চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: ব্যর্থতার এক নীলনকশা
চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ ৬০ শতাংশ শেষ হলেও এই পর্যায়ে এসে মেগা প্রকল্পটি নিয়ে সংকটে পড়েছে বাস্তবায়নকারী চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকাটি বঙ্গবন্ধু টানেল, আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, এয়ারপোর্ট রোডসহ একাধিক মেগা প্রকল্পের সংযোগস্থল; এমনকি সেখানে নেই কোনো ইউ-লুপ, ইউ-টার্ন বা সার্ভিস রোড। ফলে সুষ্ঠু যানবাহন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে চট্টগ্রাম ট্রাফিক বিভাগ।
যানজট কমানোর জন্য প্রকল্পটি অনুমোদন করা হলেও বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা দেখছেন, এই প্রকল্প যাত্রীদের দুর্ভোগ আরও বাড়াবে।
বিতর্কের আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো, এই ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়েটি অন্য কোনো সংস্থার সাথে পরামর্শ ছাড়াই ডিজাইন করা হয়েছিল। সূত্র থেকে জানা গেছে, ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই এর প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে।
এ বিষয়টি গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর একটি সভায় উঠে আসে। সভায়, এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে কী ধরণের সমস্যা হতে পারে তা তুলে ধরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।
ফলে, অর্ধেক নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) সিদ্ধান্ত নেয় যে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ইউ-লুপ এবং ইউ-টার্ন প্রয়োজন। অবশেষে প্রকল্পটি শুরু হওয়ার পাঁচ বছর পর একটি নতুন নীলনকশা তৈরি করা হচ্ছে। এতে নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নতুন প্রকল্পগুলোর সুফল পেতেও দেরি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ও শহরের যানজট নিরসনে ২০১৭ সালে নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প হাতে নেয় সিডিএ।
২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ হাজার ২৫১ কোটি টাকার এই প্রকল্পটির কাজের উদ্বোধন করেন।
টেকসই সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্পটির কাজ শুরুর ফলে এরইমধ্যে নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে কয়েক দফায়। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর যানজট নিরসনের পরিবর্তে উল্টো সৃষ্টির শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
মূলত নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর যাওয়ার পথে জি-১ এবং জি-২ সড়কে কোন ডানমুখী চলাচলের কোন লেন না রাখা হয়নি। ফলে যান চলাচলে বড় ধরণের জটিলতা ও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে। এই সংকটের সমাধান না হলে প্রকল্পটির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন মানুষ।
এই সমস্যা সমাধানে সিএমপির কারিগরি টিমের পক্ষ থেকে এক্সপ্রেসওয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে জানানো হয়, জি-১ এবং জি-২ রোডের ভবিষ্যৎ যানজট সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) তিনটি ইউলুপ নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই ইউটার্ন-১ নির্মাণ করতে হবে সিডিএ জিআই এক্সপ্রেসওয়ের নিচ দিয়ে। ইউটার্ন-২ নির্মাণ করতে হবে জি-১ সড়কে এবং বিমানবন্দর সড়কে ইউলুপ-৩ নির্মাণ করতে হবে।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর সড়কটির উপরে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ (সিএএবি) এর বহুতল অবকাঠামো নির্মাণের সম্ভাব্য জটিলতা প্রসঙ্গে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
এখানে জি-১ এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু টানেলের সাথে নগরীর সাথে সংযোগ বাধাহীন করতে জংশনগুলো নির্মাণ করা হবে। এছাড়া নগরী ও ইপিজেড এলাকার যানবাহনগুলো টানেলের সামনে দিয়ে আউটার রিং রোডে বের হওয়ার জন্য জি-২ এর মাধ্যমে আধুনিক সড়ক ব্যবস্থাপনা, যানজটবিহীন সড়ক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হবে। এসব নকশা প্রণয়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে সিডিএ।
সিএমপির কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, "বঙ্গবন্ধু টানেলের পরিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য সড়ক অবকাঠামো যুগোপযোগী করতে আমরা নগরীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ টানেলের সংযোগের বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে জরিপ করেছি। কোথায় যানজট হবে বা ভবিষ্যতে কী সমস্যা হবে সে বিষয়গুলো জানিয়েছি। এখন সিডিএ তাদের কমিটির মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে সিএমপির পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।"
এদিকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জানান, "সিএমপি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যানজট নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সে বিষয়টি আমরা অবগত আছি। আমাদের নকশা অনুযায়ী কাজ চলছে। যেহেতু ট্রাফিক সিস্টেম ব্যবস্থাপনা সিএমপি নিয়ন্ত্রণ করে, সেজন্য তারা আমাদের কিছু নকশা সংস্কারের কথা বলেছে। আমরা তাদের দেয়া পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের কারিগরি দল নতুনভাবে তিনটি সড়কের সমন্বয় করার জন্য নকশা প্রণয়ন কাজ করছে।"
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের আহ্বায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, "বঙ্গবন্ধু টানেলের সঙ্গে আউটার রিং রোড ও নগরীর সঙ্গে সংযোগের বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনায় বড় ধরনের গলদ আছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা অংশের সঙ্গে গাড়ি চলাচল নিয়ে সামনে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। কিন্তু সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এ করেণে সিএমপির পর্যবেক্ষণের পরে এখন নতুন করে নকশা প্রণয়ন করছে।"
"এভাবে সমস্যার সমাধান হবে না। টানেলে গাড়ি চলাচল আরো সহজ করতে হলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ইউলুপ নির্মাণ জরুরি," বলেন তিনি।
নেই কোনো জবাবদিহিতা, কোনো বিবেচনা?
বিতর্কিত এই প্রকল্প নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার দিকেই আঙুল তোলা হচ্ছে। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, এক্সপ্রেসওয়ের এ জটিলতায় প্রধাণত দায়ী চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
যদিও সিডিএ কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ মানতে নারাজ, বছরের পর বছর ধরে একাধিক ভুলের মাধ্যমে তারা ইতোমধ্যেই নিজেদের খ্যাতি হারিয়েছে।
সিডিএর অন্য ফ্লাইওভারের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়ও ত্রুটি ধরা পড়ে। এর আগে ৫.২ কিলোমিটার মুরাদপুর আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে যানজট সামলাতে নতুন লুপ যুক্ত করতে হয়েছিল।
একইভাবে, শহরের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারে একটি অতিরিক্ত লুপ যুক্ত করেছে তারা। গত বছরের নভেম্বরে নির্মাণের কিছুদিন পরেই সেটিতে ফাটল ধরে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া, কাউন্টির প্রথম ট্রাফিক টানেলটিও নকশার ত্রুটির কারণে পুনরায় ডিজাইন করতে হয়েছিল।
সিডিএ যখন বন্দর নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়, তখন কর্তৃপক্ষ সমস্ত খাল অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়। এমনকি হালনাগাদ ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানও অনুসরণ করেনি তারা। সিডিএকে আবারও প্রকল্পটি সংশোধন করতে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে দেলোয়ার মজুমদার বলেন, "জবাবদিহিতার অভাবে সিডিএ একের পর এক ভুল করছে। এ সব ভুলের জন্য সিডিএকে জবাবদিহি করতে হবে।"
তবে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসাব বিন শামস এ ত্রুটির জন্য যারা টানেল নির্মাণ করছেন তাদের দায়ী করেছেন।
"সার্ভিস রোড নির্মাণ করা এবং সেগুলো কীভাবে নির্মাণ করা হবে তা টানেল কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভর করে। তারা টানেল নির্মাণ শুরু করেছে পরে," বলেন তিনি।
টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলেছেন।
এদিকে, সিএমপির পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে সিডিএ ইতোমধ্যে সংকট নিরসনে বেশ কয়েকটি নতুন নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সিডিএ। মূলত জি-১ ও জি-২ এর মধ্যে আউটার রিং রোড, বঙ্গবন্ধু টানেল, এয়ারপোর্ট রোডকে ঘিরে এসব নকশা করা হচ্ছে।
দুটি ফেইজে সম্ভাব্য এসব সংকট নিরসনের চেষ্টা করছে সিডিএ। প্রথম ফেইজে এক্সপ্রেসওয়ের জন্য জংশনগুলো নির্মাণ করবে সিডিএ। এরপর দ্বিতীয় ফেইজে নতুন সড়ক নির্মাণ, সার্ভিস লেন নির্মাণ, র্যাম্প, পার্কিংসহ সড়ক প্রশস্থকরণের বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হবে।
শহরের তিন শিল্পাঞ্চল (ফৌজদারহাট, নাসিরাবাদ ও কালুরঘাট শিল্পাঞ্চল) ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে বন্দরের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে নগরীর লালখান বাজার থেকে শাহ্ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে।
এর মাধ্যমে শহর থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে যাওয়া যাবে। চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্যের বিশেষায়িত উড়াল সড়কটির প্রস্থ ১৬ মিটার। এক্সপ্রেসওয়ের মোট নয়টি স্থানে গাড়ি চলাচলের জন্য ২৪টি র্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে।
২৪টি র্যাম্পের মধ্যে টাইগারপাস এলাকায় চারটি, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে চারটি, বারিক বিল্ডিং মোড়ে দুটি, চট্টগ্রাম বন্দরসংলগ্ন নিমতলী মোড়ে দুটি, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ মোড়ে দুটি, চট্টগ্রাম রফতানি প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষ (সিইপিজেড) এলাকায় চারটি, কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকায় (কেইপিজেড) দুটি, কাঠগড় এলাকায় দুটি পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় দুটি র্যাম্প থাকবে। প্রতিটি র্যাম্প নির্মাণ হবে দুই লেনের। র্যাম্পগুলো একমুখী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হবে।
২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকার এ প্রকল্প ব্যয়ে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়।
প্রায় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ প্রকল্পের কাজের মেয়াদ ধরা হয় তিন বছর। সিডিএর প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র্যাঙ্কিন।