অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য নিয়ে আলোচনা শুরু করার জন্য ৩ মাস যথেষ্ট নয়: তারেক
অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য নিয়ে আলোচনা শুরু করার সময় এখনো আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি বলেন, আর একদিন পর অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ তিন মাস পূর্ণ হবে। একটি সরকারের সফলতা বা ব্যর্থতা মূল্যায়নের জন্য তিন মাস যথেষ্ট নাও হতে পারে।'
বুধবার (৬ নভেম্বর) রাজধানীর রমনা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
এসময় তিনি বলেন, তবে যারা প্রতিদিন বাজারে যান এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খান, তাদের কাছে তিন মাস তিন বছরের মতো মনে হতে পারে।
এই বিএনপি নেতা বলেন, 'তাই কৃষক, দিনমজুর, নিম্ন আয়ের মানুষ ও নিম্ন মধ্যবিত্তের কষ্ট লাঘবে কঠোরভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।'
তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সরকার যদি দ্রব্যমূল্যকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার সব সংস্কার প্রচেষ্টা জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
এই বিএনপি নেতা, জনগণের অপছন্দের কাজ পরিহার করে নির্বাচনে জয়লাভের ব্যাপারে অতি আত্মবিশ্বাসী না হয়ে, তাদের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনে মনোনিবেশ করতে দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন
তারেক রহমান বলেন, 'আমি আমার দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের বলব, আপনারা জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করুন, জনগণের সঙ্গে থাকুন, জনগণকে আপনাদের সঙ্গে রাখুন।'
তিনি বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে বিএনপি অবশ্যই বিজয়ী হবে।
তিনি আরও বলেন, 'জয়ের আস্থা থাকা প্রত্যেক নেতা-কর্মীর জন্য ভালো। তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী না হতে, নিজেকে জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন না করতে বা মানুষ পছন্দ করে না এমন ক্রিয়ায় জড়িত না হওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকুন। কারণ, যেকোনো পরিস্থিতিতে জনগণই আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু এবং তারাই বিএনপির সকল শক্তির উৎস।'
বিএনপির এই নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের মাফিয়া সরকারের প্রধান রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে এবং দেশকে আমদানি ও বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। 'কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে ১৫ বছরের দুঃশাসনের পরিণতি এখনও জনগণ বহন করছে।'
তিনি বলেন,৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শাসকের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে, দেশ ও জনগণের স্বাধীনতা রক্ষায় বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তির বৃহত্তর ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি আরও বলেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে দেশবাসী কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে।
তারেক বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ সরকারে পরিণত করার অব্যাহত প্রচেষ্টাসহ ক্ষমতাচ্যুত হাসিনার দোসরদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জন্য বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, '৫ আগস্টের পরাজিত শক্তি আজ আবারও বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।'
পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে অন্তর্বর্তীসরকারের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক শক্তিকেও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের 'সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের' স্মরণে 'জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস' উপলক্ষে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
১৯৭৫ সালের এই দিনে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সৈনিক ও বেসামরিক জনগণ যৌথভাবে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে ঢাকা সেনানিবাসের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে, যার ফলে তার ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হয়।
সরকারের সংস্কার উদ্যোগ সম্পর্কে তারেক রহমান বলেন, তার দল সংস্কার সমর্থন করে কিন্তু তারা বিশ্বাস করে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নথিভিত্তিক রাষ্ট্র সংস্কারের চেয়ে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক কর্মীও সমর্থকদের সংস্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 'কারণ, দিন শেষে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে রাজনীতিবিদরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।'
বিএনপির এই নেতা বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতও গত ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদকে সহযোগিতা করেছে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, 'যদি আমরা চাই নারাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ফ্যাসিবাদের সমর্থক হয়ে উঠুক। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন অপরিহার্য। আর তা না হলে দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন বা বিধি-বিধানের সংস্কার টেকসই হবে না।'
অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারেক রহমান বলেন, দেশের জনগণের আদালত এবং রাষ্ট্রীয় আদালত বা বিচার বিভাগ যদি শক্তিশালী ও কার্যকর থাকে, তাহলে ফ্যাসিবাদ কখনোই মানুষের স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে পারবে না।
তিনি বলেন, 'গণআদালত গণবিচার নয়, এর অর্থ হলো কোনো ব্যক্তিকে ক্ষমতায়িত বা ক্ষমতাহীন করার চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতে।'
তারেক বলেন, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, বিচার বিভাগ ও জনগণের আদালতকে কার্যকর ও শক্তিশালী করার মাধ্যমেই কেবল রাজনীতি ও রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য গুণগত সংস্কার নিশ্চিত করা সম্ভব।
তিনি বলেন, 'জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হলে রাষ্ট্রকে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ বা প্রচারের মতো অজনপ্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে না। কারণ জনগণ নিজেরাই খুনি, লুটেরা, অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মাফিয়াদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে প্রত্যাখ্যান করবে।'
তারেক বলেন, যেকোনো ফৌজদারি অপরাধের বিচার রাষ্ট্রীয় আদালতে বা বিচার বিভাগে হওয়া উচিত। 'কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক মাঠে বা জনগণের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা দলের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের সংস্কৃতি চালু হলে তা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কার হিসেবে বিবেচিত হবে।'
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জাতি আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী শক্তির চক্রান্ত প্রতিহত করতে আমাদের এখন সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।'
তিনি গণতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধিদের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, একটি বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রীয় সংস্কার সম্পন্ন করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সালাহউদ্দিন আহমেদ, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম খান, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রমুখ বক্তব্য দেন।