আমদানিকৃত ভোজ্যতেল নিজস্ব জাহাজে পরিবহনের পরিকল্পনা টিকে গ্রুপের
দেশের ভোগ্যপণ্য এবং শিল্প খাতের অন্যতম জায়ান্ট চট্টগ্রাম-ভিত্তিক টিকে গ্রুপ নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসছে শিপিং খাতে। আমদানিকৃত ভোজ্যতেল পরিবহনে নিজস্ব জাহাজ ব্যবহারের লক্ষ্যে ব্যাপক বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে কোম্পানিটি।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে টিকে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সামুদা শিপিং লিমিটেড ১৫৭ কোটি টাকা বিনিয়োগে এমটি সামুদা নামে একটি অয়েল অ্যান্ড কেমিক্যাল ট্যাংকার কিনেছে— যার পণ্য পরিবহন সক্ষমতা ২৪,০২৫ টন।
জাহাজটিতে ২২ জন নাবিকসহ সর্বমোট ৪০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানা গেছে।
নিজেদের পণ্য নিজেদের জাহাজে পরিহনের পরিকল্পনা থেকেই শিপিং খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে বলে জানিয়েছে শিল্প গ্রুপটি।
টিকে গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি বছরে শুধুমাত্র ভোজ্যতেল আমদানি করে ৮ লাখ টন। প্রতিটন ভোজ্য তেল আমদানিতে জাহাজ ভাড়া দিতে হয় প্রায় ৪০ ডলার। সেই হিসেবে বছরে ভোজ্যতেল পরিবহনে টিকে গ্রুপের ব্যয় হয় ৩২ মিলিয়ন ডলার।
টিকে গ্রুপের নিজেদের আমদানি করা শতভাগ ভোজ্যতেল পরিবহন করতে আরও তিনটি অয়েল অ্যান্ড কেমিক্যাল ট্যাংকারের প্রয়োজন। প্রায় ১ লাখ টন পণ্য পরিবহন সক্ষমতার জাহাজ হলে টিকে গ্রুপ নিজেদের জাহাজেই শতভাগ পণ্য পরিবহন করতে পারবে।
সামুদা শিপিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার টিবিএসকে বলেন, "শিপিং খাতে আমরা নতুন যাত্রা শুরু করেছি। আমরা লাভ ক্ষতি পর্যক্ষেণ করছি। এই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে আমরা জাহাজের বহর বাড়ানোর পরিকল্পনা করবো।"
মোস্তফা হায়দার বলেন, এমটি সামুদার মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া থেকে ২টি ভয়েজে ২২ হাজার টন করে ৪৪ হাজার টন পাম অয়েল আমদানি করা হয়েছে। প্রতিটন ৪০ ডলার হিসেবে ৪৪ হাজার টন ভোজ্যতেল পরিবহনের ভাড়া বাবাদ ১ লাখ ৭৬ হাজার ডলার মূল্যের পণ্য পরিবহন হয়েছে।
তিনি বলেন, "এমটি সামুদা জাহাজ দিয়ে ভোজ্য তেলে আমদানির মোট চাহিদার প্রায় ২৫ শতাংশ পরিবহন করা যাবে। আমাদের লক্ষ্য শতভাগ ভোজ্যতেল নিজেদের জাহাজ দিয়ে পরিবহন করা হয়। এই লক্ষ্য পূরণ করতে একই আকারের আরও তিনটি ট্যাংকার প্রয়োজন।"
শিপিং খাতে নিজেদের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে মোস্তফা হায়দার আরও জানান, শুধু ভোজ্য তেলই নয়, ভোগ্য পণ্য, সিমেন্টের কাঁচামাল, আমাদের অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানিতে চার্টার ভেসেলের ওপর নির্ভর করতে হয়। সরকার শিপিং সেক্টরকে এগিয়ে নিতে ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন অ্যাক্ট করেছে। ফলে গত চার বছরে এই সেক্টর অনেক বড় হয়েছে। দেশীয় মালিকানাধীন জাহাজের সংখ্যাও বাড়ছে। নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। ফলে এই সেক্টরে টিকে গ্রুপের বিনিয়োগ বাড়ানোর সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠান মার্কেন্টাইল মেরিন অফিসের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, ২০২৪ সালে অন্তত ১৫টি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের নিবন্ধন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, "এ বছর সমুদ্রগামী জাহাজে নতুন বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে টিকে গ্রুপ। এই গ্রুপটি আরেও তিনটি সমুদ্রগামী অয়েল ট্যাংকার ক্রয় করার পরিকল্পনার কথা আমাদের জানিয়েছে।"
বর্তমানে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা ৯৮টি। জুনে এই সংখ্যা হবে ১০০। কন্টেইনারবাহী জাহাজ কেনায় কয়েকটি নতুন কোম্পানি বিনিয়োগে আসছে বলেও জানান তিনি।
মার্কেন্টাইল মেরিন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশি পতাকাবাহী সমুদ্রগামী তিনটি জাহাজের রেজিস্ট্রেশন দেয় মার্কেন্টাইল মেরিন অফিস। এরমধ্যে বাল্ক ক্যারিয়ার এমভি আবদুল্লাহ এবং এমভি জাহাজ ব্রাদার্স কবির গ্রুপের মালিকানাধীন। অন্যটি এমটি সামুদা টিকে গ্রুপর মালিকানাধীন।
বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের বহরে রয়েছে- ৭৩টি খোলা পণ্যবাহী বাল্ক ক্যারিয়ার, ৭টি ট্যাংকার, ৬টি অয়েল অ্যান্ড কেমিক্যাল ট্যাংকার, ৩টি গ্যাস ক্যারিয়ার , ৮টি কন্টেইনার এবং ১টি কার্গো কাম কন্টেইনার জাহাজ।
যে কারণে শিপিং খাতে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে
২০১৯ সালে নতুন করে 'বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইন-২০১৯' প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে স্থানীয় বন্দরে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করে, ৫০ শতাংশ পণ্য স্থানীয় জাহাজে বহন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে— যা আগে ছিল ৪০ শতাংশ।
এছাড়া, জাহাজ নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও জটিতলা দূর হয়েছে। আইনে ব্যবসায়ীদের ৫ হাজারের বেশি ডিডব্লিউটি ক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা ছিল ৩৬টি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইন হওয়ার পর ক্রমাগত বাড়তে থাকে জাহাজের সংখ্যা। আসতে থাকে নতুন নতুন কোম্পানির বিনিয়োগ।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র পথে মোট ১০০টি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ চলাচল করে। এরমধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ৭টি, বাকিগুলো বেসরকারি অপারেটরদের।
কবির গ্রুপের রয়েছে ২৪টি জাহাজ, মেঘনা গ্রুপের ২২টি, আকিজ গ্রুপের ১০টি, এইচআর লাইনের ৮টি এবং বসুন্ধরা গ্রুপ ও ভ্যানগার্ড শিপিংয়ের ৬টি করে জাহাজ রয়েছে।
এছাড়াও এমজেএল বাংলাদেশ, ওরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিং, বিএসএ শিপিং, এমআই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, দরিয়া শিপিং, হানিফ মেরিটাইম, অ্যাডভান্স শিপিং, পিএনএন শিপিং লাইনস, সানশাইন নেভিগেশন, পিএইচ নেভিগেশন এবং ডোরিন শিপিং লাইনেরও রয়েছে সমুদ্রগামী জাহাজ।
টিকে গ্রুপ সম্পর্কে
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামের দুই সহোদর মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও মোহাম্মদ আবুল কালাম মিলে টিকে গ্রুপের যাত্রা শুরু করেন। তৈয়বের নামের প্রথম অক্ষর 'টি' এবং কালামের নামের প্রথম অক্ষর 'কে' থেকে তাদের শিল্প গ্রুপের নামকরণ হয় টিকে গ্রুপ।
আবুল কালাম ও তার সন্তান মোস্তফা হায়দার এবং প্রয়াত আবু তৈয়বের সন্তানরা এখন টিকে গ্রুপের পুরো ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
ভোজ্যতেল ও চর্বি, ইস্পাত গ্যালভানাইজিং, পার্টিকেল বোর্ড, ভোগ্যপণ্য, চা বাগান, রাসায়নিক খাদ্য ও পানীয়, সিমেন্ট, সফটওয়্যার, পেট্রোকেমিক্যাল, প্যাকেজিং ও কন্টেইনার, চামড়, কাগজ, শেয়ার অ্যান্ড সিকিউরিটিজ, জাহাজ নির্মাণ শিল্প এবং টেক্সটাইল খাতসহ টিকে গ্রুপের ৩০টির অধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
গ্রুপটিতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছেন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। গ্রুপটির বার্ষিক টার্নওভার ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।