প্রায়ই ভুলে যাচ্ছেন? দুশ্চিন্তা নয়- নিউরোসায়েন্স বলছে এটাই হতে পারে আপনার মগজের গোপন ক্ষমতা
জগতে আলাভোলা-আত্নহারা মানুষ বিরল নয়, আবার আছে আইনস্টাইনের মতো এমন মানুষেদেরই অসাধারণ কীর্তি। কিন্তু, তাই বলে ভুলোমনা হওয়াটা কম আপদের নয়। সংসারে এতে বিপত্তি পদে পদে।
যেমন কেউবা অফিসের সহকর্মীর নামটাই গুলিয়ে ফেলেন অনায়সে। আবার গিন্নির দেওয়া জরুরি বাজারের ফর্দ ফেলে বের হয়েছেন বাড়ি থেকেই। ঘরে ফিরে তিনি কেমন সমাদর! পাবেন তা বলাই বাহুল্য। কর্মজীবনেও রয়েছে এই স্বভাবের নিন্দা-তিরস্কার।
সব বয়সের মানুষের মধ্যে স্বল্প-স্মৃতির এই 'দোষ' কমবেশি থাকলেও বেশিরভাগ বয়স্করা মনে করেন বয়স বাড়ার কারণেই তাদের মস্তিষ্ক ধীরগতির হয়ে পড়ছে। ফলে মনে থাকছে না নিতান্ত সাধারণ বিষয়।
বিড়ম্বনার কথা তো নতুন নয়, এবার আসুন জানা যাক কিছু সুসংবাদ। এনিয়ে দুর্ভাবনাও ঝেড়ে ফেলুন, কারণ তাতে কোনো লাভ তো হবেই না- উল্টো বাড়বে বিপদ। বিজ্ঞানীরা ভুলোমনাদের আশ্বস্ত করে জানিয়েছেন, এটি আমাদের মগজের নিউরনের গোপন এক ক্ষমতাও হতে পারে, যা অন্যদের থাকে কম।
ভাবছেন মশকরা! মোটেও নয় জনাব, খোদ বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার রিভিউয়ে প্রকাশিত নিবন্ধেই জানানো হয়েছে এ আশ্চর্য তথ্য। কীভাবে তা সম্ভব সেটাই জেনে নেওয়া যাক সংক্ষেপে।
নিউরোসায়েন্সের মূল কিছু শর্তই দেয় সে ব্যাখ্যা:
- প্রথমেই জেনে রাখা দরকার, আমাদের অনেক অনেক বেশি তথ্য প্রতিনিয়ত আদান-প্রদান করতে হয়। সবটাই কিন্তু সকলে মনেও রাখতে পারে না। আর নির্দিষ্ট করে ঘটনার খুঁটিনাটিসহ মনে রাখা তো আরও দুষ্কর। কয়েক সেকেন্ড বা মিনিট পরেও এসব ছোটখাট ব্যাপার ভুলে যাই আমরা।
- দ্বিতীয়ত কিছু বিষয় ভুলে যাওয়া বা ক্ষেত্রবিশেষে বেশিরভাগ বিষয় ভুলে যাওয়া মগজের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এমনটা না হলে তথ্যের ভারে অচল হয়ে পড়তো মগজ। দৈনন্দিন জীবন-যাপনও হয়ে পড়তো অসম্ভব।
- আর সবশেষে শুধু এটুকু মনে রাখুন, মগজের কাজ নির্দিষ্ট কিছু স্মৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাকে সে সবচেয়ে দরকারি মনে করে তাতেই গুরুত্ব দেয়।
এই তত্ত্বের ব্যাখ্যায় ট্রিনিটি কলেজ অব ডাবলিনের গবেষকরা তাদের বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে:
ভুলে যাওয়া ত্রুটির বদলে মস্তিস্কের সুনির্দিষ্ট একটি বৈশিষ্ট্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে চারপাশের পরিবেশের সাথে সে তথ্য বিনিময়ের বৈচিত্র্য অর্জন করে। তাছাড়া, কিছু স্মৃতি ভুলে যাওয়া আদতে উপকারী, এতে সুবিধেমতো আচরণ করা যায়, ক্ষেত্রবিশেষে নেওয়া যায় আরও ভালো সিদ্ধান্ত। যেমন ভুলোমনারা সহজে অন্যের প্রতি স্থায়ী বিদ্বেষ পোষণ করতে পারেন না।
তাছাড়া, চলমান পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় প্রায়শই এমন স্মৃতি সঞ্চয় করি আমরা। এসব স্মৃতি ভুলে যাওয়ার ওপরই নির্ভর করে মানসিক সুস্বাস্থ্য।
সহজভাবে বললে, আমাদের মগজ ভুলে যেতেই শেখে, তাই বলে কোনো স্মৃতি আসলে চিরতরে হারায় না। আসলে সেগুলোকে কেবল অগম্য করে মগজ সংরক্ষণ করে, ফলে আমরা চাইলেই ইচ্ছেনুসারে মনে করতে পারি না সেসব।
একে একটি 'গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য' বলে উল্লেখ করেন ড. থমাস রায়ান এবং ড. পল ফ্রাঙ্কল্যান্ড। তারা দুজনে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধটির সহ-লেখক। রায়ান যুক্ত আছেন ট্রিনিটি কলেজের ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে আর পল কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যা বিভাগে কর্মরত।
তাদের ধারণা, এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই চাইলে ভুলে যাওয়ার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে থামানোও সম্ভব।
অপরদিকে যারা অ্যালঝেইমার বা মারাত্মক স্মৃতিভ্রষ্টতার রোগে ভুগছেন- তাদের ক্ষেত্রে ভুলে যাওয়ার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ছিনতাই হয়েছে। এতে মগজের এনগ্রাম সেল নামক স্মৃতি সংরক্ষক কোষ পুরোপুরি অগম্য হয়ে পড়ে। এই ঘটনাকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের সংজ্ঞায় স্মৃতি হারানো বলে।
এ ধরনের রোগীরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। সে তুলনায় সাধারণ ভুলোমনোরা কিন্তু ঠিকই ঘর-সংসার, অফিস-আদালত করে চলেছেন।
এবার আশা করা যায়, জগতের সব ভুলোমনারা কিছুটা আশায় বুক বাঁধতেই পারেন। আর গুরুত্বপূর্ণ দিনক্ষণ মনে রাখতে ক্যালেন্ডার আর চেকলিস্টের ব্যবহার চালিয়ে যান। ছোটখাট ব্যাপারও দুই-তিনবার চেক করে নিন।
আরেকভাবে বলা যায়, দূরপাল্লার দৌড়বিদেরা কিন্তু শক্তি ও জ্বালানির উৎস হিসেবে সাথে পানি বা স্যালাইন ঠিকই বহন করেন। একে তারা কিন্তু বোঝা ভেবে হয়রান হন না। ভুলোমনাদেরও চেকলিস্টকে বিপত্তি না মনে করে নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবেই গ্রহণ করা উচিত। আর তাতে লাভ বৈ ক্ষতি নেই মোটেও।
বুদ্ধিমান ভুলোমনারা ঘরে-বাইরে অশান্তি চান না। তাদের যতই অগোছালো দেখতে হোক-আসলে তারা প্রতিভাবান। আর সেই প্রতিভা একটু খাটালেই তারা বেশ সুশৃঙ্খল জীবন কাটাতেও পারেন।
- সূত্র: আইএনসি ডটকম