টেক্সটাইল শিল্পকে বাঁচাতে এখনই উদ্যোগ নিন: সরকারকে বিটিএমএ
নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত, রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা অব্যাহত রাখা, সুদের হার কমানো এবং রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) সম্প্রসারণের মাধ্যমে টেক্সটাইল শিল্পকে বাঁচাতে অবিলম্বে এগিয়ে আসতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)।
একইসঙ্গে ভর্তুকি ও কর অবকাশ প্রদানের মাধ্যমে টেক্সটাইল শিল্পকে আরও সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছে সংস্থাটি।
শনিবার (৬ জুলাই) এক সংবাদ সম্মেলনে এসব সংকট তুলে ধরে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিটিএমএ'র সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, "ইতোমধ্যে কয়েকটি মিল বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আরও বেশকিছু কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।"
তিনি বলেন, শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, সাভারের কোনো কোনো মিলে গ্যাসের প্রেশার শূন্য পিএসআই (পাউন্ড পার স্কোয়ার ইঞ্চ) নেমে এসেছে— যেখানে অনুমোদিত পরিমান ১০ থেকে ১৫ পিএসআই।
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, "আমাদের ১ লাখ ডলারের গ্যাস দিন, আমরা ৪০ লাখ ডলারের রপ্তানি আয় দেব।"
তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক– যার অংশ প্রায় ৮৫ শতাংশ। এই রপ্তানিকৃত পোশাকের বড় অংশই যোগান দেয় দেশের টেক্সটাইল মিলগুলো।
"গত বছর ৪৭ বিলিয়ন ডলার পোশাক রপ্তানির মধ্যে লোকাল টেক্সটাইল মিলগুলোর অবদান ছিল ২৭ বিলিয়ন ডলার। আর স্থানীয় ব্যবহারের জন্য সরবরাহকৃত আরও ১২ বিলিয়নসহ এ খাতের মিলগুলোর অবদান ছিল প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার," বলেন তিনি।
পাকিস্তানের টেক্সটাইল শিল্পও বর্তমানে গ্যাস ঘাটতি, বড় অঙ্কের কর আরোপ এবং জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যার মুখোমুখি; এ কারণে সেদেশেও বেশকিছু শিল্প ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে।
স্থানীয় গণ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির আরও শিল্প ইউনিট অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার শিকার হতে চলেছে– আগামী ছয় মাসের মধ্যেই দেশের রপ্তানি স্থবির হয়ে পড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে বিটিএমএ'র সভাপতি বলেন, "পাকিস্তানে গ্যাস সংকট হলেও তাদের স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক ডিভ্যালুয়েশন এবং স্থানীয় কাঁচামাল তাদের রপ্তানি খাতকে এগিয়ে রাখছে। এসব কারণে গ্যাস সংকট স্বত্বেও তারা আমাদের চেয়ে এখনও ভালো অবস্থানে আছে।"
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, "গ্যাসের দাম বেড়েছে, আবার গ্যাস সংকট এখন তীব্র। কারখানাগুলো উৎপাদন খরচের সর্বোচ্চ অর্ধেকে এখন চালাতে পারছে। প্রতিকেজি ইয়ার্নের উৎপাদন খরচ ১.২৫ ডলার, সেখানে গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন যদি অর্ধেকে নেমে যায়, তাহলে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ ২.৫ ডলার হয়।"
তিনি বলেন, "রপ্তানি সম্প্রসারণ তহবিল (ইডিএফ) সংকুচিত করা হয়েছে, আবার পরিশোধের সময়ও কমিয়ে আনা হয়েছে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল কমে গেছে ৪০ শতাংশ। সুদের হারও বেড়েছে। ৯ শতাংশ সুদহার বেড়ে এখন ক্ষেত্রবিশেষে ১৫.৫ শতাংশ হয়েছে।"
এসব কারণে স্থানীয় শিল্প প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, "প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে ইয়ার্ন আমদানি বেড়েছে গত প্রায় এক বছরে প্রায় ১৩ শতাংশ। ভারতে যেসব সুবিধা দেওয়া হয়, এখানে তা দেওয়া হয় না। এ কারণে ইতোমধ্যে কিছু শিল্প স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আরো বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আমদানি নির্ভরতা বাড়বে এবং এক সময় স্থানীয় এই বাজার বিদেশিদের দখলে চলে যাবে।"
সংবাদ সম্মেলনে একটি প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে দেখানো হয়, প্রতিবেশী ভারত ২০০৪ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েট করা সত্ত্বেও দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে এ খাতের বিনিয়োগকারীদের কী ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে বলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০০ কোটি রুপি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ২৫০ কোটি রুপি বিভিন্ন সাপোর্টের মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে দেওয়া হয়। এছাড়া, টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানিতে প্রায় ২০ শতাংশ সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা হিসেবে পাচ্ছে।
'বাংলাদেশে কটন উৎপাদনকারী দেশ না হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে এদেশে কটন নির্ভর টেক্সটাইল খাত ভায়াবল হবে না'– সম্প্রতি এনবিআরের চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যে বিটিএমএ সভাপতি জাপান, ইতালি, জার্মানি ও ব্রিটেনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, "তারা কটন উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও টেক্সটাইলে ভালো করেছে সরকারের পলিসি সাপোর্টের কারণে।"
"যারা বলেন, বাংলাদেশে কটন উৎপাদন হয় না, এজন্য এদেশে টেক্সটাইল শিল্প ভায়াবল নয়, তাদের বলবো ঘুম থেকে জাগুন, বিশ্বকে জানুন। তারপর এসব বলুন," যোগ করেন তিনি।
'রপ্তানির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুললে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়'
রপ্তানি মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে খোকন বলেন, "গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে আমরা যখন বলেছিলাম— আমাদের রপ্তানি ইপিবির দেখানো রপ্তানি তথ্যে প্রতিফলিত হয় না— তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ অন্যরা আমাদের বকাঝকা করে বলেছিলেন, আমরা কেন বলছি রপ্তানি কম হচ্ছে। তখন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতিসহ আমরা সবাই চুপ হয়ে যাই।"
তিনি আরও বলেন, রপ্তানি প্রবৃদ্ধির মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাদের অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে— যা ছিল এক ধরনের ষড়যন্ত্র।
প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত রপ্তানির তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃত রপ্তানির তুলনায় অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার বাড়তি দেখানো হয়েছিল। এ ভুলের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংক– কোনো পক্ষই সরাসরি দায় নিচ্ছে না।