এমভি আবদুল্লাহ: সামরিক অভিযান নয়, শান্তিপূর্ণ সমাধান চান মালিক ও শিপিং খাত সংশ্লিষ্টরা
বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি হওয়ার এক সপ্তাহ পার হলেও সোমালি জলদস্যুদের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ শুরু হয়নি। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ ক্রু সদস্যদের জন্য উদ্ধার অভিযান শুরু করার অনুমতি চেয়েছিল।
কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো ধরনের সশস্ত্র হস্তক্ষেপে রাজি হয়নি। জাহাজের মালিক এসআর শিপিংও ক্রুদের জীবনের সম্ভাব্য ক্ষতির ভয়ে এ ধরনের অপারেশনের পক্ষে মত দেয়নি।
সেই অভিযানে সহযোগিতা দিতেও প্রস্তুতি নিয়েছিল সোমালি পুলিশ গার্ড। সোমবার (১৮ মার্চ) সোমালিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাতে এমনটি জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
সোমালি দস্যুদের হাতে তিন মাস ধরে জিম্মি থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েন থেকে ৪০ ঘণ্টার অভিযানে সব নাবিকদের জীবিত ও অক্ষত উদ্ধার করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী।
তবে এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২৩ জন নাবিকের জীবনরক্ষায় মুক্তিপণ দিয়েই এ ঘটনার সমাধান চায় তারা। ফলে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে নাবিকদের উদ্ধারে জাহাজটিতে ভারতীয় নৌবাহিনীর অভিযানকে যৌক্তিক নয় বলে মনে করছেন জাহাজ মালিক এবং শিপিং খাত সংশ্লিষ্টরা।
এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম সোমবার (১৮ মার্চ) রাত ৮টায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ক্রুদের নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আমাদের নাবিকদের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়, তাই আমরা ইইউ মেরিটাইম ফোর্স এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর উদ্ধার অভিযানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি।'
জাহাজটির মালিক কবির গ্রুপ জানিয়েছে, তাদের প্রধান লক্ষ্য জাহাজের ২৩ নাবিককে জীবিত, অক্ষতভাবে উদ্ধার করে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। এ লক্ষ্যে মধ্যস্থতাকারী বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।
কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমরা কোনো ধরনের সামরিক অভিযানকে সমর্থন করছি না। তাছাড়া রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও সুস্পষ্ট বার্তা হচ্ছে সহিংস অভিযান পরিচালনা করা যাবে না।'
নাবিকদের জীবন বিপন্ন হয় এমন কোনো অপারেশন তারা চাননা জানিয়ে এ মুখপাত্র আরও বলেন, 'আমরা বিষয়টির রক্তপাতহীন শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।'
তিনি আরও বলেন, এখনো সোমালি জলদস্যুরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। নাবিকেরা জাহাজের দৈনন্দিন কাজগুলো সেগুলো করছেন। নাবিকদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।
এর আগে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের নির্মূলে কাজ করা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন 'অপারেশন আটালান্টা'র পক্ষ থেকে আবদুল্লাহর জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের প্রধান খুরশেদ আলম এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সরকার এ প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি।
মেরিটাইম খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমভি রুয়েন জাহাজে অভিযান চালিয়ে জাহাজ ও নাবিক উদ্ধার এবং এমভি আবদুল্লাহর প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কারণ এমভি আবদুল্লাহ বর্তমানে সোমালি জলসীমার ভেতরে রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে যেকোনো দেশের ভুখণ্ড থেকে ১২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে প্রবেশ করতে হলে সে দেশের সরকারের অনুমতি নিতে হবে। একইসঙ্গে যে লক্ষ্যবস্তুতে অভিযান পরিচালনা করা হবে, তার সংশ্লিষ্ট দেশের অনুমতি নিতে হবে। সে হিসেবে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে অভিযান চালাতে হলে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি লাগবে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, উন্মুক্ত সাগরে জলসদ্যুদের শক্তি একরকম। অন্যদিকে উপকূলে তাদের শক্তি বহুগুণে বেড়ে যায়। এমভি আবদুল্লাহর বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই সামরিক অভিযান পরিচালনার সুযোগ নেই।
'সমস্যার সমাধানের জন্য জাহাজ মালিক এবং বাংলাদেশ সরকার আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি শতভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত,' বলেন তিনি।
এর ব্যত্যয় ঘটলে বড় ধরনের বিপর্যয় এমনকি নাবিকদের প্রাণহানি, জাহাজের ক্ষয়ক্ষতি এবং কয়লা বিষ্ফোরণ হয়ে মারাত্বক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
মোজাম্বিক থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। ঘটনার পরপরই বাংলাদেশি নাবিকদের জাহাজের একটি কক্ষে বন্দি করে ফেলা হয়। বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) কড়াকড়ি শিথিল করে নাবিকদের কেবিনে যাওয়ার অনুমতি দেয় জলদস্যুরা।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, জাহাজটি বর্তমানে সোমালিয়ার গোদোব জিরান উপকূল থেকে প্রায় চার মাইল দূরে নোঙর করেছে।
এ নিয়ে দ্বিতীয়বার কোনো বাংলাদেশি জাহাজ জলদস্যুদের হামলার শিকার হলো। এর আগে ২০১০ সালে একই কোম্পানির এমভি জাহান মনি জাহাজও সোমালি জলসদ্যুরা ছিনতাই করেছিল। ওই সময় জাহাজে ২৫ ক্রু এবং ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ মোট ২৬ ব্যক্তি ছিলেন। মুক্তিপণ দিয়ে ১০০ দিন পর তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।