স্থান নির্ধারণে অনিশ্চয়তা, বিলম্বিত হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো নির্মাণ প্রকল্প
সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শেষ হওয়ার পাশাপাশি নির্দিষ্ট তহবিলের বন্দোবস্ত হওয়ার পরেও প্রকল্পের অবস্থান নির্ধারণ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখে পড়েছে দেশের বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো (ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো- আইসিডি) নির্মাণ প্রকল্প।
প্রায় দুই দশক আগে নেওয়া পরিকল্পনায় গাজীপুরের ধীরাশ্রমের ১৫৪ একর ভূমিতে আইসিডি স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের। জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করে, আগামী বছর ৭৭৪.৫৬ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পটি শুরুর পরিকল্পনা করেছিল রেলওয়ে।
তবে গাজীপুরের ধীরাশ্রমের পরিবর্তে একই জেলার কালীগঞ্জে আইসিডি স্থাপনের পক্ষে প্রাথমিক মত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশন বলছে, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে ভিতরে আইসিডি স্থাপন করলে তা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না। উপরন্তু, শহরে এটি যানযট সৃষ্টি করবে।
এদিকে, রাজধানীর কমলাপুরে রেল সংযোগসহ একটি আইসিডি রয়েছে; ফলে এর কারণে ভেতরে কন্টেইনার যানজটের পাশাপাশি বাইরেও যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
নতুন প্রকল্পের কাজ শেষ হলে, এই ডিপোর কার্যক্রম সেখানে স্থানান্তর করা হবে যাতে কমলাপুরকে একটি মাল্টিমোডাল পরিবহন কেন্দ্রে পরিণত করা যায়।
অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো যেকোনো দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যবর্তী অবস্থান হিসেবে কাজ করে, যেখানে ট্রানজিটের সময় কার্গোগুলো সংরক্ষণ করা বা পরিবহনের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এছাড়া, এখানে পণ্য লোড এবং আনলোডের কাজও করা হয়।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভিতরে আইসিডি স্থাপন করলে তা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না। নতুন রেল লাইন নির্মাণ ছাড়াও কৃষিজমি, বনভূমি এবং জলাশয় অধিগ্রহণ করতে হবে।
২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ধীরাশ্রম এলাকাটি সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে তৈরি করা এক প্রতিবেদনে পরিকল্পনা কমিশনে বলেছে, দেশের ৭০ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানাই গাজীপুর এবং সাভারে অবস্থিত।
যেভাবে শহর সম্প্রসারণে হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে আইসিডির কন্টেইনারবাহী গাড়ি যানজট তৈরি করবে। এছাড়া, ধীরাশ্রমে ডিপো তৈরি করতে হলে পূবাইল থেকে ধীরাশ্রম পর্যন্ত ৭.২ কিলোমিটারের একটি রেললাইন নির্মাণ করতে হবে। এরজন্য ৭৮ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
কিন্তু কালীগঞ্জে যে স্থানে আইসিডি স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানে রেল সংযোগের লম্বা রেললাইন নির্মাণ করতে হবে না। এছাড়া, সেখানে কৃষিজমি খুবই কম এবং বনভূমি ও জলাভূমিও নেই।
কমিশন বলছে, ধীরাশ্রমে আইসিডির প্রবেশ ও বহির্গমনের ঢাকা-ভুলতা বাইপাসের ওপর ইউলুপ নির্মাণ করতে হবে। এতে মহাসড়কের গতি বাধাঁগ্রস্ত হবে। ফলে আইসিডির প্রবেশ ও বহির্গমনপথ উত্তর–দক্ষিণে সম্প্রসারিত করে এলজিইডি সড়কে করা হলে ঢাকা–ভুলতা বাইপাসের ওপর প্রস্তাবিত ইউলুপ নির্মাণ করার প্রয়োজন হবে না।
পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না শর্তে জানান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশের ভিতরে এখন অনেক সরকারি দপ্তর, সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানা রয়েছে। কেবল ধীরাশ্রমের এই জায়গাটি এখনও খালি।
"আইসিডি নির্মাণ করা হলে ভবিষ্যতে শহরে যানজট তৈরির মূল কারণ হবে এটি। ফলে বিআরটি প্রকল্পের মতো ধীরাশ্রম প্রকল্পও গাজীপুরের জন্য আরেকটি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। এ কারণে পরিকল্পনা কমিশন থেকে আইসিডি ধীরাশ্রমে না করে অন্য কোনো স্থানে নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে," যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "শুরুতে যদি সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই প্রকল্পটি বড় ভোগান্তীর কারণ হতে পারে। এসব বিবেচনায় আইসিডির স্থান নিয়ে পুনরায় ভাবছে পরিকল্পনা কমিশন। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর।"
২০২১ সালের শুরুতে ধীরাশ্রাম ভূমি অধিগ্রণে ৩,৪৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য রেলওয়ে থেকে পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, মূল আইসিডি স্থাপনে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি ) অর্থায়ন করার সম্মতি দিয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করে ২০২৪ সালে মূল আইসিডি নির্মাণের কাজে হাত দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল রেলওয়ের।
ইতোমধ্যে প্রকল্পের সমীক্ষার কাজও শেষ হয়েছে। নতুন কোনো স্থানে আইসি নির্মাণ করা হলে নতুন করে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করতে হবে। এতে দুই বছরের মতো পিছিয়ে যেতে পারে আইসিডি নির্মাণের কাজ। তখন এই প্রকল্পে এডিবির ঋণ নিয়েও অনিশ্চয়তায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ৭৭৪.৫৬ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ হিসেবে দেবে এডিবি; সরকার দেবে ৪১৬.১৫ মিলিয়ন এবং বাকি ১০৮ মিলিয়ন ডলার আসবে বেসরকারি খাত থেকে। যদিও বেসরকারি খাত এখনও নির্ধারণ করা হয়নি।
পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিৎ কর্মকার গত ৪ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রকল্পকে ইঙ্গিত করে বলেন, "প্রকল্প থেকে অর্থনৈতিক সুফল পেতে হলে স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে প্রকল্পটির অনুমোদন প্রক্রিয়ায় সময় লাগছে।"
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার টিবিএসকে বলেন, রেলওয়ে এখন পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্তের আশায় বসে আছে। তারা সিদ্ধান্ত দিলে সেই অনুযায়ী আইসিডি স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে পড়েছে। ফলে গাজীপুর সিটির মধ্যে আইসিডি স্থাপন করলে শহর আরও উন্নত হবে। মহাসড়কের পাশে আইসিডি স্থাপন করা হলে, সড়ক পথে কন্টেইনার পরিবহন করা সহজ হবে।"
৭.২ মিটার রেল সংযোগসহ পরিকল্পিত ধীরাশ্রম আইসিডি বছরে ৪,০০,০০০ টিইইউ (বিশ ফুট সমতুল্য ইউনিট) কন্টেইনার পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। এই প্রকল্প ফ্রেইট বা মালবাহী ট্রেন পরিবহনে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মতে, বাংলাদেশের প্রায় সব আন্তর্জাতিক কন্টেইনার পরিচালনা করে থাকে চট্টগ্রাম বন্দর।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক কন্টেইনারগুলোর অভ্যন্তরীণ চলাচলের মাত্র ৩ শতাংশ বহন হয় মালবাহী ট্রেনের মাধ্যমে। শুধুমাত্র কমলাপুর আইসিডি এবং চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যেই মালবাহী ট্রেন চলাচল করছে।
২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় ৩.১ মিলিয়ন টিইইউ কন্টেইনার পরিচালনা করেছে। অন্যদিকে, কমলাপুর আইসিডি বছরে প্রায় ৯০,০০০ টিইইউ কন্টেইনার পরিচালনা করে।
বর্তমানে দেশে ১৯টি অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো রয়েছে।