কাছাকাছি সময়ে প্রতিবেশী ৩ দেশের নির্বাচন: বাংলাদেশ কোন পথে যাচ্ছে?
১৯৪৭-এ ভারত-পাকিস্তান, '৭১-এ বাংলাদেশ — এ উপমহাদেশের তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম। এ তিন দেশের সরকারব্যবস্থা মোটাদাগে একই রকমের; সংসদীয় সরকারব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত। কিছুকাল পাকিস্তান ও বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা। নানা কারণে দেশ দুটির নির্বাচনব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেকবার। সংসদীয়ব্যবস্থায় পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনের বাধ্যবাধকতার ব্যত্যয় ঘটেছে। পক্ষান্তরে ভারত এক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর থেকে দেশটিতে মাত্র একবার জাতীয় নির্বাচন দুই বছর পেছাতে হয়েছিল। '৭৫-এ ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। এ দুটি ঘটনা ছাড়া ভারতের নির্বাচনী ক্যালেন্ডারে আর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। পাকিস্তানকে এ বছরের শেষের দিকে এবং ভারত ও বাংলাদেশকে ২০২৪-এর গোড়ার দিকেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার প্রশ্নে পাকিস্তান সাংবিধানিকভাবে 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা' প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের পার্লামেন্ট সদস্যদের মধ্যে থেকে একজন নির্বাচিত হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনা করেন। ইতোমধ্যেই পাকিস্তানের উচ্চকক্ষের সিনেটর আনোয়ারুল হক কাকার তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তিনি পাকিস্তানের বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টির (বিএপি) নেতা এবং বেলুচিস্তান থেকে নির্বাচিত সিনেটর ছিলেন।
বাংলাদেশেও এক দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রচলন করা হয়েছিল। যদিও বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পাকিস্তানের চেয়ে একটু ভিন্ন ধরনের ছিল। আর আমাদের এখানে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করা হয়েছিল একজন প্রধান বিচারপতিকে। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে '৯১-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি সরকার গঠন করে।
বিএনপি সরকার গঠনের দুই বছরের মাথায় মাগুরার উপনির্বাচনে 'ব্যাপক কারচুপির' অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধীদল ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে। এ রকম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই ১৯৯৬-এর নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারে অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগসহ আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অব্যাহত রাখে।
বিএনপি নীতিগতভাবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়। সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রচলন করে সংসদ ভেঙে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের অধীনে পাঁচ মাসের মাথায় আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
২০০১ আওয়ামী লীগ সরকার তার মেয়াদ শেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এ নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে। তবে এ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের বিরুদ্ধে 'পক্ষপাতিত্ব' ও নির্বাচন 'প্রভাবিত' করার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, নির্বাচনের সময় প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখতে না পারা। প্রশাসনের একটি অংশের একটি দলের প্রার্থীদের হয়রানি ও অসহযোগিতার অভিযোগ খুব বড় করে সামনে আসতে থাকে।
২০০১-এর নির্বাচনের পর জনমনে এমন ধারণা তৈরি হয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ইচ্ছা করলে নির্বাচন কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে প্রভাবিত করতে পারে। জনমনের এ ধারণা আরও দৃঢ়তা পায় যখন ক্ষমতাসীন দল পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রশ্নে এক বিশেষ ব্যক্তিকে সরকারপ্রধান করার জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। সরকার হঠাৎ করে বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা দুই বছর বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে।
ক্ষমতাসীন দল পরবর্তী নির্বাচনের জন্য যে বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে পেতে চাচ্ছিলেন, আইন সংশোধন করে চাকরির বয়সসীমা না বাড়ালে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। কেবল সে কারণেই বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও তার নিরপেক্ষতা নিয়ে অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরি হয়। প্রশ্ন তৈরি হয় এর কার্যকারিতা নিয়েও।
২০০২ সালে উচ্চ আদালতে কর্মরত বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি একাধারে বিচারপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তার তৈরি ভোটার তালিকা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে। অস্তিত্ববিহীন প্রায় দেড় কোটি মানুষকে ভোটার তালিকায় যুক্ত করার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সকল পক্ষপাতিত্বের অভিযোগের মুখে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়, যখন ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে এম এ আজিজ বিএনপি'র দলীয় প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দলীয় মনোনয়ন চান।
এর পরে দুই বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ২০০৬ সালে ক্ষমতাসীনদের 'উদ্যোগ' ব্যর্থ হলে প্রথমে সে সময়ের রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করা হয়। ইয়াজউদ্দিনের অপারগতায় ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে টানা দুই বছর ক্ষমতায় থেকে ২০০৮ সালে নির্বাচন দেন। দুই বছরের এ সরকার সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থন নিয়েই পরিচালিত হয়। ধারণা করা হয়, ফখরুদ্দিন আহমদ সামনে থাকলেও ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ। ২০০৮ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর টানা তিন মেয়াদে তারা এখন ক্ষমতায়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়। এর মাধ্যমে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেল? এখন এটা এক বিরাট প্রশ্ন! তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর স্থানীয় কূটনীতিকেরা। নিজ নিজ স্বার্থকে সামনে রেখে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষমতাধর দেশের বাংলাদেশের নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে অবাঞ্চিত হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও আমাদের আগের দুটি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল বা আছে, কিন্তু তখন পশ্চিমা দেশগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই ওসব নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো মন্তব্য করতে আমরা দেখিনি।
ভারতের আসন্ন নির্বাচন নিয়েও ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশটির বিরোধীদল নানা অভিযোগ উত্থাপন করছে। গণমাধ্যমের মালিকেরা পর্দার অন্তরালে ক্ষমতাসীনদের হাতেই চলে গেছে বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে। ভারতে গণমাধ্যম দুর্বল হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশটির গণমাধ্যমের দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে যুগ যুগ ধরে গণমাধ্যমের ব্যবসা করা — এদের কেউ সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নয়। আবার ইদানিং বহু গণমাধ্যম সরাসরি দলীয় সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। যদিও ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যে তীব্র বিরোধীতা রয়েছে, তা সত্ত্বেও ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে বিরোধীদলগুলো সরকারবিরোধী এক মোর্চায় যোগ দিয়েছে। এ সমস্ত দলগুলো চূড়ান্তভাবে নির্বাচনবিরোধী জোটে কতটা ফল অর্জন করতে পারবে, তা নিয়ে খোদ ভারতীয় গণমাধ্যমেরই স্পষ্টত সন্দেহ রয়েছে।
ভারতের সরকারবিরোধী জোট 'ইন্ডিয়া'তে সর্বভারতীয় দলের পাশাপাশি আঞ্চলিক দলগুলো যৌথভাবে অংশ নিয়েছে। আঞ্চলিক বিভিন্ন প্রশ্নে জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে বিরোধ তীব্র। আমাদের পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূলের সঙ্গে সিপিএম ও কংগ্রেসের তীব্র দ্বন্দ্ব রয়েছে। একই অবস্থা অন্যান্য রাজ্যগুলোতেও। ফলে আঞ্চলিক প্রশ্নগুলোকে পাশকাটিয়ে কেন্দ্রের ঐক্য কতক্ষণ ধরে রাখা সম্ভব সেটাই দেখার বিষয়।
এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান ভারত সরকার নির্বাচন কমিশন নিয়োগের সুপ্রিম কোর্টের ঘোষিত রায় বাতিল করে দিয়ে এক নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। যেখানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনপূর্ব সময়ের বিরোধীদলের রাহুল গান্ধীর সংসদ সদস্যপদ খারিজ করে দেওয়ার পর পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশটির সুবিধা হচ্ছে, গণমাধ্যম নিয়ে কিংবা বাংলাদেশের মতো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে কোনো বিতর্ক তেমনভাবে তৈরি হয়নি।
পাকিস্তানের সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে মার্কিন বিরোধিতার ফলাফল হাতে নিয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। শুধু ক্ষমতা থেকে বিদায় নয়, সেখানকার বিচার বিভাগকে কাজে লাগিয়ে 'লঘু পাপে, গুরু দণ্ড' দিয়ে আগামী নির্বাচনে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। একই অভিযোগ আমাদের এখানেও। প্রধান বিরোধীদলের শীর্ষনেতাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়েছে। পাকিস্তানের ইমরান খানের মতো তারাও নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। সামগ্রিকভাবে নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা ধরনের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, যা সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ বিনষ্টের নামান্তর। এর অপরিহার্য পরিণতি ভোগ করতে হবে সাধারণ মানুষকে।
এরই মধ্যে বিস্ময়কর হচ্ছে, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিদল একের পর এক বাংলাদেশে সফর করছেন। তাদের এ আগমন স্পষ্টত বিশ্বরাজনীতির একটি প্রধান কারণ। আগামীদিনে বাংলাদেশ কোন দিকে থাকবে — চীন-রাশিয়া বলয়ে না মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বলয়ে — এ প্রশ্নে আগামী নির্বাচন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন খুবই দরকারি। ২০১৪ কিংবা '১৮-এর মতো নির্বাচন যদি অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে পরবর্তীসময়ে সংকট বৃদ্ধি পাবে বলেই দেশের সাধারণ মানুষের আশঙ্কা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।