটির মৃত্যুর পরে স্থানীয়রা অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যে তিমিটি মারা পড়েছিল, সেটি পরফিরিওস ছিল না। তাই অনেকে ধারণা করেন, কুখ্যাত পরফিরিওস সেদিন মারা যায়নি, সমুদ্রের গভীরেই বহাল তবিয়তে টিকে ছিল।