তুরস্কের নির্বাচনে কী হতে পারে ২৮ মে? কিংমেকার ওগান কোনদিকে যাবেন?
২০২৩ সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হয়ে গেল। তুরস্কের জাতীয় নির্বাচনে কেউই প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশ ভোট পাননি। তুরস্কের সুপ্রিম ইলেকশন কাউন্সিলের প্রধান নিশ্চিত করেছেন যে আগামী ২৮ মে ক্ষমতাসীন রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান এবং প্রধান বিরোধী প্রার্থী কেমাল কিলিচদারুলুর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আহমেত ইয়েনার সাংবাদিকদের জানান, এরদোয়ান ৪৯.৫১ সতান এবং কিলিচদারুলু ৪৪.৮৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তৃতীয় অবস্থানে আছেন কট্টর জাতীয়তাপন্থী নেতা সিনান ওগান, ৫.১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে।
৬০০ আসনের মধ্যে এরদোয়ানের নেতৃত্বে পিপলস অ্যালায়েন্স জিতেছে ৩২২টি, আর কেমাল কিলিচদারুলুর নেতৃত্বে নেশনস অ্যালায়েন্স জিতেছে ২১৩টি আসন। একেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি; জিতেছে ২৬৭টি আসনে। সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য জিততে হয় ৩০০টি আসন। একেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সিএচপি জিতেছে ১৬৯টি আসন।
এবারই প্রথম প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রথম দফা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেননি। তিনি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতা কেমাল কিলিচদারুলুর কাছ থেকে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। কিলিচদারুলুর নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো নেশন অ্যালায়েন্স নামক জোট তৈরি করে, যার মধ্যে CHP, গুড পার্টি (İYİ), এবং বেশ কয়েকটি ছোট দল অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিরোধীরা এরদোয়ানের বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদ, দুর্নীতি এবং অর্থনীতি ও বৈদেশিক নীতির অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তোলে।
অনেক পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান হেরে যাবেন। কিন্তু ঘটল উল্টোটা, এরদোয়ান অল্পের জন্য একটি সম্পূর্ণ বিজয় পাননি এবং ভোট পেয়েছেন কেমাল কিলিচদারুলুর চাইতে ২৬ লাখ বেশি। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের এই বুঝতে না পারার বড় কারণ ছিল, তারা এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা এবং স্ট্রংম্যান ইমেজকে মূল্যায়ন করেননি।
একটি গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট, একটি মহামারী এবং ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও, এরদোয়ান এখনও তুরস্কের এক বিশাল অংশের নেতা, যারা তাকে শক্তিশালী নেতা মনে করেন, যিনি তুরস্ককে একটি আঞ্চলিক শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন এবং বিদেশী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দেশের স্বার্থ রক্ষা করেছেন। এরদোয়ান তার জাতীয়তাবাদী এবং রক্ষণশীল মিত্রদেরও একত্রিত করেন এবং কেমালকে তুরস্কের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে চিত্রিত করেন।
অন্যদিকে কেমাল একটি বিশাল বিচিত্র অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি একজন দুর্বল ও সিদ্ধান্তহীন রাজনীতিবিদ হিসাবে তার ভাবমূর্তি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কেবল এরদোয়ান-বিরোধী সেন্টিমেন্ট দিয়ে নির্বাচন জেতা সম্ভব হয়নি কেমালের জন্য। এরদোয়ান তুরস্কের সবচেয়ে বড় সুফি সঙ্ঘ মেনজিলের সমর্থনও লাভ করেন।
আরেকটি ভুল অনুমান ছিল যে তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প এরদোয়ানের বিরুদ্ধে যাবে। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টোটা। ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে দশটা প্রদেশ—গাজিয়ানতেপ, কারামানমারাশ, হাতায়, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাটিয়া, সানলিউরফা, আদানা, দিয়ারবাকির এবং কিলিচ—সেগুলোর মাঝে মাত্র তিনটাতে বেশি ভোট পেয়েছেন কিলিচদারুলু। মাত্র একটা প্রদেশ, কুর্দি-অধ্যুষিত দিয়ারবাকিরে তিনি ৭১% ভোট পেয়েছেন। অন্যদিকে বাকি সাতটা প্রদেশে গড়ে ৬০ শতাংশের মত ভোট পেয়েছেন এরদোয়ান।
এবারও প্রমাণিত হয়েছে, এরদোয়ানের প্রধান সমর্থক গ্রাম্য তুর্কিরা। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, শ্রমিক শ্রেণী এবং ধর্মপ্রাণ ভোটারদের মধ্যে তার শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে। এই গোষ্ঠী তাকে দেশের উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক অবস্থান বৃদ্ধি এবং প্রসারিত করার কৃতিত্ব দেয়। তুরস্কের মতো কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অধিকার তিনি রক্ষা করেছেন। এরদোয়ান রাস্তা, সেতু এবং বাঁধের মতো অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতেও প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন, যা গ্রামীণ বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান এবং গতিশীলতার উন্নতি করেছে। এরদোয়ানের সমর্থকরা তাকে একজন শক্তিশালী এবং ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে দেখেন যিনি বহিরাগত হুমকি এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে তুরস্কের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারেন।
অন্যদিকে, কেমালের মূল সমর্থক শহুরে, শিক্ষিত ও ধর্মনিরপেক্ষ ভোটাররা; যারা এরদোয়ানের শাসনে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের অবক্ষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। কেমালের সমর্থকরা তাকে একজন মধ্যপন্থী ও বাস্তববাদী নেতা হিসেবে দেখেন যিনি পশ্চিমের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে পারেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের জন্য তুরস্কের প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার করতে পারেন। ২০১৬ সালে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পরে এরদোয়ান যে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন তা শেষ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন কেমাল। ওই জরুরি অবস্থা ব্যবহার করে এরদোয়ান ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের কর্মীদের উপর ব্যাপক ধরপাকড় করেছেন। কেমাল তুরস্কের প্রেসিডেনশিয়াল শাসন ত্যাগ করার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন এই শাসনপদ্ধতির কারণেই এরদোয়ান আরো একনায়ক হয়ে উঠছেন।
কিন্তু এরদোয়ানের মত স্ট্রংম্যান কেন প্রথমবারের মতো এত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন? এরদোয়ান কেন প্রথম দফায় ৫০ শতাংশের বেশি ভোট জিততে ব্যর্থ হয়েছেন তার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। একটি কারণ হলো অতি জাতীয়তাবাদী ভোটারদের মধ্যে তার সমর্থন কমে যাওয়া, যারা ওগানের প্রচারণা দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ওগান জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পার্টির (MHP) প্রাক্তন সদস্য, যেটি পিপলস অ্যালায়েন্সে এরদোয়ানের জোটের অংশীদার। তিনি ২০১৮ সালে MHP থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের দল গঠন করেন, যার নাম অ্যানসেস্ট্রাল অ্যালায়েন্স (ATA)। তিনি সিরিয়া, লিবিয়া ও আজারবাইজানে তুরস্কের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থের সাথে আপস করার জন্য এবং গ্রীক সাইপ্রিয়টদের থেকে তুর্কি সাইপ্রিয়টদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য এরদোয়ানের সমালোচনা করেন। তিনি এরদোয়ানকে কুর্দি জঙ্গিদের প্রতি খুব নরম এবং পশ্চিমা শক্তির উপর খুব বেশি নির্ভরশীল বলেও অভিযোগ করেন। কিলিচদারুলু এই আহবান যে কাজে লেগেছে তা বোঝা যায় তার এই দ্রুত কিং মেকার হয়ে যাওয়া দেখে।
আরেকটি কারণ হলো এরদোয়ানের নীতি ও বক্তব্যের প্রতি কিছু রক্ষণশীল এবং ধর্মীয় ভোটারদের অসন্তোষ। কিছু ভোটার মনে করেন যে এরদোয়ান বাস্তববাদ ও সুবিধাবাদের পক্ষে তার ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতি ত্যাগ করেছেন। তারা এরদোয়ান সরকার ও তার পরিবারকে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। এ কারণে কেমালের সাথে কিছু ডানপন্থী দলকেও দেখা যায়।
তৃতীয় কারণ হলো কেমালের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সামাজিক কল্যাণের বার্তার আবেদন। কেমাল নিজেকে মধ্যপন্থী নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যিনি তুরস্কের বৈচিত্র্যময় সমাজকে একত্রিত করতে এবং তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন বলে মনে করেন। তিনি এরদোয়ানের সাংবিধানিক পরিবর্তনগুলো প্রত্যাহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; যা ব্যবহার করে এরদোয়ান স্বৈরাচারী হয়ে উঠছিলেন এবং সংসদীয় গণতন্ত্র ও বিচারিক স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করার অঙ্গীকার দিয়েছিলেন। তিনি মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে তুরস্কের অর্থনীতিকে উন্নত করার অঙ্গীকার করেছিলেন। প্রতিবেশী ও মিত্রদের সাথে তুরস্কের বিচ্ছিন্নতা ও বৈরিতার অবসান ঘটাতে এবং একটি শান্তিপূর্ণ ও গঠনমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করার প্রতিশ্রুতিও দেন কেমাল।
এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন সিনান ওগান। তার হাতে আছে ৫ সতানের কিছু বেশি ভোট, যা এরদোয়ানকে জিতিয়ে দিতে পারে দ্বিতীয় দফায়। এরদোয়ানের উগ্র জাতীয়তাবাদী ভোট তিনি কেটেছেন, যা পেলে এরদোয়ানের দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনে যেতে হতো না। তার সাথে এরদোয়ানের অমিল কমই। ওগান বৈদেশিক নীতির বিষয়ে এরদোয়ানের সাথে সহমত প্রকাশ করেছেন, যেমন নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়ার সাথে বিরোধে আজারবাইজানকে সমর্থন করা, রাশিয়ার S-400 ক্ষেপণাস্ত্র কেনার জন্য তুরস্কের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করা এবং গ্রিস ও সাইপ্রাসের বিরুদ্ধে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের অধিকার রক্ষা করা।
ওগান এখনো ইঙ্গিত দেননি তিনি কোন প্রার্থীকে সমর্থন করবেন। তবে তিনি বলেছেন যে তার ভোটারদের ইচ্ছাকে তিনি সম্মান করবেন। ওগান আরও বলেছেন যে তার দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হলে তিনি কোনো জোট সরকারে যোগ দেবেন না। অতএব, ওগান দ্বিতীয় দফায় এরদোয়ান বা কেমালের সাথে জোট গঠন করবেন কি না তা অনুমান করা কঠিন। তিনি তাদের সাথে নিজের আদর্শগত পার্থক্য বা মিলকে কতটা মূল্য দেন, সেইসাথে এই ধরনের জোট থেকে তিনি কতটা লাভ বা হারানোর আশা করেন তার উপর এটি নির্ভর করতে পারে।
ওগান অবশ্য বলেছেন, 'তবে আমরা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছি যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো আমাদের রেড লাইন।' সন্ত্রাসবাদ বলতে বুঝিয়েছেন কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের। তিনি আরো বলেন, বিরোধী প্রার্থী যদি কুর্দিপন্থী কোনো দলকে কোনো ছাড় দিতে রাজি না হয় তবেই তিনি কেমালকে সমর্থন করতে পারবেন। ওগান বলেন, তার লক্ষ্য ছিল তুরস্কের 'রাজনৈতিক সমীকরণ' থেকে দুটি প্রধান কুর্দি দলকে সরিয়ে দেওয়া এবং তুর্কি জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের শক্তিশালী করা।
এখান থেকে আন্দাজ করা যায়, ওগানের ভোট সব এরদোয়ানের দিকেই যাবে। কারণ কেমালকে বেশি ভোট দিয়েছেন দুটো গ্রুপ—আঙ্কারা আর ইস্তাম্বুল শহরের বাসিন্দারা এবং কুর্দিরা। কুর্দিপ্রধান প্রদেশগুলাতে গড়ে ৭০ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছেন কেমাল। তারপরও একেপির চাইতে সিএইচপি বেশ কম আসন পেয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে এটাও এগিয়ে দেবে এরদোয়ানকে।
কেমাল আরও ভোটারদের একত্রিত করতে সক্ষম হলে এবং এরদোয়ানের কিছু সমর্থককে পক্ষ পরিবর্তন করতে রাজি করাতে পারলে কেবল এরদোয়ানকে বিচলিত করা যাবে। ২৮ মে নির্বাচন তুরস্কের দুই দলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচনটি তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং বৈদেশিক সম্পর্কের পাশাপাশি আঅঞ্চলিকভাবে এবং ভূরাজনীতির ওপরও প্রভাব ফেলবে।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।