সাগরে বিধ্বস্ত সর্বাধুনিক এম-৩৫ যুদ্ধবিমান উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিযোগিতা
পারমাণবিক বোমা নস্যি, তার চেয়েও অনেকগুণ বেশি অর্থ যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে তাদের সর্বাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান তৈরিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশটি প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করে। এই প্রকল্পের নাম ছিল ম্যানহাটন প্রজেক্ট। আর তাতে সেকালে ব্যয় হয়েছিল অন্তত ২০০ কোটি ডলার। সে তুলনায়, এফ-৩৫ বিমান তৈরিতে খরচ হয়েছে এক লাখ কোটি ডলারের বেশি। সর্বাধুনিক এই বিমানের অনেক প্রযুক্তি কল্পবিজ্ঞানকেও হার মানায়। অথচ দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক মহড়ার কালে কিনা তেমন একটি বিমান হারালো মার্কিন নৌবাহিনী!
বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে আবার শত্রুর দোড়গোঁড়ায়। কারণ দক্ষিণ চীন সাগরের পুরো এলাকা নিজেদের বলে দাবি করে গণচীন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই এলাকায় নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠায় আরও সচেষ্ট বেইজিং। ২০১৬ সালে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল এমন দাবির কোনো আইনি ভিত্তি নেই বলে রায় দিলেও তা মানতে নারাজ এশীয় পরাশক্তিটি।
চীনের হাতে যদি এফ-৩৫ প্রযুক্তি যায় তাহলে মার্কিনীদের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রযুক্তি প্রায় মুফতে পেয়ে যাবে বেইজিং। বলাই বাহুল্য, সেজন্যই সাগরে ডুবে যাওয়া বিমানটি উদ্ধারে তারা চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখবে না।
তাই চীনের আগে বিধ্বস্ত এফ-৩৫ সি বিমানটি উদ্ধারে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে মার্কিন নৌবাহিনী।
নৌবাহিনী জানিয়েছে, বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস কার্ল ভিনসনে অবতরণের সময় ১০ কোটি ডলার দামের ফাইটার জেটটি সাগরে বিধ্বস্ত হয়। সময়মতো ইজেক্ট করে প্রাণে বেঁচে যান বিমানের পাইলট। তবে দুর্ঘটনায় তিনিসহ কার্ল ভিনসনের আরও ৭ নাবিক আহত হয়েছেন।
পেন্টাগনের জন্য সবচেয়ে উৎকণ্ঠার বিষয় দুর্ঘটনার স্থান। বিমানটি ডুবেছে আন্তর্জাতিক জলসীমায়। তাই সাগরের তলদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র বা চীন- যেই উদ্ধার করুক; লড়াকু জেটটির মালিকানা তারই হবে।
বিমানটি সাগরতলে পড়ে রয়েছে একথা জানালেও সঙ্গত কারণেই দুর্ঘটনাস্থল গোপন রেখেছে মার্কিন নৌবাহিনী। উদ্ধার করতে কতদিন লাগবে সেব্যাপারেও মুখে কুলূপ এঁটেছেন পদস্থ কর্মকর্তারা।
তারপরও চীনই যদি আগে উদ্ধার করতে পারে তাহলে বহুজাতিক সহযোগিতার ফসল অতি-উন্নত প্রযুক্তির জ্ঞান পাবে তারা। পরবর্তীকালে যা চীনকে আরও অত্যাধুনিক বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। এই একটি বিমান হাতছাড়া হলে তাই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিনীদের আধিপত্য বহুগুণ কমবে।
(ছবি)
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা সামরিক বাহিনী যেকোনো উপায়ে জেটটি পেতে চাইবে। অন্যদিকে, উদ্ধারকারী (স্যালভেজ) মার্কিন জাহাজ ঘটনাস্থল থেকে অন্তত ১০ দিনের দূরত্বে রয়েছে।
এনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিরক্ষা পরামর্শক অ্যাবি অস্টেন জানান, ১০ দিনের আগেই বিমানের ব্ল্যাকবক্সের ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যাবে, তখন এটি খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
"যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিমানটি খুঁজে পাওয়া চরম গুরুত্বপূর্ণ। এফ-৩৫ আসলে একটি উড়ন্ত কম্পিউটার, যা অন্যান্য সামরিক যান ও অবকাঠামোর সাথে সুরক্ষিত ডেটা লিঙ্কের মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রেখে চলে।"
সত্যিই ডেটা ফিউশনের এক অনন্য উদাহরণ এই বিমান।
অস্টেনের মতে, চীনের কাছে যেহেতু এই প্রযুক্তি নেই, তাই ডুবে যাওয়া বিমানটি পেলে তারা একধাপে অনেকখানি এগিয়ে যাবে।
"তারা যদি এফ-৩৫ এর নেটওয়ার্ক সক্ষমতা আয়ত্ত করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরীগুলোর নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।"
এই ঘটনায় স্নায়ুযুদ্ধের ইঙ্গিত পাচ্ছেন কিনা বিবিসির পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন রাখা হলে তিনি বলেন: "এক্ষেত্রে ওই এলাকায় কার শক্তি বেশি সেটাই বড় ব্যাপার। এ যেন হলিউডের 'হান্ট ফর রেড অক্টোবর' ও 'দ্য এবিস' চলচ্চিত্রের মিলিতরূপ।"
#এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানে বিশেষ যা রয়েছে:
**নেটওয়ার্ক এনাবেলড মিশন সিস্টেম এর সহায়তার উড়ন্ত অবস্থাতেই বিভিন্ন তথ্য আদানপ্রদান করতে পারে এফ-৩৫সি;
** বড় আকারের ডানা ও মজবুত ল্যান্ডিং গিয়ার রণতরীতে ওঠানামা এবং ক্যাটাপল্ট বা নিক্ষেপ যন্ত্র ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছে বিমানটির এই নৌ-সংস্করণকে;
** রয়েছে ফাইটার জেটে ব্যবহৃত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিন, যা একে প্রতিঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০০ মাইল বা মাক (শব্দগতি) ১.৬ গতি দিয়েছে;
** বিমানটি ফিউজিলাজের অভ্যন্তরে চারটি ও ডানায় আরও দুটি ক্ষেপণাস্ত্র বহনেও সক্ষম;
ইউএস চেয়ারম্যান অব দ্য ডিফেন্স চিফসের সাবেক উপদেষ্টা এবং ন্যাটোর সাবেক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক অস্টেন জানান, চীনের পক্ষ থেকে যেকোনো উদ্ধার তৎপরতা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের স্নায়ুচাপ সৃষ্টি করবে।
বিশেষ করে সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বিপজ্জনক। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ শক্তিরা দেশটির বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখছে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র কেউ এমনটা ভেবে সুযোগ নিক- তা কোনোমতেই হতে দিতে পারে না।
চীন বিষয়ক বিশ্লেষক ও ট্রুম্যান প্রজেক্টের সিকিউরিটি ফেলো ব্রাইস ব্যারোস বলেন, "চীন বিমানটি পেতে চায় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সাইবার গুপ্তচরবৃত্তির সাহায্যে এরমধ্যেই হয়তো দেশটি বিমানটির অভ্যন্তরভাগ ও নকশার ব্যাপারে কিছু তথ্য জেনে গেছে।"
"এবার হয়তো তারা বিমানটির বাস্তবিক যন্ত্রাংশ পেতে চায়, পরীক্ষা করে দেখতে চায়। ফলে এটির নকশা ও দুর্বলতা সম্পর্কে তারা বিস্তারিত অনেককিছু জেনে যাবে।"
মার্কিন নৌবাহিনী দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই উদ্ধার তৎপরতা শুরু হওয়ার কথা জানায়।সেটি কীভাবে চালানো হবে এবার সে সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:
সাগরতল থেকে ওঠানোর জন্য প্রথমে ডুবে যাওয়া বিমানটির ফিউজিল্যাজে রাবার ব্যাগ যুক্ত করবেন মার্কিন নৌবাহিনীর স্যালভেজ সুপারভাইজাররা। এরপর ধীরে ধীরে ব্যাগটিকে বাতাস ভরে ফুলিয়ে বিমানটিকে পানির উপরে নিয়ে আসা হবে।
বিমানের কাঠামো ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেলে কাজটি করা আরও কঠিন হবে।
তাছাড়া, দুর্ঘটনার সময় বিমানটির ডানা বা ফিউজিল্যাজের অভ্যন্তরে ওয়েপনস বে'তে কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এজন্য আরও সাবধানে কাজ করতে হবে স্যালভেজ কর্মীদের।
আন্তর্জাতিক জলসীমায় সামরিক প্রতিযোগিতার ইদুর-বেড়াল দৌড়ে জয়ী পক্ষই সব পুরষ্কার জেতে, আর প্রতিপক্ষকে খালি হাতেই ফিরতে হয়। এমন নজির অতীতেও রয়েছে।
১৯৭৪ সালে স্নায়ুযুদ্ধ তুঙ্গে থাকার সময়ে রাশিয়ার একটি সাবমেরিন হাওয়াই উপকূলের সমুদ্রতল থেকে গোপনে উদ্ধার করেছিল সিআইএ। এ ঘটনার ঠিক দুই বছর আগে চীনের পূর্ব উপকূলে ডুবে যায় ব্রিটিশ সাবমেরিন- এইএমএস পসাইডন। সে সময় চীনা নৌবাহিনীও এটিকে গোপনে উদ্ধার করে।
এছাড়া ২০১১ সালে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার অভিযানে রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম স্টিলথ হেলিকপ্টার ব্যবহার করে মার্কিন বিশেষ বাহিনী। ওই সময় একটি হেলিকপ্টার ক্রাশ ল্যান্ডিং করেছিল, সেটি পাকিস্তান চীনের হাতে তুলে দেয় বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
ব্যারোস জানান, আমাদের বিশ্বাস তখন চীন ওই হেলিকপ্টারের প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার পেয়ে যায়।
তবে সাগরতলের সবচেয়ে গভীর থেকে সরঞ্জাম উদ্ধারের রেকর্ডটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই। ২০১৯ সালের মে'তে মার্কিন নৌবাহিনী ফিলিপাইন সাগর তলদেশ (সাড়ে ১৮ হাজার ফুট গভীরতা) থেকে একটি পরিবহন বিমানের ধবংসাবেশ উদ্ধার করে, যা গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে গভীরতম সফল স্যালভেজের রেকর্ড হিসেবে যুক্ত হয়।
ব্যারোস জানান, উদ্ধার কাজে বিফল হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিলে সবচেয়ে সহজ সমাধান হবে টর্পেডো ছুঁড়ে ডুবে যাওয়া বিমানটি ধ্বংস করে দেওয়া। তবে এখনও মার্কিন নৌবাহিনী সে উপায় নিয়ে ভাবছে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
- সূত্র: বিবিসি