চট্টগ্রাম: বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত এক নগরী
"আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কখনো নাগরিক সমাজের মানসিকতা পরিবর্তন ছাড়া সফল হতে পারে না।" ছয়মাস আগে নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।
সেই সভাতেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম ষোলশহরের নবীনগর সোসাইটিকে বেছে নেওয়া হয়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা ও দ্য চিলড্রেনের সঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন যৌথ ভাবে এ পাইলট প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়। সে সময় চসিকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ছয়মাসের এই পাইলট প্রকল্প সফল হলে তা অনুসরণ করে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে এমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করা হবে।
গত ১ ডিসেম্বর প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এরপর গত চারমাসে সেখানে পা পড়েনি সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তার। চুক্তি অনুযায়ী, ডাস্টবিন সরবরাহ ও উন্মুক্ত নালায় স্লাব বসানোর কথা থাকলেও কোনোটাই করেনি সিটি করপোরেশন। শুধু এই একটি নয়, অতীতেও চট্টগ্রাম নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত চসিকের ব্যর্থতায় তার কোনোটাই সফলতার মুখ দেখেনি।
ইপসা ও চসিকের চুক্তি অনুযায়ী, নিয়মিত বর্জ্য সংগ্রহ হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় মানুষদের সহায়তায় ১০ থেকে ১৫ সদস্যের বর্জ্য ব্যবস্থাপক দল গঠন করার কথা ছিল সিটি করপোরেশনের। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেবকদের মাধ্যমে পলিথিনে মুড়িয়ে বর্জ্য অপসারণ করারও কথা ছিল। কথা ছিল কলোনির ড্রেনের ওপর স্লাব বসানোর।
তবে প্রকল্প শুরুর চারমাস পর বৃহস্পতিবার নবীনগর এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বেসরকারি সংস্থা দুটি তাদের নিজস্ব জনবল দিয়ে কিছু কাজ করলেও চুক্তির কোনোটাই বাস্তবায়ন করেনি চসিক। পরিচ্ছন্ন গ্রামের ঘোষণা দেওয়া হলেও সড়কে পড়ে আছে প্লাস্টিক ও গৃহস্থালী বিভিন্ন বর্জ্য। যত্রতত্র উন্মুক্ত নালায় ভাসছে আবর্জনা। অধিকাংশ এলাকাবাসী এখনো নালাতেই ময়লা ফেলছেন।
নবীনগর উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ইলিয়াস মিয়া তালুকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আসলে মুখে যা বলা হয়, তার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই। ৮০টি ডাস্টবিন বসানোর কথা থাকলেও ইপসা ৪০টি দিয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এখনো ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা হয়নি। চারমাসেও নালা গুলোতে স্লাব বসেনি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেবকদের মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণ করার কথা ছিল। এ জন্য বাড়িপ্রতি ১৫০ টাকা নেওয়া হয়; কিন্তু ফোন না দিলে ময়লা পরিস্কার হয়না।"
উন্নয়ন কমিটির তথ্য অনুযায়ী, নবীনগর সোসাইটির ৮০টি বাড়িতে তিন শতাধিক পরিবারের বসবাস। যেখানে রয়েছেন প্রায় দেড় হাজার বাসিন্দা।
ইপসা'র প্রকল্প সমন্বয়কারী সানজিদা আকতার টিবিএসকে বলেন, "প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মূল দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। কিন্তু তারা গত চার মাসেও ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করতে পারেনি। তবে ইপসার গঠিত ভলেন্টিয়ার দলের কার্যক্রমে গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। এলাকার প্রতিটি বাড়ি রং করে সচেতনতামূলক ফ্যাস্টুন সেঁটে দেওয়া হয়েছে।"
৩২ বছরেও গড়ে ওঠেনি শ্রেণিভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
১৮৬৩ সালে শহরের মর্যাদা পাওয়া চট্টগ্রামে ১২৭ বছর পর নগরীর প্রধান সেবা সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) গঠিত হয়। চসিকের প্রধান কাজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়ক বাতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন। তবে প্রতিষ্ঠার ৩২ বছরেও বর্জ্য সংগ্রহে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত এ শহরে এখনো যত্রতত্র দেখা মেলে বর্জ্যের। সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মেডিকেল, শিল্প-কারখানা ও ই-বর্জ্যের মতো সংক্রামক এবং বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও চলছে সনাতন পদ্ধতিতে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী শিল্পকারখানায় ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) থাকার কথা। কিন্তু নগরের অধিকাংশ শিল্পকারখানার ইটিপি নেই। কারখানা বিপজ্জনক বর্জ্য সরাসরি নালায় ফেলে দেয়। এসব বর্জ্য নালা হয়ে যাচ্ছে নদী-সমুদ্রে। এতে হুমকিতে পড়ছে জীববৈচিত্র্য।
চট্টগ্রাম নগরের সব ধরনের বর্জ্যের চূড়ান্ত স্টেশন দুটি। একটি বায়েজিদ বোস্তামী থানার আরেফিননগরে, অন্যটি হালিশহরের আনন্দবাজার এলাকায়। দূর থেকে এই স্টেশন দুটি দেখলে মনে হবে ময়লার পাহাড়। হালিশহর আবর্জনাগারের উচ্চতা হবে আনুমানিক ৩০০ ফুট।
বিপজ্জনক ও সংক্রামক বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য আলাদা ব্যবস্থা তো দূরে থাক, সাধারণ বর্জ্যের নিষ্কাশনে নেই কোনো ব্যবস্থাপনা। ব্লিচিং ও মশার ওষুধ ছিটিয়ে দায় সারে চসিক।
তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে নগরের আনন্দবাজার এলাকায় মেডিকেল বর্জ্য নিষ্কাশন ও বিশোধন করতে 'ইন্সিনেটর প্ল্যান্ট'স্থাপন করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে দিতে চায় চসিক
সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে চসিকের স্ট্যান্ডিং কমিটি। তবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে গেলে এর জন্য মাসে মাসে সার্ভিস চার্জ গুনতে হবে সেবা গ্রহীতাকে, তাতে অসন্তুষ্ট নগরবাসী।
নগরের চাঁন্দগাও এলাকার বাসিন্দা ও স্কুল শিক্ষিকা শাহানা আক্তার বলেন, "স্থানীয় সরকার আইন (২০০৯) অনুযায়ী সিটি করপোরেশন তার নিয়ন্ত্রণাধীন সকল জনপথ, সাধারণ পায়খানা, প্রস্রাবখানা, নর্দমা, ইমারত ও জায়গা থেকে আবর্জনা সংগ্রহ ও অপসারণ করবে। এজন্য নাগরিকরা ট্যাক্সও দিচ্ছে। এই কাজও যদি তারা বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয়, তাহলে তারা কোন কাজটা করবে?"
জানতে চাইলে চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, "যেসব এলাকায় ডোর টু ডোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চালু নেই, সেসব এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেসরকারিভাবে করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি করপোরেশন। নগরবাসী যদি ফি দিতে না চায়, তাহলে তারা নিজেরা করপোরেশনের নির্ধারিত ডাস্টবিনে এনে বর্জ্য ফেলবে।"
২০১৬ সালের ১ আগস্ট তৎকালীন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাতটি ওয়ার্ডে ঘরে ঘরে গিয়ে (ডোর টু ডোর) সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এছাড়াও নগরবাসীকে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টার মধ্যে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে আবর্জনা ফেলার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কর্পোরেশনের সেবকরা সেই আবর্জনা রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যে অপসারণ করতো। এ কর্মসূচির ফলে সে সময় নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরলেও পরে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
নালা-নর্দমা হয়ে পয়োবর্জ্য যাচ্ছে নদীতে
চট্টগ্রামের পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের দায়িত্বে রয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। তবে প্রতিষ্ঠার ৫৮ বছরে এ নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেনি সংস্থাটি। বর্তমানে দৈনিক ৫৩৯ ঘনমিটার ফিক্যাল স্লাজ (মানব বর্জ্য) জমা হয় সেপটিক ট্যাংকে। এরমধ্যে ১৫ ঘনমিটার চসিকের এবং ২০ ঘনমিটার এনজিও ডিএসকের ব্যবস্থাপনায় পরিশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা না থাকায় নগরে নালা-খাল গড়িয়ে বাকি বর্জ্য যায় কর্ণফুলি ও হালদা নদীতে।
চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য এলাকায় নির্দিষ্ট নিয়মে বর্জ্য নিষ্কাশন করা হয় না। এ ধরনের বর্জ্য নিষ্কাশনে নামমাত্র কাজ করে চসিক। সেটাও করা হয় 'চট্টগ্রাম সেবা সংস্থা' নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। পুরো নগরের পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনে তাদের গাড়ি আছে মাত্র তিনটি। ওই তিনটি গাড়ি দিয়ে মাসে ১০-১২টি বাড়িতে কাজ করেন তারা।
চট্টগ্রাম সেবা সংস্থার ব্যবস্থাপক মো. ইসমাইল বলেন, "আমরা এক বছরে ১০০ থেকে ১৫০ বাড়িতে কাজ করতে পারি। শহরের বাকি বাড়ির মালিকরা নিজেদের মতো কেউ নালায় কিংবা কেউ পাশের কোনো পরিত্যক্ত জায়গায় সুইপার দিয়ে বর্জ্য ফেলে দেন। মহানগরের বস্তিবাসীর প্রায় ৩০ হাজার কাঁচা পায়খানা এবং ৬০ হাজার স্যানিটারি পায়খানার পয়োবর্জ্য সরাসরি ড্রেনে ফেলা হয়।"
বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, "চট্টগ্রামের বয়স ৫০০ বছর। এখানকার সব বর্জ্য কর্ণফুলি ও হালদা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। এটি পরিবেশ এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ওয়াসার স্যুয়ারেজ মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম ক্যাচমেন্টের কাজ শুরু হয়েছে। বাকি ৫টির অর্থায়নের জন্যও দাতা সংস্থা আগ্রহী হয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে।"
বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের বসবাস বন্দরনগরীতে। শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার জন্য ২০১৭ সালে স্যুয়ারেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে ওয়াসা। সেবা সংস্থাটি বলছে, এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করা হলে ৮৯ লাখ মানুষকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় যুক্ত সক্ষমতা অর্জন করবে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এই লক্ষে চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট-১ বাস্তবায়নে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি তাইয়ু ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।