বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল গঠন করেছে সরকার
দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল (বিআইডিএফ) গঠন করে অর্থায়ন শুরু করেছে সরকার। ঘূর্ণায়মান এই তহবিল থেকে বছরে ২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে শুধু বন্দর ও বিদ্যুৎখাতের সরকারি প্রকল্পে এ তহবিল থেকে প্রাথমিক অর্থায়ন করা হবে। পরে পর্যায়ক্রমে সরকারিখাতের লাভজনক অন্যান্য প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে। পর্যায়ক্রমে তহবিলের আকার বাড়িয়ে বেসরকারিখাতেও অর্থায়ন করা হবে। সরকারের এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিআইডিএফ এর উদ্বোধন করেছেন। এই তহবিল থেকে অর্থায়নের জন্য পায়রা বন্দরের রামনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ও মেইনটেনেন্স ড্রেজিং শীর্ষক স্কিমে অর্থায়নের জন্য ত্রি-পক্ষীয় ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে অর্থবিভাগ, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সোনালী ব্যাংক।
চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ৫৪১৭ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সোনালী ব্যাংকে ডিপোজিট করবে। সোনালী ব্যাংক তা ১০ বছর মেয়াদে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ঋণ হিসেবে বিতরণ করবে।
তহবিল উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের নিজের পায়ে চলতে হবে। নিজেদের অর্থায়নে কাজ করতে হবে। সেজন্য বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল গঠন করলাম।'
তিনি বলেন, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে অন্যের কাছে হাত না পেতে নিজেরা উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন করতে হবে। দেশি-বিদেশি যারাই বিনিয়োগ করতে আসুক, এ তহবিল থেকে প্রাথমিক অর্থায়ন করা হবে।
'আমরা আমাদের দেশকে উন্নত করব, এটাই আমাদের লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কাজ করার দরকার আছে', যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
চীন, তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৪ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) এক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। ২০০৯ সালে, দেশটি একটি সার্বভৌম তহবিল হিসাবে চায়না ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন গঠন করে যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলার লেনদেন করে।
তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরণের তহবিল এটিই প্রথম বলে জানিয়েছেন অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। তবে এর আগে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে বৈদেশিক অর্থের যোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নবগঠিত তহবিল থেকে পর্যায়ক্রমে সরকারের অন্যান্যখাতের লাভজনক প্রকল্পে অর্থায়ন করা হবে। প্রকল্প চালু হওয়ার পর সেখান থেকে যে আয় হবে, তা দিয়ে তহবিলের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধের মতো পর্যাপ্ত আয় করতে না পারলে বাজেট থেকে ঘাটতি অর্থায়ন করা হবে।
তারা জানান, তুলনামুলক কম সুদে বিদেশি ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বিদেশি নির্ভরতার কারণে অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয়। এই তহবিল থেকে বৈদেশিক অর্থায়নের সংস্থান করা গেলে সময়মত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, যা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি বাড়াবে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিকভাবে তহবিল থেকে বছরে ২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের লক্ষমাত্রা ধরা হলেও রিজার্ভের পরিমাণ বাড়লে এ তহবিলের আকারও বাড়বে এবং বেসরকারিখাতকেও ভবিষ্যতে এ তহবিল থেকে অর্থায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার বক্তব্যে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'আমাদের ৬ মাসের আমদানির টাকা রাখতে হবে। যে কোনো সঙ্কটে খাদ্য ক্রয় যেন করতে পারি। ছয় মাসের টাকা রিজার্ভে রেখে বাকি টাকা বিনিয়োগ করতে পারি। এজন্য আমরা নিজস্ব তহবিল গঠন করার চিন্তা করেছি'।
'এ তহবিল থেকে বিনিয়োগকারীরা ঋণ নিতে পারবে। আর অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করবো', বলেন তিনি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '৬ মাসের আমদানি ব্যয় রিজার্ভ রেখে বাকি অর্থ উন্নয়ন কর্মকান্ডে ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক। তবে যে পরিমাণ অর্থ তহবিলে স্থানান্তর করা হবে, তা রিজার্ভ থেকে মাইনাস করে নিতে হবে'।
তিনি বলেন, ব্যক্তিখাতকে এই তহবিলে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তবে কোন কারণে ব্যক্তিখাত ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তা সরকারের জন্য দায় সৃষ্টি হবে। সরকার পিপিপির আওতায় যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সেখানে সরকারি অংশে ২০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ করা হলে এসব প্রকল্পে বিদেশিদের আগ্রহ বাড়বে।
গত বছর জুলাই মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহার করার উপায় বের করতে নির্দেশনা দেন। তারপর অর্থমন্ত্রণালয় থেকে শুধু সরকারের লাভজনক প্রকল্পে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগের একটি গাইডলাইন তৈরি করতে অনুরোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
করোনার সময়েও রেমিটেন্সে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হওয়ায় রিজার্ভে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। গত ১০ মার্চ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
শেখ হাসিনা বলেন, 'করোনার সময়ও আমাদের রিজার্ভ ও রেমিটেন্স বাড়ছে। এই রিজার্ভের টাকা কীভাবে উন্নয়নে ব্যয় করতে পারি, সেটাই চিন্তা করেছি'।
'বার বার অন্যের কাছে হাত পাতা, আর ধার না করে নিজেদের অর্থ দিয়ে নিজেদের অবকাঠামো উন্নয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। এতে দেশেরও লাভ। আমাদের আত্মবিশ্বাস জন্মাবে। আমরাও পারি-তা বিশ্বকে দেখাতে পারবো। আমার চিন্তা দেশের মানুষকে দু'পায়ে দাঁড় করিয়ে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা', যোগ করেন তিনি।
মহেশখালী মাতারবাড়ি বন্দর উন্নত করা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'পায়রা বন্দর আমি নিজে করেছি, মোংলা বন্দর চালু করেছি। আমাদের একটা গভীর সমুদ্রবন্দরও করতে হবে'।
তিনি বলেন, 'ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের কতগুলো সুবিধা রয়েছে। ভারত, নেপাল ও ভুটানকে আমাদের বন্দরগুলো ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি। আরও অনেক দেশও ব্যবহার করতে পারবে'।
তহবিল উদ্বোধন ও ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফজলে কবির ও সোনালী ব্যাংকের সিইও আতাউর রহমান প্রধানসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।