একমাত্র উপার্জনক্ষম নবীনুরের মৃত্যুতে চরম বিপর্যয়ে পরিবার
'এখন আমার কী হবে? এখন আমি কীভাবে চলব?'- এভাবেই বিলাপ করছেন আকলিমা বেগম। তাঁর কান্না কোনোভাবেই থামছে না। সংসারে উপার্জনক্ষম ছিলেন তার স্বামী, যাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি।
আকলিমা বেগমের স্বামী নবীনুর মোড়ল (৫০) একজন মাছ ব্যবসায়ী। বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী ইউনিয়নের শ্রীকন্ঠপুর গ্রামে। গত ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে নবীনুর পরিবার নিয়ে থাকতেন সাভারের বনপুকুর এলাকায়। গত শনিবার বিকেলে কোটা আন্দোলনের মধ্যে বাড়ির পাশের সড়কে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তাঁর পেটে গুলি লেগে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
নবীনুরকে সড়কে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে পাশের একটি বেসরকারি ক্লিনিক ও পরে ঢাকার সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
সেখানেই রোববার সকালে মারা যান নবীনুর। দুপুরের দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে স্বজনরা রওনা হন দেশের বাড়ির দিকে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে শ্রীকন্ঠপুর পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। গুলিতে মারা গেলেও লাশের কোনো ময়নাতদন্ত হয়নি।
শ্রীকন্ঠপুর গ্রামে নবীনুরের নিবাস হলেও– সেখানে তাঁর নিজস্ব কোনো ঘর নেই। একারণে স্বামীর লাশ দাফন করার পর আকলিমা বেগম ছোট মেয়েকে নিয়ে উঠেছেন বড় মেয়ের বাড়িতে। বর্তমানে তাঁর কোনো থাকার জায়গা নেই। কোথায় থাকবেন সে দুশ্চিন্তাও ভর করেছে শোকের মধ্যে।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে আকলিমা বেগম বলেন, 'ওই সময় সাভারের পরিস্থিতি খুবই শান্ত ছিল। কোথাও কোনো মারামারির ঘটনা ছিল না। গলির মধ্যে লোকজন ঘোরাফেরা করছিল। আসরের নামাজ পড়ে সে (নবীনুর) বাড়ির পাশের বাজারে পাওনা টাকা আদায় করতে যাচ্ছিল। বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব তিন মিনিটের মত। পথেই সে গুলিবিদ্ধ হয়।'
তিনি জানান, বাড়ি থেকে বের হওয়ার ২০-২৫ মিনিট পরই নবীনুরের ফোন থেকে ফোন আসে। অপরপ্রান্ত থেকে এক ছেলে জানান নবীনুর গুলিবিদ্ধ হয়েছে। হন্তদন্ত হয়ে তাঁরা ওই ক্লিনিকে ছুটে যান। পরে সেখান থেকে নবীনুরকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সারারাত আইসিইউতে ছিল। পরে সকালের দিকে জানানো হয় নবীনুর মারা গেছেন। একরাতে ওই হাসপাতালে ৭০ হাজার টাকার মতো বিল হয়েছিল। স্থানীয় মানুষদের কাছে চেয়েচিন্তে টাকা নিয়ে বিল পরিশোধ করেছেন।
নবীনুরের দুই মেয়ে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বেশ আগেই। এবার কোরবানি ঈদে বাড়ি এসে ২১ জুন ছোট মেয়ে ফাহিমা খাতুনকে বিয়ে দিয়েছেন। তবে মেয়েকে স্বামীর ঘরে তুলে দেননি।
সেসব স্মৃতি মনে করে আকলিমা বেগম বলেন, 'মাত্র এক মাস আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ওই সময় টাকা না থাকায় মেয়েকে আর স্বামীর ঘরে তুলে দেওয়া হয়নি, শুধু বিয়ে পড়িয়ে রাখা হয়েছিল। নবীনুরের ইচ্ছা ছিল বেশ ঘটা করে অনুষ্ঠান করে মেয়েকে সাজিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠাবে। কিন্তু, তা আর হলো না। আমার সব শেষ হয়ে গেছে।'
এলাকাবাসী জানান, নবীনুর এলাকায় অন্যের জমি ইজারা নিয়ে ঘের করতেন। প্রথমদিকে ভালো থাকলেও পরে এসে ঘেরে লোকসান হতে থাকে। দেনায় জর্জরিত হয়ে এলাকা ছাড়েন তিনি। সাভারে গিয়ে মাছ বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। মাঝে মাঝে বাড়ি আসতেন।
রাড়ুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'নবীনুর খুব গরীব। শুনেছি ঢাকায় মাছের ব্যবসা করতেন। রোববার লাশ বাড়ি নিয়ে আসার পর তাঁর মৃত্যুর খবর জানতে পারি। রাতেই লাশ দাফন করা হয়েছে।' লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে কিনা– তা তিনি জানেন না।
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন বলেন, রাড়ুলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে নবীনুরের মারা যাওয়ার ঘটনা শুনেছি। তাঁর পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ, সেটাও জেনেছি। চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে যদি উপজেলার পক্ষ থেকে কিছু করার থাকে, তাহলে আমরা তা করব।