ঢাকার ভাগাড়ের অব্যবস্থাপনা চরমে
রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে আর এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নেই বৈজ্ঞানিক কোনো পদ্ধতি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য মাতুয়াইল ও উত্তর সিটির বর্জ্য আমিনবাজারে সবথেকে প্রাচীন ল্যান্ডফিল পদ্ধতিতে অপসারণ করা হয়।
এ পদ্ধতিতে রাজধানীর বর্জ্য লোকালয়ের বাইরে নিয়ে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবেশ এবং ঐ অঞ্চলকে দূষিত করা হচ্ছে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। তবে সিটি কর্পোরেশন বলছে এ পদ্ধতি মোটেও পুরাতন নয়। এর সঙ্গে কিছু প্রক্রিয়া যুক্ত হলে দূষণ অনেকাংশেই কমে আসবে। আর নগরবাসীকে বর্জ্য থেকে স্থায়ী সমাধানের জন্য বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস উৎপাদনের প্রকল্পের কাজ চলছে।
দুই সিটির ব্যবহৃত যে দুটি ল্যান্ডফিল রয়েছে, সেগুলোর ধারণক্ষমতা থেকেও অধিক পরিমাণ বর্জ্য সেখানে ফেলা হচ্ছে।
ডিএসসিসি'র মাতুয়াইল ও ডিএনসিসি'র আমিনবাজারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ল্যান্ডফিল ঘুরে দেখা যায়, দুটির কোথাও নেই পরিবেশ সংরক্ষণের নিয়ম মেনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ল্যান্ডফিলে সংরক্ষিত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে এর আশপাশের এলাকা। আমিনবাজারের ল্যান্ডফিলের বর্জ্য মিশে যাচ্ছে এর পার্শ্ববর্তী নদীতে আর মাতুয়াইলের বর্জ্য মিশে যাচ্ছে পাশের লেক ও ডোবায়।
ব্যবহারের শেষ পর্যায়ে মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল
রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৮৯ সালে ৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে মাতুয়াইলে ল্যান্ডফিল স্থাপন করা হয়। ২০০৬ সালে ল্যান্ডফিলটির বর্জ্য ধারণক্ষমতা শেষ হলে আরো ৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এ জমির ব্যবহারও শেষ পর্যায়ে।
মাতুয়াইলের ল্যান্ডফিলে প্রবেশের রাস্তার ওপরে ও এর আশপাশেও জমে থাকে বর্জ্য। সরাসরি ল্যান্ডফিলের বর্জ্যের দূষিত কালো পানি ড্রেনে চলে আসে লোকালয়ে এবং মিশে যায় এর আশপাশের ডোবা নালায়। ল্যান্ডফিলের উপচে পড়া বর্জ্য মিশে যাচ্ছে এর পাশ্ববর্তী ডোবাগুলোতে। একইসঙ্গে, এ ল্যান্ডফিলের আশপাশে গড়ে ওঠা আবাসিক ভবনগুলোতে মানুষ দুর্গন্ধে অতিষ্ট।
ডিএসসিসি গত পাঁচ বছরে মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলে প্রায় ৪৭ লাখ টন বর্জ্য চূড়ান্তভাবে অপসারিত করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড়ে বছরে প্রায় ১৩ শতাংশ বর্জ্য বাড়ছে ঢাকা দক্ষিণে। ডিএসসিসির ল্যান্ডফিলে প্রায় এক হাজার ট্রিপে ছোট বড় ট্রাক, হুইলডোজার, এক্সক্যাভেটর, বুলডোজারের মাধ্যমে প্রায় চার হাজার টন বর্জ্য স্থানান্তর করা হয়।
ল্যান্ডফিল পদ্ধতি মোটেও পুরাতন নয় উল্লেখ করে ডিএসসিসি'র প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো, বদরুল আমিন টিবিএসকে বলেন, "আমাদের দেশের এ পদ্ধতি হয়তো যুগের তুলনায় আধুনিক নয়, তবে বিজ্ঞানসম্মতভাবেই দক্ষিণের বর্জ্য অপসারণ করা হয়। মাতুয়াইলের যে ৫০ একর বর্জ্যে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে সেখানে সবুজায়ন করা হয়েছে। আমাদের এ ল্যান্ডফিলকে ঘিরেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ৪ টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। সেখানে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস উৎপাদন করা হবে। আগামী ১০ বছর পরে আর এ অবস্থা থাকবে না।"
তিনি আরও বলেন, "মাতুয়াইলের বর্জ্য থেকে যে গ্যাস কিংবা এর মাধ্যমে যে দূষণ হয় তা খুব বেশি নয়। অন্য মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ এবং ক্ষতিকর গ্যাস উৎপাদন আরও অনেক বেশি।"
পরিত্যক্ত আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে যুক্ত হচ্ছে ৮০ একর জমি
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫৪টি ওয়ার্ডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ২০০৯ সালে আমিনবাজারে ৫৪ দশমিক ৮৮ একর জমিতে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শুরু হয়। জাইকার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০১৭ সালে এখানে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু এরপর থেকে সেখানে মূল ভূমির ওপরই বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে।
আমিনবাজারের ল্যান্ডফিলের বর্জ্য থেকে বের হওয়া দূষিত পানি নদীর পানিতে মিশে কালো হয়ে যাচ্ছে যা হয়ে উঠেছে ব্যবহার অনুপযোগী। এক সময় এ নদীতে এবং পাশের জলাধারগুলোতে প্রচুর মাছ থাকলেও এখন জেলেরা পায় না মাছের দেখা। আর যে মাছগুলো পাওয়া যায় সেগুলো থেকে আসে বাজে গন্ধ। এছাড়া এ ল্যান্ডফিলের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেও বাতাসে ভেসে বেড়ায় বাজে গন্ধ।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে দুই সিটি মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে সাত হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে। ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বর্তমানে দুটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্প দুটি হলো, ৭৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আমিনবাজার ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণ প্রকল্প এবং ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক যান ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহের মাধ্যমে সড়ক পরিষ্কার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকাজের উন্নয়ন প্রকল্প। এ দুটির আওতায় বর্তমানে উত্তর সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকাজ পরিচালিত হচ্ছে।
ডিএনসিসি'র প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এম সাইদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "উত্তর সিটিতে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। ১৫০ ধরনের বিভিন্ন যানবাহন বিশেষত ড্রাম ট্রাক, ওপেন ট্রাক, কমপ্যাক্টরস, আর্মড রোল, কনটেইনার ব্যবহার করে বর্জ্য বহন করা হয়। অপসারণের পর বর্জ্যগুলো সংকোচিত করা হয়। লিচেটও (তরল বর্জ্য) শোধনের পর নদীতে ফেলা হয়। পরবর্তীতে তা মাটির আস্তরণের নিচে চাপা দেওয়া হয়। সুতরাং এখানে কোনো দূষণ নেই। তবে, দুর্গন্ধ থাকার মতো অবশ্যই কারণ আছে।"
তিনি বলেন, "পিপিপি মডেলের আওতায় ডব্লিউটুই প্রকল্প হতে চলেছে, যা শীঘ্রই স্বাক্ষরিত হবে। আইন মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণের পর ডিএনসিসি দ্রুত চুক্তি স্বাক্ষর করবে বলে আশা করা হচ্ছে। আশা করি চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার ২০ মাসের মধ্যে নিয়ন্ত্রিতভাবে বর্জ্য পোড়ানোর প্রক্রিয়া (ইনসিনারেশন) শুরু করা যাবে।"
তিনি আরও বলেন, "ডিএনসিসির আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে ৫২ একর জমিতে কিচেন ওয়েস্ট বা খাদ্য বর্জ্য নিষ্পত্তি করা হয়। জায়গাটির ধারণ ক্ষমতা পূর্ণ হওয়ায় ডিসিসিসি বর্তমান ল্যান্ডফিলের পাশেই ৮০ একরের একটি জায়গায় ডিপিপির বন্দোবস্ত করেছে। সরকার ইতোমধ্যে এই ডিপিপির অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া, ডিএনসিসি ৫২ একরের জায়গা পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার পরিকল্পনা করছে।"
"সমন্বয়হীন ব্যবস্থাপনায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ"
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি (বেলা) এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান টিবিএসকে বলেন, "আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো বিধিমালাই নেই। যে যেভাবে পারছে বর্জ্য উৎপাদন করছে আবার নিজেদের মতো করে সব ধরনের বর্জ্য একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলে দিচ্ছে। এগুলো দেখার কেউ নেই।"
আমিনবাজারের ল্যান্ডফিলে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে ২০১১ সালে বেলার করা মামলার এখনও কোনো ফয়সালা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের মামলার কোনো সুরহা হয়নি বরং সেখানে আরও জমি অধিগ্রহণ করে আরও ময়লা ফেলা হচ্ছে। ২০১৯ সালে সংসদীয় একটি কমিটিও হয়েছিল এটির বিষয়ে সেখানে নির্দেশনাও ছিল যেন আমিনবাজারে ময়লা ফেলা না হয় কিন্তু এখন আরও বেশি ফেলা হচ্ছে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা আইন করা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, "একদিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নেই কোনো নীতিমালা আবার এব ব্যবস্থাপনায় জড়িতদেরও নেই সুরক্ষার ব্যবস্থা। এজন্য বিধিমালা প্রণয়ন খুবই জরুরি। আমাদের ১৮ কোটি মানুষের উৎপাদিত বর্জ্যের মধ্যে ভেজা কিংবা কিচেন বর্জ্যই বেশি। তাই এগুলো দিয়ে সার উৎপাদন করতে পারলে সেটা পরিবেশের জন্যও সহায়ক কিন্তু এগুলোকে প্লাস্টিক, পলিথিনের সাথে মিশিয়ে ফেলে রাখা হয়। যদি বর্জ্য বেশি জমে যায় তখন আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়, এতে যেমন পরিবেশ দূষিত হয় তেমনি মানুষ আক্রান্ত হয় ক্যান্সারে।"
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল টিবিএসকে বলেন, "ঢাকা সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমন্বয়হীনতার কারনে বর্জ্যের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। উল্টো বর্জ্য পরিবেশকে দূষিত করছে। এজন্য সিটি কর্পোরেশনকে সবাইকে সমন্বয় করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পরিকল্পনা করতে হবে এতে কঠিন, মেডিকেল, প্লাস্টিক, পচনশীল বর্জ্য আলাদা আলাদা সংরক্ষণ এবং এগুলোর ব্যবস্থাপনা তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী করতে পারলেই বর্জ্য দিয়ে নদী, খাল, পরিবেশ দূষণ রোধ করা সম্ভব হবে।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করা কঠিন কোনো বিষয় না। বর্জ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ল্যান্ডফিল কিংবা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার জন্য একটা সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকতে হবে।"