সম্প্রীতির এই বাংলাদেশ আমাদের সকলের
ছিমছাম ছোট্ট শহর মেহেরপুর। এ শহরে হাতে গোনা যেকখানা পুরোনো বাড়ি আছে - তার মধ্যে আমাদের বাড়ি একটা। মেহেরপুরের ভট্টাচার্য বাড়িটা কেউ এক ঝলক দেখলে, রবি ঠাকুরের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বলে ভুল করতে পারেন। বাড়ির বয়েস বছর ৯০। এই বাড়ির উত্তরাধিকারীরা বাড়িটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন পরম মমতায়। হয়তো ওঁদের বাড়িটা ওদের কাছে শুধু বাড়ি ছিল না; ছিল ভালোবাসা আর স্মৃতির নীড়, পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া এক পশলা আশীর্বাদ। আর তাই বাড়ির উত্তরাধিকারীরা রঙের প্রলেপ, আর টুকটাক ঘষামাজা করে তাকে নবযৌবন দেবার চেষ্টা করেছে যথাসাধ্য। তবু প্রসাধনের আড়ালে যেমনিভাবে বিগতযৌবনা নারীর বয়সটা ঠিকরে বেরিয়ে আসে, তেমনি বাড়িটাকেও খুঁটিয়ে দেখলে ধরা পড়ে যেত তার বয়েসটা। তবু বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া বাড়িটাকে কখনো আনাদৃত হতে হয়নি। কখনো যত্নের অভাব পড়েনি তার।
ভট্টাচার্য বাড়ির সামনের প্রান্তে ঝুল বারান্দায় বাঁশের ঝাঁপি। তার ঠিক ওপরটাতে ছিদ্র করা ফুল কাটা নকশা। বাড়ির ওপারের রাস্তা থেকে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলে দেখবেন - সেই নকশার মধ্যে লেখা আছে, "মেড বাই নাতু শেখ মিস্ত্রী, ১৯৩৫"। বাড়ির কারিগরের নিজ হাতে খোদাই করে রাখা নামটুকু এখনো রয়ে গেছে। পুরোনো বাড়ির চিলেকোঠায় পাখির কিচিরমিচির থেকে খোলা বারান্দায় দক্ষিণ হাওয়ার আনাগোনা। ভেতর বাড়ির দোতলার জানলাজুড়ে মধুমালতীর ঝোপ। ওরাও যেন আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ছিল বাড়িটিকে। পুরোনো গরাদের শিক থেকে হাত বাড়ালে ছোঁয়া যেত মধুমালতীদের। একটা অন্যরকম মিষ্টি গন্ধ, সাদা গোলাপি মেশানো রঙ। মেহেরপুর বাড়ির ঐ জানলাটায় বসে মধুমালতী আর খোলা আকাশকে সাক্ষী রেখে গল্পের বই পড়া আমার সবথেকে পছন্দের অবসর। গতবছরের অক্টোবরে ঐ জানলার ধারে বসে পড়েছি জর্জ অরওয়েলের '১৯৮৪'।
এভাবেই চলছিল দিন। হঠাৎ করে যৌক্তিক দাবির ছাত্র আন্দোলন লাশের মিছিলে ছেয়ে গেল। আমরা হারালাম খুব কাছের বন্ধু, ভাই আর কত শুভাকাঙ্ক্ষীকে। তবু ছাত্ররা ভয় পেয়ে সরে দাঁড়ায়নি। ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলো। কথা বলবার অধিকার মিললো মানুষের। ১৬ বছর যেসব মানুষ কথা বলেনি, ওরা সেদিন যেন সত্যিকারের মুখের ভাষা ফিরে পেল। যা কখনো লেখা হয়নি, তা-ও লিখতে শুরু করলাম আমরা। দিনটা আগস্ট মাসের ৫ তারিখ। দেশজুড়ে বিজয়োল্লাস আর বিপ্লবের মাস আগস্ট। নতুন করে সমস্ত ফিরে পাওয়ার উৎসবে তখন মেতে উঠেছে দেশের সাধারণ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠী দেশজুড়ে হামলা চালালো। বাদ গেল না সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির। বাঁচানো গেল না মেহেরপুরের সাবেকি বাড়িটাকেও। এক অপশক্তি বিজয়ের মূহুর্তকে ধুলিস্যাৎ করতে – এই অশীতিপর বাড়িটাতেও ধরিয়ে দিল আগুন। বাড়ির নিচতলাখানা আর্থিক কারণে ইসকন প্রচারকেন্দ্রের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে।
গত ৫ আগস্ট বিকেলবেলা একদল দুর্বৃত্ত সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে ভট্টাচার্য বাড়ির বারান্দায়। ভাঙচুর করে সদর দরজা ভেঙে ঢুকে পড়তে শুরু করে অচেনা অনেক মানুষ। পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয় আগুন। বাড়ির নিচতলায় ইসকন প্রচার কেন্দ্রের ৪ জন, ওপরতলায় বাড়ির উত্তরাধিকারীর পরিবার অবস্থান করছিল। বাড়ির অন্যতম উত্তরাধিকারী লীনা ভট্টাচার্য পেশায় একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। ওঁর একমাত্র ছেলে বছর চারেকের, স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে সদ্য। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও – লীনা ভট্টাচার্যের বাড়িটা বাঁচেনি। আগুন জ্বালানোর কথা জানতে পেরে, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তারা কোনোমতে জানালা ভেঙে পালিয়ে বাঁচে।
তখন দাউদাউ করে জ্বলছিল ভট্টাচার্য বাড়ি। আর পুড়ে যাচ্ছিল ৯০ বছরের স্মৃতি। ফোনকলে ডায়াল হচ্ছিল ফায়ার সার্ভিসের নম্বর। কিন্তু তারা নিরাপত্তাজনিত কারণে আসতে অস্বীকৃতি জানায়। অথচ নিরাপত্তার বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে – এগিয়ে আসে পাড়া-প্রতিবেশির দল। জল ঢালতে শুরু করে সকলে মিলে। পাশের বাড়িতে থাকা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসে সে বাড়ির সদস্যরা। তাদের সর্বাত্মক চেষ্টায় ৬ ঘন্টা পরে নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন। কিন্তু, ততক্ষণে সব শেষ। লুট হয়ে গেছে গয়না, টাকাপয়সা। পুড়ে ছিন্নভন্ন হয়ে গেছে বাড়ির ছাদের পুরোনো আড়াবর্গা থেকে ঘরের মেঝেটুকুও পর্যন্ত। ইসকন প্রচার কেন্দ্রের মূর্তিগুলোও ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে, মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছেন দেবতা। মেহেরপুরের ভট্টাচার্য বাড়িটি ওই এলাকার একমাত্র হিন্দু বাড়ি। তবু পাড়াপ্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কটা কখনো– বাধা পড়েনি ধর্মের বেড়াজালে।
ঈদের সময় পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে রুটি-সেমাই আসে এবাড়িতে। পুজোর সময় যায় খৈ আর নাড়ু। সেজন্যে কখনো ঈদ ওদের, পূজা আমাদের তা মনে হয়নি। বরং উৎসবের দিনে হাতে মেহেদির নকশার ফুটেছে ঈদের চাঁদ। আর তাই বোধহয় সে রাতে প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে – পাশের বাড়িতে নির্দ্বিধায় আশ্রয় নিতে পেরেছিল ভট্টাচার্য বাড়ির উত্তরাধিকারীরা। ওদের যত্নআত্তির ত্রুটি হয়নি। পরম আন্তরিকতায় পাড়াপ্রতিবেশীর সহায়তাতেই ওদের জীবনটা বেঁচে যায়।
এদিকে আমার সাতক্ষীরার পৈতৃক ভিটেবাড়িখানা ১০০ বছরেরও পুরোনো। স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে বিশেষ কোনো গুরুত্ব না থাকলেও নিজের বাড়ি কার কাছে না দামি? হোক সে ভাঙাচোরা, ফ্যাকাশে রঙের, তুলনামূলক কম আকর্ষণীয়... গত ৫ আগস্ট রাতে কিছু মানুষ এসে আমার সাতক্ষীরার বাড়ি বয়ে হুমকি দিয়ে যায় বাড়িতে ভাঙচুর ও হামলার। প্রাণের ভয়ে বাড়ির সমস্ত সদস্য এক কাপড়ে পালিয়ে আসি সে রাতেই। এরপর থেকে কয়েকদিন চলেছে লুকোচুরি খেলা।
সে রাতে হুমকি দেয়ার পর কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়েই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ব্যাচমেটদের ঘটনাটি জানিয়েছি। আশ্চর্যজনকভাবে আমার বন্ধুবান্ধব চুপ করে বসে থেকে সান্ত্বনা দেয়নি। বরং সবাইমিলে সাংবাদিকতা বিভাগের সিনিয়র, জুনিয়রসহ সবাইকে সাধ্যমতন জানিয়েছে। এগিয়ে এসেছে আমার পৈতৃক ভিটেটুকু বাঁচাতে। বিকেলবেলা মেহেরপুরে আমার দাদুরবাড়ি পুড়ে যাওয়ার দগদগে ঘা আতঙ্ককে বাড়িয়ে দিচ্ছিল শতগুণ। সাতক্ষীরায় অতরাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি পরিবারসুদ্ধ মানুষ, সঙ্গতকারণে ওরঁ পরিচয়টা গোপন থাকুক। তবু নিরাপদ আশ্রয়টা ছিল এক মুসলিম পরিবারের কাছে সেটা উল্লেখ করতেই হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের বর্তমান শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর ফোন আসতে শুরু করে আমার কাছে। আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই আফসার মুন্না, ফাইয়াজ সামিন, কৌরিত্র পোদ্দার, অর্ণব, ডিপার্টমেন্টের বড় বোন সুপ্তি, শর্বানী, প্রাচী, লামিশাসহ অনেকে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ শুরু করেন, যাতে স্থানীয়ভাবে পাহারার ব্যবস্থা করা যায়। এই গণমাধ্যমের যে বিভাগে আমি কর্মরত, তার প্রধানও এগিয়ে আসেন। জানিয়ে দেন টিবিএসের সাতক্ষীরা প্রতিনিধিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতি থেকেও বাড়ি বাঁচানোর চেষ্টা শুরু হয়। ফেসবুকে ভাইরাল হতে থাকে – আমার বাড়িতে হুমকির ব্যাপারটা। আমি বাড়িতে না থাকলেও শেষপর্যন্ত আমার বাড়ির সামনে পাহারা বসে বাড়িটা বাঁচানোর উদ্যোগে, এবং অত হইচই, এত মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে সাতক্ষীরার বাড়িটা বেঁচে যায়।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা – দেশের এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে মন্দির, গীর্জাসহ সমস্ত ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে পাহারা বসিয়েছে। সংখ্যালঘুদেরকে ওরা সংখ্যালঘুর কাতারে ফেলে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকেনি। যে কাজ পুলিশের করবার কথা ছিল, সে দায়িত্ব ওরা কাঁধে তুলে নিয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে কোনো হিন্দুর প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে এরাই। কিন্তু, কারা এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করলো? কারা আমার বাড়ি পুড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চেষ্টা করলো- সেটা জানতে পারা জরুরি। এদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি, বাংলাদেশের সমস্ত জনগণের।
দেশ কোনো স্বৈরাচারীর যেমন না, দেশ কোনো বিভেদ সৃষ্টিকারীরও হতে পারে না। বাংলাদেশ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আমাদের সকলের। যারা এমন ধরনের হামলার শিকার হচ্ছে, তাদেরকে পুনর্বাসনের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসুক সরকার। মানসিকভাবে পাশে থাকুক সমস্ত মানুষ। যে মানুষটার বাড়ি ভেঙেছে তাকে "প্রমাণ দিন" বলে সন্দেহের সৃষ্টি না করে দুটো স্বস্তির কথা শোনান। অবশ্যই গুজবকে রুখতে হবে। তবে সেটা কারো মনে ক্ষত সৃষ্টি করে নয়। বাংলাদেশীরা ভাইয়ের জন্যে লড়তে জানে, ভাইকে আগলে রাখতে জানে তার প্রমাণ আমরা বিগত কয়েক মাসে বারবার পেয়েছি।
জননী, জন্মভূমি স্বর্গের চেয়ে প্রিয়। সেই জননী, জন্মভূমির মায়া ছেড়ে কোনো সংখ্যালঘু প্রাণের ভয়ে দেশ ছাড়ুক – তা আমরা কেউ চাই না। যারা চায়, তারা সুবিধাবাদী। এইসমস্ত রাজনৈতিক সুবিধাবাদী সংখ্যায় খুব বেশি না। এদেরকে রুখতে ছাত্রসহ সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। কিছু মানুষ সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানান কথা লিখছে। কেউ কেউ লিখছে, "ভালো না লাগলে ভারতে চলে যান"। তাদেরকে বলতে চাই, ভারত আমার দেশ না। আমার দেশ, আমার মাটি, আমার মা, বাংলাদেশ। এই মাটিতে অন্য সকলের মতন আমারও অধিকার আছে। এই দেশের মাটিতে মিশে আছে আমার বাবা, ঠাকুরদার স্মৃতি, মিশে আছে মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ। এই দেশেই আছে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুরা- যারা কখনো আমাকে হিন্দু ভাবে না, বন্ধু ভাবে। আমার বাড়িতে পাহারা দেওয়া ভাইয়েরা আমায় বোন ভাবে। নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেওয়া মানুষটা আমায় মেয়ে ভাবে। সমস্ত চক্রান্তকে রুখে সুদিন ফিরবে দ্রুত। পুড়ে যাওয়া বাড়ির আঙিনায় ফুল ফুটবে আবার, বার বার। তুলসিমঞ্চ আলোকিত হবে প্রদীপের আলোয়। সমস্ত শোক ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে শামিল হবো আমরাও।
লেখক: সাংবাদিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী