খেলাপি ঋণের দায়: হাবিব গ্রুপের পরিচালকদের ২ মাসের মধ্যে ৩৪৮ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ
খেলাপি ঋণের দায়ে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী হাবিব গ্রুপের পরিচালকদের দুই মাসের মধ্যে ৩৪৮ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অর্থঋণ আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম।
দুটি ব্যাংকের দায়ের করা ঋণখেলাপি মামলায় চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান মঙ্গলবার (১১ জুন) এ আদেশ দেন।
আদালতের তথ্যমতে, ২১০ কোটি টাকা পাওনা আদায়ে হাবিব গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠান এইচজি এভিয়েশন, সিয়ামস সুপেরিয়র এবং লিগ্যাসি ফ্যাশনের বিরুদ্ধে অর্থঋণ মামলা দায়ের করে ওয়ান ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা। গ্রুপটির অপর একটি প্রতিষ্ঠান হাবিব স্টিলসের কাছ থেকে ১৩৮ কোটি টাকা আদায়ে মামলা করে ঢাকা ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা।
চারটি প্রতিষ্ঠানেরই নেওয়া ঋণের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক ছিল না। কেবল পারসোনাল গ্যারান্টিতে [ব্যক্তিগত নিশ্চয়তা পত্র] বিপুল পরিমাণ এ ঋণ গ্রহণ করেন গ্রুপটির পরিচালকেরা।
হাবিব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ মোট সাত পরিচালক দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করছে।
অর্থঋণ আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম বলেন, 'বিবাদিরা আমমোক্তারের মাধ্যমে মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করে তাদেরকে স্বশরীরে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু বেশ কয়েববার দিন ধার্য করা হলেও তারা আদালতে উপস্থিত হননি।'
এ প্রেক্ষিতে গ্রুপটির চেয়ারম্যান এয়াকুব আলী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াছিন আলী, পরিচালক আমিনা মাহবুব, আঞ্জুমান আরা বেগম, সালমা সুলতানা, তানভীর হাবিব, সালমান হাবিব ও মাশরুফ হাবিবের বিরুদ্ধে একতরফা সূত্রে ডিক্রি প্রচার করেছেন আদালত।
১৯৪৭ সালে চট্টগ্রামের হাবিব উল্লাহ মিয়া হাবিব ট্রেডিং নামে ভোগ্যপণ্য আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা শুরু করেন। তার হাত ধরে পরবর্তীকালে তিন সন্তান ইয়াকুব আলী, মাহবুব আলী ও ইয়াসিন আলী ব্যবসায় আসেন।
গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, জাহাজ ভাঙা, ইস্পাত, সিমেন্ট ও কাগজ শিল্পে ব্যবসা সম্প্রসারণের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় হাবিব গ্রুপ। সাত দশক সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে শিল্পগোষ্ঠীটি।
তবে গত এক দশকে সার, বিদ্যুৎ উৎপাদন, এভিয়েশন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণের পর লোকসানের পথে নামে গ্রুপটি। ২০১৯ সালের পর থেকে গ্রুপটিতে বিনিয়োগ করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ঋণের মান খারাপ হতে থাকে।
এরপর ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে গত দুই বছরে গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ ও এনআই অ্যাক্টে (নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট) কমপক্ষে ১০০টি মামলা দায়ের করেছে ৬টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
আইডিএলসি ফাইন্যান্সের একটি মামলায় ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গ্রুপটির পাঁচ কর্ণধারের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও দুই মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ারা জারি করেন আদালত।
তবে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরপরই দেশত্যাগ করেন হাবিব গ্রুপের চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াসীন আলী, পরিচালক মাশরুফ হাবিব, সালমান হাবিব ও তানভীর হাবিব। তাদের কাছে ৩০ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাঁচহাজার কোটি টাকার বেশি আটকে আছে বলে জানা গেছে।
২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের পতন: ৪ হাজার কোটি টাকা দেনা করে ৩০ ঋণদাতাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে হাবিব গ্রুপ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
বর্তমানে হাবিব গ্রুপের ৩১টি প্রতিষ্ঠানেরই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান অন্য ব্যবসায়ীদের ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
হাবিব গ্রুপে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ লিমিটেডের কাছে বিমানভাড়া বাবদ বড় অঙ্কের পাওনা আদায়ে গত বছর গ্রুপটির ১১টি কোম্পানির অবসায়নের আবেদন করে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক সংগঠন উইলমিংটন ট্রাস্ট কোম্পানি।
লিকুইডেশন বা অবসায়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বিক্রি করে পাওনাদারের ঋণ মেটানো হয়। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে পড়ে, তখন প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা তখন টিবিএসকে জানান, বিভিন্ন সময় উইলমিংটন ট্রাস্ট কোম্পানির কাছ থেকে হাবিব গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন রিজেন্ট এয়ারওয়েজ লিমিটেড উড়োজাহাজ ভাড়া নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভাড়ার টাকা পরিশোধ না করায় উইলমিংটন ট্রাস্টের কাছে খেলাপি হয় বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থাটি।