এলসি খুলতে পারছে না ব্যাংক, অনিশ্চিত ইউরিয়া আমদানি
কৃষিকাজে অপরিহার্য সার। কিন্তু, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার না পাওয়ায় দেশের ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ এই কৃষি উপকরণ আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খুলতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। গ্যাস সংকটে অধিকাংশ ইউরিয়া কারখানা বন্ধ থাকায়– সারের এই সংকট আরও জটিল রূপ নিয়েছে।
কৃষকদের ব্যবহৃত প্রধান এই সার সরবরাহের দায়িত্ব বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)-র। কিন্তু, ডলারের সংকটে ব্যাংকগুলো বিসিআইসি'র এলসি খোলার প্রস্তাব গ্রহণ না করে– অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফিরিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিসিআইসি'র আওতাভুক্ত পাঁচটি সার কারখানার মধ্যে চারটিই এখন বন্ধ গ্যাসের সংকটে। একমাত্র চালু আছে ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানা; নতুন কারখানাটির বাৎসরিক উৎপাদন সক্ষমতা ৯ লাখ ২৪ হাজার টন। সে তুলনায়, দেশের ইউরিয়ার চাহিদা বছরে ২৭ লাখ টন।
বর্তমানে বিসিআইসির কাছে ইউরিয়া সারের মজুদ আছে ৫ লাখ টনের মত, যা দিয়ে হয়তো চলমান আমন মৌসুমের প্রয়োজন মেটানো যাবে। তবে বিসিআইসি সবচেয়ে বেশি চিন্তিত মজুদ বাড়ানো নিয়ে। কারণ আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হবে পিক সিজন। যে সময়টাতে সারাদেশে বোরো ধানের আবাদ শুরু হয়। বোরোর মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ চাল উৎপাদন হয়।
এসব সমস্যার কথা তুলে ধরে গত ৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়েছে বিসিআইসি।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান চিঠিতে লিখেছেন, ''২০২৪-২৫ অর্থবছরে যথাসময়ে ঋণপত্র স্থাপন ও বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান নিশ্চিত করতে না পারলে নির্ধারিত লক্ষমাত্রা অনুযায়ী ইউরিয়া সার আমদানি করা সম্ভবপর হবে না। ইউরিয়া সরকারের আমদানি ব্যাহত হলে সারের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটবে, যা দেশের কৃষি পণ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে নিশ্চিতভাবে হুমকির মুখে ফেলবে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নসহ কৃষক পর্যায়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে।''
চিঠিতে বলা হয়, গত ৪ জুলাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফার্টিগ্লোব হতে সার আমদানির জন্য সোনালী ব্যাংকে এলসি খোলার প্রস্তাব পাঠায় বিসিআইসি। ডলার সংকটের কারণ ওই এলসি খোলা সম্ভব নয় বলে বিসিআইসিকে চিঠি লিখে এলসি প্রস্তাবটি ৭ জুলাই ফেরত পাঠিয়েছে সোনালী ব্যাংক।
বিসিআইসি'র চেয়ারম্যান টিবিএসকে বলেন, "আসন্ন বোরো মওসুমের জন্য সার আমদানি এখন থেকেই শুরু করা জরুরি। কিন্তু, ব্যাংকগুলো আমাদের এলসি নিচ্ছে না। সোনালী ব্যাংক আমাদেরকে চিঠি দিয়ে তাদের অপারগতার কথা জানিয়েছে।"
তবে চলমান আমন মৌসুমের জন্য যথেষ্ট সার মজুদ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, "আমরা চিন্তায় রয়েছি পিক (বোরো) সিজনের মজুদ বাড়ানো নিয়ে। এই পরিস্থিতিতে সরকার বিকল্প উপায় হিসেবে যদি বন্ধ কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করতো – তাতেও আমরা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।"
এর আগে গত ১৬ এপ্রিল কর্ণফুলী কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) থেকে সার আমদানির জন্য অগ্রণী ব্যাংকে একটি এলসি প্রস্তাব পাঠায় বিসিআইসি। কিন্তু, অগ্রণী ব্যাংক এলসি না খুলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তাবটি বিসিআইসি'তে ফেরত পাঠায়।
চট্টগ্রাম-ভিত্তিক কাফকো একটি বহুজাতিক উদ্যোগ হওয়ায়– ইউরিয়ার সার ক্রয়ের চুক্তি অনুযায়ী, এখান থেকে সার কিনতে সরকারকে এলসি খুলতে হয়।
পরে ওই এলসি প্রস্তাবটি ২১ এপ্রিল কৃষি ব্যাংকে পাঠায় বিসিআইসি। কৃষি ব্যাংক দীর্ঘ ৫৩ দিন পর ওই ঋণপত্র স্থাপন করেছে।
গত ২৯ মে আবারো কাফকো থেকে আরেকটি লটের সার কিনতে– এলসি খোলার প্রস্তাব অগ্রণী ব্যাংকে পাঠায় বিসিআইসি, দীর্ঘ ৩২ দিন পর অগ্রণী ব্যাংক ওই এলসি স্থাপন করেছে।
ব্যাংকগুলো যা বলছে
এবিষয়ে কথা বলার জন্য সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মুঠোফোনে কয়েকবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে গত ৭ জুলাই বিসিআইসির ঋণপত্রের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে পাঠানো চিঠিতে সোনালী ব্যাংককের উপমহাব্যবস্থাপক শাহেদুল ইসলাম বলেন, "চলমান ডলার সংকট এবং ব্যাংকের সদর দপ্তরের নির্দেশনার কারণে, দুঃখজনকভাবে আমরা এলসির প্রস্তাবটি নিয়ে এগোতে পারিনি।"
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ফোন দিলে, তিনিও জবাব দেননি। তবে তার ব্যক্তিগত সচিব ফরিদ জানান, এবিষয়ে এমডি কোনো মন্তব্য করতে চান না।
অবশ্য অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জাইদ বখত টিবিএসকে বলেন, "আগে সরকারের আমদানি দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার দিয়ে সহায়তা করতো বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কোনো ডলার দিচ্ছে না, ফলে আমদানির জন্য এলসি খোলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।"
এনিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে এলসি খুলে থাকে। "ব্যাংকগুলোর কাছে যথেষ্ট ডলার না থাকলে, তারা এলসি খুলতে পারে না। বিসিআইসি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেন করে। এবিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান হচ্ছে, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।"
'সব সারখানা চালু থাকলে, মোট চাহিদা স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমেই পূরণ করা সম্ভব'
বিসিআইসির দাবি, সরকার যদি তাঁদের পাঁচটি কারখানা চালানোর মত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে আমদানি ছাড়াই মোট বার্ষিক চাহিদার ২৭ লাখ মে. টন সার স্থানীয়ভাবেই উৎপাদন সম্ভব।
স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানির ভিত্তিতে ইউরিয়া সারের বার্ষিক চাহিদা নিরূপণ করে বিসিআইসি। নিজস্ব উৎপাদন ছাড়াও বিসিআইসি সরকারি পর্যায়ে চুক্তির (জিটুজি) ভিত্তিতে সার আমদানি করে সরবরাহ করে।
সরকারের আমদানি ব্যয় পরিশোধে বিসিআইসি ব্যাংকগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো নগদ অর্থ পরিশোধ করে না। বরং সরকারের দেওয়া কাউন্টার গ্যারান্টির বিপরীতে পোস্ট- ইমপোর্ট ফাইন্যান্স (পিআইএফ) ঋণ সৃষ্টির মাধ্যমে আমদানি করা সারের মূল্য পরিশোধ করে বিসিআইসি।
সরকারি চারটি ব্যাংক- সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ওপর অর্থবিভাগ কাউন্টার গ্যারান্টি ইস্যু করায় অন্য কোনও ব্যাংকের মাধ্যমে সার আমদানির এলসি খোলার সুযোগ নেই।
বিসিআইসির কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছর জিটুজি চুক্তির আওতায়, মোট সাড়ে ১৪ লাখ টন ইউরিয়া আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে কাফকো থেকে ৯ লাখ টন এবং অন্যান্য উৎস থেকে সাড়ে ৫ লাখ টন আমদানি করা হবে।